সুখের অন্বেষণে অন্তহীন যাত্রা

আবিদিন ডিনোর আঁকা সুখের ছবি
ছবি: সংগৃহীত

হাজার বছর ধরে একটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে মানুষ—মানবজীবনের মূল লক্ষ্য কী? কনফুসিয়াস, সক্রেটিস, অ্যারিস্টটলের মতো মহান দার্শনিকেরা খুঁজেছেন এই প্রশ্নের উত্তর। গৌতম বুদ্ধ তাঁর জীবনের উল্লেখযোগ্য সময় ব্যয় করেছেন মানবজীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য অনুসন্ধানে। পরবর্তী সময়ে অনেক জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিত্ব এই বিষয়ে গবেষণা এবং তাঁদের মূল্যবান মতামত ব্যক্ত করেছেন। এসব গবেষণায় একটি বিষয় বেশ জোরালোভাবে প্রতিভাত হয়েছে, আর সেটি হলো মানুষের জীবনের মূল উদ্দেশ্য সুখে থাকা।

স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন জাগে, সুখ আসলে কী? আর সুখ পরিমাপ করার কোনো বৈজ্ঞানিক উপায় কি আছে? সুখকে সংজ্ঞায়িত করা কিছুটা কঠিন বটে। আভিধানিক অর্থে সুখ মানে একধরনের তৃপ্তিদায়ক অনুভূতি। নিঃসন্দেহে সুখ একটা আপেক্ষিক ব্যাপার। সঠিকভাবে সুখ পরিমাপ করার তেমন কোনো স্বীকৃত পদ্ধতি নেই। ২০১২ সালে জাতিসংঘের এক প্রস্তাবে বলা হয়েছে, সুখের অনুসন্ধান একটি মৌলিক মানবিক লক্ষ্য। জাতিসংঘ ‘সুখে থাকা’কে একটি মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এ লক্ষ্য অর্জনে সংস্থাটি প্রতিটি সদস্যরাষ্ট্রকে অন্তর্ভুক্তিমূলক, ন্যায়সংগত ও ভারসাম্যপূর্ণ অর্থনৈতিক নীতি অনুসরণ করতে বলেছে, যা মানুষের সুখ ও মঙ্গলের নিশ্চয়তা বিধান করবে। জাতিসংঘের মতে, সুখের অন্তরায় হচ্ছে মূলত তিনটি বিষয়—দারিদ্র্য, বৈষম্য ও পরিবেশদূষণ।

সুখ নিয়ে জাতিসংঘের এ বিশেষ প্রস্তাব গ্রহণের ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা রেখেছে আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভুটান। ভুটান পৃথিবীর একমাত্র দেশ, যারা মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) দিয়ে দেশের নাগরিকদের অগ্রগতি বা সফলতা পরিমাপ না করে মোট জাতীয় সুখ দিয়ে (জিএনএইচ-গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস) তা পরিমাপ করে থাকে। সত্তরের দশক থেকে তারা এই নীতি অনুসরণ করে আসছে। দেশটির চতুর্থ রাজা জিগমে সিংয়ে ওয়াংচুক এই নীতির প্রবর্তক।

মোট জাতীয় সুখ পরিমাপ করার জন্য অর্থনৈতিক সমতা, পারিবারিক বন্ধন, স্বাস্থ্য, লিঙ্গসমতা, কর্মসন্তুষ্টি ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় নেওয়া হয়। এ নীতির অন্যতম এক উদ্দেশ্য হচ্ছে, দেশের নাগরিকেরা পরস্পরের সঙ্গে গভীর বন্ধনে আবদ্ধ থাকবে। এ বন্ধন হবে নিরাপদ এবং সহযোগিতা মনোভাবাপন্ন। মানুষে মানুষে এ বন্ধন সুগভীর বিশ্বাসের ওপর প্রতিষ্ঠিত হবে, যেখানে একজন নাগরিক অন্যজন কর্তৃক কখনোই আক্রান্ত হবে না। প্রাকৃতিক পরিবেশ সুরক্ষার ব্যাপারে ব্যাপক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এ নীতিতে। তেমনি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে প্রত্যেক জাতিসত্তার নিজস্ব সংস্কৃতি রক্ষা এবং সুশাসনের মতো বিষয়গুলোকে। এসব বিষয় পরিমাপের জন্য রয়েছে সুনির্দিষ্ট সূচক।

২০১২ সালে জাতিসংঘের ১৯৩টি সদস্যরাষ্ট্র ভুটান কর্তৃক প্রবর্তিত এ যুগান্তকারী আর্থসামাজিক ব্যবস্থার প্রতি সহমত প্রকাশ করে এবং একটি প্রস্তাব পাস করে। ২০ মার্চকে ‘আন্তর্জাতিক সুখ দিবস’ বা ‘বিশ্ব সুখী দিবস’ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবীর সব মানুষের জীবনে সুখ নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে নতুন অর্থনৈতিক প্যারাডাইম (এনইপি) নামের একটি প্রকল্প চালু করা হয়। ২০১৯ সালে এ প্রকল্প থেকে বিশ্বের সব রাষ্ট্র ও মানুষকে ‘পুঁজিবাদ’ বা ‘ক্যাপিটালিজমের’ পরিবর্তে ‘হ্যাপিটালিজম’ নামক নয়া অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য আহ্বান করা হয়। হ্যাপিটালিজম হচ্ছে এমন একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও রাজনৈতিক দর্শন, যা মূলত সব মানুষের স্বাধীনতা, মঙ্গল ও সুখের নিশ্চয়তা বিধান করবে।

২০১২ সাল থেকে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন সমাধান নেটওয়ার্ক (এসডিএসএন) ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট প্রকাশ করে আসছে। এ রিপোর্টে বিশ্বের সুখী দেশগুলোর তালিকা প্রকাশ করা হয়। মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি), গড় আয়ু, মানবিকতা, সামাজিক সহায়তা, স্বাধীনতা ও দুর্নীতির ওপর ভিত্তি করে সুখী দেশগুলোর তালিকা করা হয়। তবে ২০২১ সালে এসব বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত হয় করোনা মহামারি পরিস্থিতি মোকাবিলায় গৃহীত পদক্ষেপগুলো। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিখ্যাত পরামর্শক প্রতিষ্ঠান গ্যালপ পরিচালিত সমীক্ষা (ওয়ার্ল্ড পোল) থেকে প্রাপ্ত তথ্য এই তালিকা তৈরির কাজে ব্যবহৃত হয়। বিশ্বের ১৬০টি দেশে এই সমীক্ষা পরিচালিত হয়। প্রতিটি দেশে ১৫ বছরের অধিক ন্যূনতম এক হাজার উত্তরদাতার কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়।

প্রত্যেক উত্তরদাতাকে ০ থেকে ১০ স্কেলের মধ্যে তাদের বর্তমান জীবনকে রেট বা মূল্যায়ন করতে বলা হয়, যেখানে ১০ হচ্ছে সবচেয়ে ভালো স্কোর আর ০ সবচেয়ে খারাপ।

২০২১ সালের তালিকা অনুযায়ী বিশ্বের সবচেয়ে সুখী দেশ হচ্ছে ফিনল্যান্ড। চার বছর ধরে তারা ধরে রেখেছে এ অবস্থান। তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১০১তম। ২০২০ সালের জরিপে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১০৭তম। সে হিসাবে বাংলাদেশ র‍্যাঙ্কিংয়ে ছয় ধাপ এগিয়েছে। তবে মানুষ তার ব্যক্তিগত জীবনে কতটা সুখী, সেটার গড় মূল্যায়নে গত বছরে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৬৮তম। এই তালিকায় সবচেয়ে অসুখী দেশ হিসেবে স্থান পেয়েছে আফগানিস্তান।

এতক্ষণ যা আলোচনা হলো নিঃসন্দেহে উৎসাহব্যঞ্জক। পৃথিবীর সব মানুষের সুখ নিশ্চিত করতে জাতিসংঘ যেসব লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে, তা সত্যি আশাব্যঞ্জক। আর এ লক্ষ্য অর্জনে রাজনৈতিক দর্শন ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার যে সংস্কারের প্রস্তাব করা হয়েছে, তা কার্যকর ভূমিকা রাখবে। তবে প্রশ্ন হলো, সুখের সঙ্গে বাস্তবে দারিদ্র্য, বৈষম্য ও পরিবেশদূষণ কতটা সম্পর্কিত?

অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল ও উন্নত পরিবেশে বেড়ে ওঠা অনেক মানুষ আছেন, যাঁরা প্রকৃত অর্থে সুখী নয়। অন্যদিকে, দারিদ্র্যের সঙ্গে প্রতিনিয়ত লড়াই করে প্রতিকূল পরিবেশে বেঁচে থাকা অনেকেই ভীষণ সুখী। এ রকম নজির আমাদের আশপাশে আছে অনেক।

বিখ্যাত তুর্কি কবি নাজিম হিকমত একদিন তাঁর বন্ধু স্বনামধন্য চিত্রকর আবিদিন ডিনোকে সুখের একটা ছবি আঁকতে অনুরোধ করেন। বন্ধুর অনুরোধে আবিদিন সুখের ছবি আঁকলেন—জরাজীর্ণ এক ঘর, ছাদ চুয়ে পানি পড়ছে, একটা ভাঙা খাটে পুরো পরিবার গাদাগাদি করে শুয়ে আছে। অথচ প্রত্যেকের মুখে অনিন্দ্য হাসি! ছবিটি ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছিল।

কেউ কেউ হয়তো বলবেন, শিল্পীরা কল্পনার জগতে বাস করেন। বাস্তবতা অনেক রূঢ়। ছাদ চুয়ে যখন পানি পড়বে, সুখ তখন জানালা দিয়ে পালাবে! হয়তোবা। আবার আমাদের চারপাশেই তো দেখা যায় অভাব, অভিযোগ কিংবা অপ্রাপ্তির মধ্যে বেঁচে থাকা ভীষণ সুখী সব মানুষকে। তাহলে?

গৌতম বুদ্ধের মতে, ‘সুখের জন্ম হয় মনের গভীরে। এটি কখনো বাইরের কোনো উৎস থেকে আসে না।’

আন্তর্জাতিক সুখ দিবসে আমাদের আকাঙ্ক্ষা ‘জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক।’
*লেখক: সাজ্জাদুল হাসান, একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে কর্মরত।