স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে জাতির প্রত্যাশা
বিশ্বব্যাপী ভয়াবহ করোনাভাইরাসের ভয়াল থাবার মধ্য দিয়েও আমরা এবার দেশজুড়ে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপন করছি। গত কয়েক মাসে করোনা কিছুটা দুর্বল হলেও চলতি মাসের শুরু থেকে করোনা আবারও প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। তাই সরকারের দেওয়া পদক্ষেপ অনুসরণ করে স্বাস্থ্যবিধি মেনে আমরা এবার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপন করছি। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। বাঙালির হাজার বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল, দাসত্বের গণ্ডি রোধ করে স্বাধীনতার লাল সূর্যের রঙের সঙ্গে মিশে আছে ত্রিশ লাখ শহীদের রক্ত, দুই লাখ মা–বোনের সম্ভ্রম হারানোর বেদনা এবং বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতির মাশুল। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এসে বাংলাদেশ আজ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা ভোগ করেছে, যা জাতির জন্য এক মহান গৌরবের বিষয়।
স্বাধীনতার পর ‘তলাবিহীন ঝুড়ির দেশ’ আখ্যা দিয়ে যারা অপমান-অপদস্থ করেছিল, সেই তাদের কণ্ঠেই এখন বাংলাদেশের অগ্রগতির ও উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা ভোগ করার প্রশংসা। দারিদ্র্য ও দুর্যোগের বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উত্তরণের পথে। অনেকের জন্য যা রোল মডেল। গত ডিসেম্বরে বিজয় অর্জনের ৪৯তম বছর অতিক্রম করে ২০২১ সালে বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী এবং ২০২১ সালের ১৭ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন এবং ২৬ মার্চ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী—এগুলো হলো স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে দেশের এক মহান অর্জন।
যাঁদের আত্মত্যাগ ও স্বজন হারানোর বেদনার মধ্য দিয়ে আমরা স্বাধীন সার্বভৌমত্ব বাংলাদেশ পেয়েছি, তাঁদের প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। আমরা গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি স্বাধীনতার মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় চার নেতাসহ মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব ও সংগঠকদের। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যেসব ভারতীয় সেনা এই মাটিতে জীবন দিয়েছেন, রক্ত ঝরিয়েছেন, তাঁদের প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিসহ আর্থসামাজিক প্রতিটি সূচকে এগিয়েছে বাংলাদেশ।
১৯৭০ সালের নির্বাচনের আগে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে শিক্ষা খাতের বিনিয়োগকে বঙ্গবন্ধু সর্বোৎকৃষ্ট বিনিয়োগ বলেছিলেন। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাভাবনার প্রতিফলন দেখা যায় রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন পদক্ষেপে। দেশের শিক্ষা খাতে ব্যাপক সফলতা অর্জিত হয়েছে। করোনাকালে পুরো বিশ্বের শিক্ষাব্যবস্থা স্থবির হয়ে পড়ছে। বাংলাদেশেও এর রেশ বহমান। কিন্তু ডিজিটাল বিশ্বের ছোঁয়া এখন বাংলাদেশে। যার ফলে দেশে অনলাইনে ক্লাস চলেছে, শিক্ষার্থীরা নির্বিঘ্নে অনলাইনে ক্লাস করতে পারছে। বর্তমানে বাংলাদেশের রপ্তানি ৮০ গুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারে। একই সঙ্গে বেড়েছে রপ্তানি পণ্যের সংখ্যাও। তৈরি পোশাকে বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। ৪০ লাখের বেশি শ্রমজীবী এ খাতের পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন।
ইতিমধ্যেই আমরা অর্থনৈতিকভাবে নিম্ন আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে উত্তরণ ঘটাতে সক্ষম হয়েছি। স্বাধীনতার পর থেকেই বয়ে বেড়ানো ‘স্বল্পোন্নত’ তকমা ঝেড়ে ফেলাও এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। একদা বৈদেশিক অনুদান ও লোন ছাড়া মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন অকল্পনীয় ছিল। এখন আমাদের নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা বহুমুখী সেতুর মতো বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পেরেছি। প্রসঙ্গগত, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে বর্তমান সরকার যেভাবে কার্যকর ভূমিকা পালন করে মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি এনে দিয়েছে, তা রীতিমতো পৃথিবীর কাছে বিস্ময়কর। সরকার দেশ থেকে দারিদ্র্য দূরীকরণে সফলতা অর্জন করেছে। এর ফলে আমাদের দেশে এখন ভিক্ষাবৃত্তিসহ সব সামাজিক বৈষম্য বহুলাংশে কমে এসেছে।
গ্রামপ্রধান বাংলাদেশের সব গ্রামকে সাজানো হচ্ছে শহরের আদলে সমস্ত সুযোগ-সুবিধা দিয়ে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর দ্বারপ্রান্তে এসে জাতির প্রত্যাশা হবে জাতীয় এই অর্জনগুলোকে ধরে রাখা, রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপব্যবহার রোধ করা, মানুষের মৌলিক চাহিদা নিশ্চিত করাসহ ব্যাপক প্রসার ঘটাতে হবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে। মনে রাখতে হবে, একটি দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন নিশ্চিত করে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন। তাই নব–উদ্যমে এসব নতুন আশা ও স্বপ্ন নিয়েই উদ্যাপিত হচ্ছে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী।
*লেখক: রনি সরকার, শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর।