হাওরের সুখ-দুঃখ যেমন দেখেছি-৩

ছবি: লেখক

আমার শৈশব আর কৈশোরটা একেবারেই সাদামাটা। আর বড়ও হয়েছি খুব সাধারণভাবেই। কিন্তু এই বয়সে এসে যখন আমার অতীতের সাধারণভাবে কাটানো দিনগুলোর দিকে ফিরে তাকাই, তখন মনে হয় কত অসাধারণ আর স্বপ্নের মতো দিন পার করে এসেছি। অগ্রহায়ণ মাসের কথাই বলি। মাসটা গ্রামের মানুষের জন্য ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। হাওরাঞ্চলের সব জায়গায় আমন ধানের চাষ না হলেও আমাদের এলাকায় চাষ হতো (এখনো হয়)। কার্তিকের অভাবের পর নতুন ধান কাটার আনন্দই আলাদা। তখন দেখা যেত উৎসবমুখর পরিবেশ। গ্রামের সব মানুষই ফসল তোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়ত। অন্যদের মতো আমরাও মনের আনন্দে নিজেরাই ধান কাটতাম।

আমার বড় তিন ভাইয়ের সঙ্গে আমিও খুব আনন্দ করে ধান কাটতাম। ধান কেটে এগুলো নিজেরাই মাথায় করে বাড়ি নিয়ে যেতাম। বড় ভাই মরহুম হাবিবুর রহমান ছিলেন প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। আমরা ছোটরা যখন ধানের আঁটিগুলো বাড়িতে নেওয়া শুরু করতাম, তখন তিনি বলতেন, ‘দেখি কে বেশি নিতে পারে।’ সঙ্গে সঙ্গে আমরা অনেকটা দৌড়ে দৌড়েই ধান নেওয়া শুরু করতাম। প্রথম হওয়ার জন্য প্রতিযোগিতা শুরু করে দিতাম। ভাই অবশ্য সবাইকেই উৎসাহিত করতেন। একবার আমাদের একজনকে বেশি নিচ্ছি বলতেন, তো আরেকবার অন্যজনকে। এভাবে আমাদের মধ্যে একটা প্রতিযোগিতার সৃষ্টি করতেন। যাহোক, কাজ করে আমরা অনেক আনন্দ পেতাম। বড় ভাই আমাদের সব দিকেই খেয়াল রাখতেন। পড়াশোনা থেকে সবকিছুই। বাড়িতে সবাই একসঙ্গে খেতে বসতাম। খাওয়ার সময় বড় ভাই বলতেন, ‘একজন মনে হচ্ছে ভাত ফেলছে।’ ওমনি সবাই সাবধান হয়ে যেতাম। লক্ষ রাখতাম খাওয়ার সময় কারও প্লেট থেকে একটা ভাতও যাতে না পড়ে।

এখানে একটা কথা বলে নিতে চাই। বড় ভাই আমাদের যে শুধু উৎসাহ দিয়ে কাজ করাতেন এটাই নয়, বরং উনি ছিলেন আমাদের পরিবারের অভিভাবক। আব্বা যখন মারা যান, তখন আমি খুব ছোট। সবে স্কুলে যাওয়া শুরু করেছি। এর পর থেকে অসম্ভব পরিশ্রম করে নিজের সাধ–আহ্লাদ বাদ দিয়ে পরম মমতায় সংসারটাকে আগলে রাখেন। একজন শিক্ষক হয়েও কৃষকের মতো কাজ করেছেন। আমাদের পড়াশোনার খরচ জোগানো থেকে শুরু করে উৎসাহ–উদ্দীপনা দেওয়া, কোনোটারই কমতি রাখেননি। বলা যায়, আমাদের পরিবারের শিক্ষার ভিত্তিই স্থাপন করে গেছেন তিনি।

আরও পড়ুন

আত্মীয়স্বজন বা প্রতিবেশীদের কেউ অর্থসংকটে পড়লে আর ওনার কাছে এলে, তেমন একটা চিন্তাভাবনা না করেই ধার–কর্জ দিতেন। পরে দেখা যেত আমাদের প্রয়োজনের সময় টাকা পাওয়া যেত না। এমন অনেকবার হয়েছে। আর এ জন্য তাঁকে পরিবারের অন্যদের অনেক কথাও শুনতে হতো। বিভিন্ন সময় মানুষকে বিভিন্নভাবে উপকার করেছেন। সরল স্বভাবের এ মানুষটাকে ভালোবাসতেন সবাই। বড় ভাই আজ আর বেঁচে নেই। আমাদের মধ্যে আছে তাঁর মহানুভবতার অসংখ্য স্মৃতি। মহান আল্লাহ তাআলা ওনাকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন। আমিন।

ছবি: লেখক

নতুন ধানের ভাত খেতে কত যে ভালো লাগতে, তা বলে বোঝানো কঠিন। তখন হাইব্রিড ধান ছিল না। ধানের ফলন হতো খুব কম। অগ্রহায়ণ মাসে ‘বিরই’ নামের একধরনের ধান ছিল। এর ভাত ছিল অসাধারণ স্বাদের। আলু, শুঁটকি, চেপা বা টাকি মাছের ভর্তা অথবা লাউ বা শিমের সঙ্গে মাছের তরকারি দিয়ে বিরই ধানের ভাত খেতে কি যে ভালো লাগত, তা এখনকার হাইব্রিড মাছ, তরকারি বা ভাত খাওয়া মানুষদের কোনোমতেই বোঝানো যাবে না। তখনকার দিনে মাছ দিয়ে লাউ, শিম ইত্যাদি তরকারি রান্না করলে অন্য রকম একটা ঘ্রাণ আসত। অনেক দূর থেকে সেই ঘ্রাণ পাওয়া যেত, যা বর্তমান সময়ে কল্পনাও করা যায় না। নতুন ধান কাটার পর নারীরা মজার মজার পিঠা বানাতেন। পুঁড়া পিঠা, পুলি পিঠা, চিতই পিঠা ইত্যাদি। আর ঘরে ঘরেই মুড়ি ভাজা হতো। কি যে মজা লাগত এসব খেতে! আমরা জামা বা লুঙ্গিতে মুড়ি নিয়ে এখানে–সেখানে যেতাম, আর হেঁটে হেঁটে মুড়ি খেতাম। তখনকার দিনের ঘরে তৈরি নির্ভেজাল মুড়ির স্বাদের সঙ্গে বর্তমান সময়ের মুড়ির কোনো তুলনাই হয় না।

ছোট সময় হাওরে অনেকবার ভাত খেয়েছি। হাওরে ভাত খেতে খুব ভালো লাগত। আবার কোনো দিন কোনো কারণে ভাত খেতে না পারলে খুব খারাপ লাগত। বেশ ছোটবেলার এক দিনের কথা বলি। সেদিন হাওরে খাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়ে আমাদের খুব মন খারাপ হয়েছিল। আমাদের এক মরিচের জমিতে নিরানি দেওয়ার জন্য একজন শ্রমিক (দৈনিক ভিত্তিতে কাজ করার লোক) নেওয়া হয়েছিল। জমিটা আমাদের বাড়ি থেকে অনেক দূর, একেবারে নদীর তীরে। আমাকে বলা হয়েছিল তাঁর জন্য ভাত নিয়ে যাওয়ার জন্য। এ ধরনের কাজে খুব সহজেই এবং খুশি মনে রাজি হয়ে যেতাম। কারণ, এতে করে হাওরে ভাত খাওয়ার একটা সুবর্ণ সুযোগ হতো। সত্যি কথা বলতে কি, ছোটবেলায় হাওরে শুঁটকি ভর্তা, আলু ভর্তা বা ছোট মাছের তরকারি ইত্যাদি দিয়ে ভাত খেয়ে যে মজা পেয়েছি, আমেরিকা বা নিউজিল্যান্ডে বড় বড় হোটেলে অত্যাধুনিক খাবার খেয়েও এত মজা পাইনি। যাহোক, মা আমাকে তাড়াতাড়ি খাওয়াদাওয়া করে হাওরে ভাত নিয়ে যাওয়ার জন্য বললেন। আমি হাওরে খাওয়ার ইচ্ছে পোষণ করে বেশি করে ভাত দিয়ে দেওয়ার জন্য বললাম। হাওরে ভাত খাব শুনে আমার সঙ্গে আরও দুজন যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে গেল। আমরা সবাই যাতে খেতে পারি, এই পরিমাণ ভাত নিয়ে রওনা হলাম। নদীর পাড় আমাদের বাড়ি থেকে বেশ দূরে। পৌঁছাতে অনেক সময় লাগল। যিনি কাজ করছিলেন তিনি আমার দূরসম্পর্কের দাদা। দাদা আমাদের দেখেই বললেন, ‘তোদের আসতে এত দেরি হলো কেন?’ আমরা কিছু বললাম না। বুঝলাম যে দাদার খুব ক্ষুধা পেয়েছে। দাদা তাড়াতাড়ি নদীতে হাত ধুয়ে গামলায় করেই খাওয়া শুরু করে দিয়েছেন। শুরুতে একবার আমরা খাব কি না জিজ্ঞেস করলেন, এইটুকুই।

ছবি: লেখক

এরপর আর আমাদের উত্তরের অপেক্ষা না করেই খাওয়া শুরু করলেন। আমরা শুধু আশ্চর্য হয়ে দাদার খাওয়া দেখতে লাগলাম আর জিবের পানি ফেলতে লাগলাম। তবে ভাত যেহেতু বেশি করে নিয়েছিলাম আমাদের ক্ষীণ আশা ছিল যে দাদা হয়তো সব ভাত খেতে পারবেন না। যাহোক, বেশির ভাগ ভাত খেয়ে দাদা একবার শুধু বললেন, ‘তোরা তো খেলি না।’ আবার খাওয়া শুরু করলেন। আমরা সংকোচে এবারও খাওয়ার কথা বলতে পারলাম না। এর অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই বাকি ভাতগুলো খেয়ে একেবারে নদীর পানিতে গামলাটা ধুয়ে সেই গামলাটা দিয়েই নদীর পানি খেয়ে বললেন, ‘যা দেরি করিস না। বাড়িতে আবার তোদের জন্য চিন্তা করবে।’ আমরা অত্যন্ত মন খারাপ করলাম। আর সারা রাস্তাই দাদাকে গালাগালি করতে করতে বাড়ি পৌঁছালাম। আমরা এমনিতেই ছোট মানুষ। এতটা রাস্তা যাওয়া আর না খেয়ে ফিরে আসা। খুব ক্ষুধা পেয়েছিল। বাড়িতে এসে যখন পুরো ঘটনা বললাম, তখন বাড়ির সবাই আশ্চর্য হলেন। এরপর আমাদের খেতে দিলেন। আসলে গ্রামের মানুষ পরিশ্রম করতেন (এখনো করেন) বেশি। আর তাঁদের ক্ষুধাও পায় বেশি। দাদার ক্ষেত্রেও এটাই হয়েছিল। এখন বুঝতে পারি, দাদার কোনো দোষ ছিল না। মহান আল্লাহ তাআলা ওনাকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন। আমিন।

আরও পড়ুন

এখানে একটা কথা বলে রাখি। এই যে দাদার কথা বললাম, উনি ভাত খেয়ে নদীর পানি খেয়েছিলেন এটা শুধু এই দাদার ক্ষেত্রেই না, বরং তখন সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য ছিল। আমি নিজেও হাওরে অনেকবার ভাত খেয়ে নদী বা বিলের পানি খেয়েছি। তাতে খুব একটা সমস্যা হয়েছে, এমন কিন্তু দেখিনি। গ্রামের মানুষদের আমি দেখেছি যে তাঁরা কাদা পানিতে কাজ করছেন, হাত একেবারে কাদায় ভরা। এমন সময় তাঁদের জন্য কেউ ভাত নিয়ে এলেন। আর সঙ্গে সঙ্গেই হাত দুটি কোনোরকমে একটু ধুয়েই খেতে বসতেন। সাবান দিয়ে হাত না ধুয়ে ভাত খাওয়া যাবে না, এমনটা তাঁরা ভাবতেনই না। আর এর কারণে যে তাঁদের খুব একটা অসুবিধা হয়েছে, এমন না। একটা গল্প এখানে বলতে চাই। কার কাছ থেকে গল্পটা শুনেছিলাম মনে নেই। তবে গল্পটা কিন্তু খুব সুন্দর। পাশ্চাত্যের এক গবেষক জানতে পারলেন, বাংলাদেশের অনেক মানুষ স্বাস্থ্যের সাধারণ নিয়মকানুন মানেন না। বিষয়টি সরেজমিন দেখার জন্য তিনি বাংলাদেশে এসে একজন গাইড নিয়ে চলে গেলেন একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটি গ্রামের মাঠে, যেখানে এক ফসলের খেতে কাদামাটিতে কাজ করছিলেন একজন কৃষক। কিছুক্ষণ পর তাঁর জন্য খাবার নিয়ে এল তাঁরই এক ছেলে। খাবার আর বিশেষ কিছু নয়, একটা ছোট গামলায় কিছু ভাত আর শুঁটকি মাছের ভর্তা। খুব কৌতূহল নিয়ে গবেষক এগিয়ে যান কৃষকের কাছে। কৃষক কোনোরকমে কাদা পানিতেই হাতটা একটু ধুয়ে শুঁটকি মাছের ভর্তা দিয়ে ভাত খেতে বসলেন। সবকিছু দেখে গবেষক মহোদয় তো ভয় পেয়ে গেলেন। একদিকে সাবান ছাড়া তা–ও আবার অপরিষ্কার পানিতে হাত ধোয়া, অন্যদিকে ভয়ংকর শুঁটকির ভর্তা দিয়ে ভাত খাওয়া। লোকটা বাঁচবে তো! ভদ্রলোক তাঁর আশঙ্কার কথা গাইডকে জানালেন। গাইড তাঁকে বললেন, এ ধরনের খাবার খেয়ে কৃষকের কোনো সমস্যাই হবে না। গবেষক তো অবাক। তিনি ভাবলেন, খাওয়ার অল্পক্ষণের মধ্যেই কৃষক অসুস্থ হয়ে পড়বেন। কিন্তু বাস্তবে হয় উল্টো। কৃষক খাওয়া শেষ করে কোমর বেঁধে আবার কাজে লেগে যান দ্বিগুণ শক্তিতে। আর গবেষক হাঁ করে শুধু তাকিয়ে থাকেন তাঁর দিকে। জীবনী শক্তি আর কাকে বলে! আর এমন জীবনী শক্তি নিয়েই বেঁচে আছেন এ দেশের কোটি কোটি মানুষ। রোগে-শোকে, ঝড়ে, জলোচ্ছ্বাসে, আন্দোলন–সংগ্রামে, দুর্যোগে, দুর্বিপাকে এই জীবনী শক্তি নিয়েই ঘুরে দাঁড়ান তাঁরা। আমার বিশ্বাস মহান আল্লাহ তাআলার অশেষ কৃপায় ভালোভাবেই বেঁচে থাকবেন এ দেশের কোটি কোটি মানুষ। এখানে ওষুধে, মাছ-মাংস, শাকসবজি ইত্যাদি প্রায় সবকিছুতেই ভেজাল মেশানো হয়। তাই বলে কি জীবনকে থামিয়ে রাখা যায়? জীবনকে কি থামিয়ে রাখা সম্ভব? কখনো না। জীবনের ধর্মই হলো থেমে না থাকা। যারা এ জীবনের ধর্ম সম্পর্কে জানে না, তারাই নিজেদের স্বার্থে জীবনকে বিপন্ন করে তোলার প্রয়াস পায়। কিন্তু তারা জানেই না এ দেশের সাধারণ মানুষ কত প্রাণশক্তির অধিকারী। এ দেশের আনাচকানাচে শুধুই জীবনের গল্প। তবে একটা কথা এখানে বলে রাখতে চাই। আমার এ লেখাটা পড়ে কেউ যেন আবার খাল, বিল বা নদীর পানি খেতে শুরু করবেন না। আমি যে সময়ের কথা লিখেছি, সেটা অনেক আগের। তখন পানিদূষণ, বায়ুদূষণ, পরিবেশদূষণ ইত্যাদি বর্তমান সময়ের মতো ছিল না। এ ছাড়া করোনার মতো বিশ্ব মহামারিও ছিল না। তাই বর্তমানে আমাদের সাবধানেই চলতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি অবশ্যই মানতে হবে। তা না হলে নিশ্চিত বিপদের মুখোমুখি হতে হবে। চলবে...

*লেখক: মো. মোতাহার হোসেন, প্রধান শিক্ষক (ভারপ্রাপ্ত), মোহনগঞ্জ পাইলট সরকারি উচ্চবিদ্যালয়, মোহনগঞ্জ, নেত্রকোনা

*নাগরিক সংবাদে লেখা ও ছবি পাঠানো ঠিকানা [email protected]