হাওরের সুখ-দুঃখ যেমন দেখেছি—শেষ পর্ব

ছোটবেলায় আমাদের অনেক অবসর সময় ছিল। বর্তমান সময়ের শিক্ষার্থীদের মতো আমরা প্রাইভেট টিউটরের কাছে বা কোচিং সেন্টার পড়াশোনা করতাম না। স্কুলেই পড়া বুঝে ফেলতাম। আর বাড়িতে নিজে নিজে পড়তাম। এরপর অবসর সময়ে খেলাধুলা করতাম। রাতে উঠানে গল্পের আসর বসত। পাড়ার মুরব্বিরা সময় কাটানোর জন্য একসঙ্গে বসতেন। মজার মজার গল্প বলতেন। বিশেষ করে ভূতের গল্প। অসম্ভব সুন্দর ছিল গল্পগুলো। কেউ কেউ এমনভাবে বলতেন, মনে হতো যেন সত্যি গল্প।
এমন একটা গল্প বলি।

আমাদের গ্রামের অদূরে যে নদীটা আছে, সেখানে বড় বেপারীর নৌকা (ধান–পাটের ব্যবসার জন্য ব্যবহৃত বড় নৌকা) থাকত। এসব নৌকায় যুবকদের অনেকেই এমনকি মধ্য বয়সী লোকজনও আড্ডা দিতেন। এক দিন সন্ধ্যায় অনেকেই একটা নৌকায় আড্ডা দিচ্ছিলেন। রাতে দুজনকে নৌকায় রেখে অন্য সবাই বাড়িতে খাওয়ার জন্য গেলেন। তাঁরা বলে গেলেন যে খেয়ে আসার সময় এ দুজনের জন্য ভাত নিয়ে আসবেন। রাতটা ছিল বেশ অন্ধকার। নৌকায় একটা হারিকেন জ্বালানো ছিল।

এরপরও নৌকার বাহিরে নদীর পাড়টায় ঘুটঘুটে অন্ধকার। নৌকায় থাকা দুজনের মধ্যে একজন ছিলেন খুব সাহসী আর অন্যজন ছিলেন বেশ ভীতু। হঠাৎ করেই তাঁরা নদীর পাড় দিয়ে বেশ কিছু বাচ্চা নিয়ে একটা মুরগির হেঁটে যাওয়ার স্পষ্ট আওয়াজ শুনলেন।

রাতে নদীর পাড়ে মুরগির বাচ্চা নিয়ে হেঁটে যাওয়ার আওয়াজ শুনে তাঁরা বেশ আশ্চর্য হলেন। এরপরই তাঁরা শুনতে পেলেন একটা ঘোড়া খুব জোরে নদীর পাড় ঘেঁষে একেবারে নৌকার কাছ দিয়ে চেঁচিয়ে দৌড়ে চলে গেল। এরপর আরও কয়েকটি ঘোড়া একই ভাবে দৌড়ে চলে গেলে নৌকায় থাকা ভীতু লোকটা বেশ ভয় পেয়ে গেলেন। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই হারিকেনের আলোটা নিভে যায়। এমন সময় মনে হলো কে যেন লাফ দিয়ে নৌকায় উঠল। নৌকাটা একেবারে কেঁপে উঠল। সাহসী লোকটা রাগে চিৎকার দিয়ে বলে উঠলেন, ‘কোন শালা রে, এমনভাবে লাফ দিয়ে নৌকায় উঠলি?’ কিন্তু যে উঠল সে কোনো উত্তর না দিয়ে সরাসরি নৌকায় ভেতরে ঢুকে পড়ল। সাহসী লোকটাও লুঙ্গি কাছা দিয়ে তাকে ধরে ফেললেন। নৌকার ভেতর শুরু হলো মল্লযুদ্ধ।

মনে হলো নৌকাটা ভেঙে যাচ্ছে। এদিকে ভীতু লোকটা ভীষণ ভয় পেয়ে গেলেন। তিনি লাফ দিয়ে পানিতে পড়ে কোনোরকমে সাঁতরে নদীর পাড়ে উঠেই দিলেন দৌড়। চলে গেলেন বাড়িতে। গিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে সবার কাছে ঘটনা বললেন। মুহূর্তেই পাড়ার সবাই ঘটনাটা জানলেন। সবাই হারিকেন, লাইট, রামদা, বল্লম ইত্যাদি নিয়ে নদীর পাড়ে নৌকার কাছে গেলেন। গিয়ে দেখলেন সাহসী লোকটা মরে পড়ে আছে। তাঁর ঘাড় মটকানো। মুখ থেকে তখনো শ্লেষা বেরুচ্ছে।
আরও একটা গল্প বলি।

আমাদের গ্রামের এক লোক মামলায় হাজিরা দিতে নেত্রকোনা কোর্টে গিয়েছিলেন। তখনকার দিনে অনেকেই যানবাহনের ধার ধারতেন না। খুব ভোরে নেত্রকোনার উদ্দেশ্যে হেঁটেই রওনা করতেন। এমনকি ময়মনসিংহেও হেঁটে চলে যাওয়ার দৃষ্টান্তও কিন্তু বিরল ছিল না। সঙ্গে চিড়ামুড়ি, গুড়, পিঠা ইত্যাদি রাখতেন। খিদে লাগলে এগুলো খেয়ে নিতেন। যা হোক, ভদ্রলোক নেত্রকোনা কোর্টে হাজিরা দিয়ে হেঁটেই আবার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। আমাদের গ্রাম থেকে এক কিলোমিটারেরও বেশি দূরের কইজানি নদীর পাড়ে যখন পৌঁছালেন, তখন রাত দুপুর। নৌকা ছাড়া নদী পেরোনোর কোনো উপায় নেই। খেয়া নৌকাটা নদীর পূর্ব পাড়ে। নৌকার মাঝিও চলে গেছেন সন্ধ্যার পরপরই। এত রাতে তাঁর থাকার কথা নয়। ভদ্রলোক পড়লেন মহাবিপদে।

সেদিন ছিল চাঁদনি রাত। ভদ্রলোক নদীর পশ্চিম পাড়ে দাঁড়িয়ে নদী পার হওয়ার উপায় খুঁজছিলেন। এমন সময় দেখলেন নদীর পূর্ব পাড়ে খুব বৃদ্ধ এক লোক একা বড়শি (মাছ ধরার উপকরণ) নিয়ে বসে আছেন। ভদ্রলোক এই বৃদ্ধকে ডাক দিয়ে তাঁকে পার করার জন্য অনুরোধ জানালেন। বৃদ্ধ লোকটা কোনো কথা না বলে ধীরে ধীরে নৌকার কাছ গেলেন। এরপর নৌকাটাকে এমন জোরে এক ধাক্কা দিলেন যে নৌকা এসে এমনভাবে পশ্চিম পাশে লাগল, নৌকার গলুইয়ের পুরোটাই পাড়ের মধ্যে ঢুকে গেল। এত বৃদ্ধ লোকের ধাক্কায় যেখানে নৌকা নদী পার হওয়ারই কথা নয়, সেখানে নৌকার গলুইটা এপাড়ে এসে একেবারে মাটির মধ্যে ঢুকে গেল! আমাদের গ্রামের লোকটার আর বুঝতে বাকি রইল না যে ওই বৃদ্ধ মোটেই মানুষ নন। উনি জলজ্যান্ত একটা ভূত। বিষয়টা বুঝেই ভদ্রলোক ভীষণ ভয় পেয়ে গেলেন। তিনি নৌকায় না উঠে পশ্চিম দিকে সোজা দৌড় দিলেন। আর শিকার হাতছাড়া হওয়ায় ভূতবেটা রাগে আগুন হয়ে চিৎকার দিয়ে বলল, ‘যা, বেঁচে গেলি। তোর ভাগ্য ভালো।’
এ লেখাটা লিখতে গিয়ে অনেক গল্প মনে পড়ে যাচ্ছে। আরও একটা গল্প না হয় বলেই ফেলি।

তখনকার দিনে ষাঁড়ের লড়াই হতো। আর লড়াইয়ের ষাঁড়টার যত্নও নেওয়া হতো একটু অন্য রকম। কিছুটা রাত থাকতেই রাখাল ষাঁড়টাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন। একদিন এক লোক ঘুম থেকে উঠে শেষ রাত ভেবে গভীর রাতেই ষাঁড় নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন।

হাওরে গিয়ে ষাঁড়টাকে ঘাস খাওয়াচ্ছেন। এমন সময় দেখলেন অনেকগুলো ঘোড়া তাঁর চতুর্দিকে চক্কর দিচ্ছে আর জোরে জোরে চেঁচামেচি করছে। লোকটা বেশ ভয় পেয়ে গেলেন। এদিকে ঘোড়ার সংখ্যাও ক্রমেই বেড়েই চলল। লোকটা ষাঁড়টার দিকে তাকিয়ে দেখলেন ষাঁড়টা ঘাস না খেয়ে দাঁড়িয়ে কি যেন ভাবছে। লোকটা লক্ষ করলেন, হঠাৎ ষাঁড়টা তার ঘাড়টা নিচু করে দিল। লোকটাও তাড়াতাড়ি ষাঁড়ের ঘাড়টার ওপর চড়ে বসলেন এবং ষাঁড়ের গজটার মধ্যে শক্ত করে ধরে চোখ বুজে আল্লাহর নাম নিতে লাগলেন। আর ষাঁড়টা কালবিলম্ব না করে প্রচণ্ড বেগে দৌড়াতে দৌড়াতে পাশের গ্রামের একটা বাড়ির উঠানে গিয়ে দাঁড়াল। ষাঁড়ের শব্দে বাড়ির মানুষজন সবাই বেরিয়ে এলেন। তাঁরা দেখলেন ষাঁড়ের ঘাড়ের ওপর বসে আছেন এক লোক। ষাঁড়টা আবার তাঁর ঘাড়টা নিচু করে দাঁড়াল। লোকটা আস্তে আস্তে ষাঁড়ের ঘাড় থেকে নামলেন।

তখনও তিনি ভয়ে কাঁপছেন। তিনি ঘটনাটা সবার কাছে খুলে বললেন। সে বাড়ির মানুষেরা তাঁকে তখনই আর আসতে দিলেন না। তাঁরা তাঁকে সকাল হওয়া পর্যন্ত সেখানে থাকতে বললেন। তাঁর পানাহারের ব্যবস্থা করলেন। ভোর হওয়ার পর তিনি ষাঁড় নিয়ে বাড়ি ফিরলেন।

ছোটবেলায় এমন কত গল্প শুনেছি। এসব গল্প শুনে একদিকে যেমন অসাধারণ মজা পেয়েছি, অপর দিকে ভীষণ রকম ভয়ও ছিল। গল্প শুনে যদিও খুব ভয় পেতাম, তবে শেষ না করে উঠতেও ইচ্ছে করতে না। গল্প বলা শেষ হলে শুয়ে শুয়ে ভাবতাম, বাড়ির বাইরে গেলে আর বুঝি রক্ষা নেই। আমাদের বাড়ির সামনে একটু দূরে রাস্তার পাশে একটা বটগাছ ছিল। সেটাতে নাকি ভূতের বাসা ছিল। আমি নিজে দেখেছি, কাউকে জিন-ভূতে ধরলে সেই বটগাছের মগডালে উঠে বসে থাকতেন। আমাদের বাড়ির একটু দূরে গোবাটের পাশে একটা ঝাকড়া ধরনের শেওড়াগাছ ছিল। রাতে শুয়ে শুয়ে ভাবতাম, এই বটগাছ বা শেওড়াগাছ কোনোটার ধারেকাছেও কোনো দিনই যাব না।

এতটাই ভয় লাগত যে প্রস্রাবের চাপ হলেও বাইরে যেতে ইচ্ছে হতো না। আর কাউকে সঙ্গে নিয়ে প্রস্রাব করতে গেলেও মনে হতো ভূত বুঝি আমার আশপাশেই আছে। সুযোগ পেলেই ধরে ফেলবে। আবার সকালে ঘুম থেকে উঠে যখন দেখতাম চতুর্দিক আলোকিত, তখন আর এতটা ভয় থাকতে না। কিছুটা ভয় থাকলেও বটগাছ আর শেওড়াগাছটাকে তখন আর এতটা ভয়ংকর মনে হতো না। একদম একা একা না পারলেও এক–দুইজন সঙ্গী নিয়ে একটু সাহস করে গাছ দুটির পাশ দিয়ে চলে যেতে পারতাম। যা হোক, এসব গল্প শুনে যতটা মজা পেয়েছি বড় হয়ে নাম করা সব গল্প–উপন্যাস পড়েও তেমন মজা পাইনি।

হাওর অঞ্চলে কাটানো আমার শৈশব আর কৈশোরের দিনগুলোর এমন অনেক স্মৃতির কথাই মনে পড়ছে। কিন্তু সব লিখে আপনাদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটাতে চাই না। আমার ছোটবেলার আর একটা গল্প বলেই লেখাটার ইতি টানতে চাই। একদিন আমাদের বাড়ির সবাই কি একটা কাজে ব্যস্ত থাকায় হাওর থেকে গরু আনার দায়িত্ব পড়ে আমার ওপর। আমি তখন বেশ ছোট। বৈশাখ বা জ্যৈষ্ঠ মাসের কথা। পাটখেত ছিল প্রচুর।

Md. Rashedul Alam Rasel

পাটগাছগুলোও বেশ লম্বা হয়ে গেছে তখন। আমি গোবাট (মাটির রাস্তা) দিয়ে হাওর থেকে গরুগুলো নিয়ে বাড়ির দিকে আসছি, রাস্তার দুই ধারেই পাটখেত। তখন সূর্য ডুবে যাচ্ছে। আমার আশপাশে আর কোনো মানুষজন দেখতে পাচ্ছি না। কিছুটা ভয় ভয় লাগছে। হঠাৎ একটা শিয়াল দেখলাম। শিয়ালটাকে দেখার পর ভয়ের মধ্যেও মাথায় একটু দুষ্টুমির বুদ্ধি খেলে গেল। আমি শিয়ালের মতো একটা ডাক দেওয়ার চেষ্টা করলাম। এরপর যে কাণ্ডটা ঘটল, তার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। আমি শিয়ালের মতো ডাক দেওয়ার সঙ্গে সাঙ্গে আশপাশের দুই–একটা শিয়াল ডাক দিল।

এদের সঙ্গে যোগ দিল আরও বেশ কয়েকটা। এরপর আরও অনেক। এরপর মুহূর্তের মধ্যেই শত শত শিয়াল এমন জোরে জোরে ডাকতে লাগল যে পুরো হাওরটাই কেঁপে উঠল। আমি ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম। মনে হলো যেন সব শিয়াল মিলে আমাকে টুকরো টুকরো করে খেয়ে ফেলবে। আমি তাড়াতাড়ি আমাদের গরুগুলোর মাঝখানে ঢুকে পড়লাম। ভয়ে জড়সড় হয়ে কোনোরকমে হাঁটতে লাগলাম। যা হোক, কিছুক্ষণের মধ্যেই শিয়ালের চিৎকার থামল। আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। সেদিন নিরাপদেই বাড়িতে ফিরতে পারলাম। তবে এই ভয়ংকর ঘটনার পর হাওরে শিয়াল দেখে আর কোনো দিন কোনো রকম দুষ্টুমি করার কথা চিন্তাও করিনি।

আমার শৈশব আর কৈশোরের দিনগুলোর কথা মনে হলে কেমন যেন নস্টালজিয়ায় পেয়ে বসে। আমি যেন হারিয়ে যাই অতীতের সেসব সোনালি দিনগুলোতে। সেই শর্ষেখেত, ধানখেত আর পাটখেতে ঘুরে বেড়ানো, সারা বিকেল ঘুড়ির পেছনে দৌড়ানো, দিগন্ত বিস্তৃত কখনো সবুজ, কখনোবা সোনালি মাঠের একপাশে দাঁড়িয়ে অন্যপাশে নেমে আসা আকাশটার দিকে বিস্ময়ভরা চোখে তাকিয়ে থাকা, উড়ন্ত বক, শালিক বা বুনো হাঁসের ঝাঁকের দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে থাকা, চাঁদের বুড়ির কাটা সুতার পেছনে দৌড়ে বেড়ানো, প্রকৃতির অপরূপ সৃষ্টি নদীগুলোর পাড়ে দাঁড়িয়ে গুণটানা নৌকা আর মাঝিদের বিরামহীন পথচলা দেখে নিজেও মাঝি হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করা, কাদাপানিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মাছ ধরা, বর্ষা বা গরমের দিনে পানিতে নেমে দীর্ঘক্ষণ সাঁতার কাটা, ঝড়ের দিনে বৃষ্টিতে ভিজে ছড়া (যেমন, আম পড়, জাম পড়, ডালে ডুলে ভাইঙ্গা পড়) বলতে বলতে আম কুড়ানো, সব যেন স্বপ্নের মতো লাগে।

সেসব দিনের স্মৃতিগুলোর কথা, সেসব দিনের গল্পগুলোর কথা সব সময় মনে পড়ে। সোনালি অতীতের স্মৃতি জাগানিয়া এসব মহাকাব্যিক দিনগুলোর কথা কোনো দিন ভুলতে পারব—এমনটা তো ভাবাই যায় না। শেষ
লেখক: মো. মোতাহার হোসেন, প্রধান শিক্ষক (ভারপ্রাপ্ত) মোহনগঞ্জ পাইলট সরকারি উচ্চবিদ্যালয়, মোহনগঞ্জ, নেত্রকোনা।