সাংস্কৃতিক জাগরণ ও আমাদের বাঙালিয়ানা
পাকিস্তানিদের ধারণা ছিল বাঙালিদের দেশীয় সংস্কৃতি পাকিস্তান অঞ্চলের সঙ্গে মানানসই নয়। অথচ ‘বাংলা ভাষা’ ও ‘বাঙালি জাতি’—দুটি একই আভিজাত্য সত্তার মননশীলতার বহিঃপ্রকাশ। যদিও তাদের আঘাতে আমাদের বাংলা ভাষা হারায়নি কিংবা বাঙালিয়ানা এতটুকু লীন হয়ে যায়নি; বরং বাংলা ভাষা তার স্বকীয়তা ধরে রাখতে পেরেছে এবং আমরা এখনো ষোলো আনাই বাঙালি। বাঙালির সুপ্ত সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যবোধ জেগে উঠেছিল বাংলা ভাষাকে ঘিরে। সেখান থেকেই অসাম্প্রদায়িক চেতনার একটি ক্ষীণ জলধারা তৈরি হয় এবং ক্রমেই তা ব্যাপ্তি লাভ করে। তাই প্রাণের ভাষাকে রক্ষা করার জন্য বাঙালিরা প্রাণ বিসর্জন দিতেও কার্পণ্য করেনি। এটা যেমন বীর বাঙালি ইতিহাসে গৌরবগাথা–সাফল্য, তেমনি ভাষা আন্দোলনের সাংস্কৃতিক জাগরণও বটে। এ ক্ষেত্রে অনুঘটক হিসেবে কাজ করে সাংস্কৃতিক মুক্তির সংগ্রাম।
যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা সংস্থা ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের দক্ষিণ এশিয়া বিশেষজ্ঞ ব্রুস রিডেল তাঁর ‘ডেডলি এমব্রেস’ বইয়ে লেখেন, পাকিস্তান সৃষ্টির প্রথম থেকেই ‘পাকিস্তানের কাছে বাংলার গুরুত্ব ছিল দ্বিতীয়’ এবং বাঙালিদের ‘দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক’ হিসেবে দেখা হতো। অন্যদিকে, ব্রিটিশ সমাজবিজ্ঞানী জেনিফার কোটস পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের সংস্কৃতি রক্ষার লড়াই নিয়ে একটি গবেষণাধর্মী বই প্রকাশ করেন। সেখানে তিনি লেখেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানের সংস্কৃতি ও পশ্চিম পাকিস্তানের সংস্কৃতির অনেক অমিল এবং বাঙালি তাদের সংস্কৃতি রক্ষা নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন ছিল।’ তিনি আরও লেখেন, ১৯৫৮ সালে পাকিস্তান শাসকেরা বাঙালি সংস্কৃতিকে ভিন্ন খাতে—তারা বলত সঠিক খাতে—পরিবর্তনের কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিল। তাতে মূল উদ্দেশ্য ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদকে চাপ দেওয়া।
সে উদ্দেশ্যেই তারা বাঙালিদের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের ওপর হামলে পড়ে। এদেশীয় সংস্কৃতিকে পাল্টে দেওয়ার গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। তারই প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে মাতৃভাষা, তথা বাংলা ভাষার ওপর আক্রমণ শুরু করে। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু ঘোষণা করেই পাকিস্তানিরা থেমে থাকেনি; তাদের পরিকল্পনায় এমনও ষড়যন্ত্র ছিল, আরবি হরফে বাংলা লেখার সূক্ষ্ম বিভাজন অর্থাৎ বাংলা ভাষাকে আরবি ভাষায় রূপান্তরিত করবে। অন্যদিকে, বাংলা নববর্ষ উদ্যাপনে পাকিস্তানিদের পক্ষ থেকে প্রবল বাধা দেওয়া হয়। বাঙালিরা তাদের শত বাধা উপেক্ষা করে বাংলা নববর্ষ উদ্যাপন করে। তবে সংস্কৃতির ওপর সবচেয়ে বড় আঘাতটি আসে ১৯৬৭ সালের ২৪ জুন। সেদিন পত্রিকায় সংবাদ ছাপা হলো, রেডিও পাকিস্তান থেকে কোনো রবীন্দ্রসংগীত প্রচার করা হবে না! এ ষড়যন্ত্রে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। কারণ, সত্তরের নির্বাচন–পরবর্তী সময়ে শহীদ মিনারে যেসব গান গাওয়া হতো, তার মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেশাত্মবোধক গানও ছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ও আমার দেশের মাটি’, ‘আমি ভয় করব না, ভয় করব না’—এসব গান আমাদের প্রাণের মধ্যে নতুনভাবে উচ্ছ্বাস জাগিয়ে রাখত। মূলত, তাদের সব ষড়যন্ত্র নস্যাৎ হয়ে যায় বাঙালির সাংস্কৃতিক জাগরণের ফলে।
পাকিস্তানের এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিলেন অনেক বুদ্ধিজীবী। ১৮ জন বুদ্ধিজীবী বিবৃতি দিয়ে বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য বাংলা ভাষাকে যে ঐশ্বর্য দান করেছে, তাঁর সংগীত আমাদের অনুভূতিকে যে গভীরতা ও তীক্ষèতা দান করেছে, তা রবীন্দ্রনাথকে বাংলাভাষী পাকিস্তানিদের সাংস্কৃতিক সত্তার অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করেছে। সরকারি নীতিনির্ধারণের সময় এই সত্যের গুরুত্বকে মর্যাদা দান করা অপরিহার্য।’
মানুষ কিংবা জাতি ধ্বংসকারী ব্যক্তিরা সব সময়ই প্রতিপক্ষের চেতনায় আঘাত করে। ইতিহাসও সে রকম সাক্ষ্য দেয়। জার্মানির হিটলার ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই নাৎসি বাহিনীর সদস্যরা সংস্কৃতি সংহারক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল। তাই এক রাতেই প্রায় হাজার বিশেক বই পুড়িয়ে ফেলে, যার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল মানবসংহারে রূপ নেওয়া। পাকিস্তানিদের ক্ষেত্রেও আমরা সে রকমই দেখতে পাই। সংস্কৃতি বিষয়ে বর্বর দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে বাঙালি জাতিসত্তা মুছে দিতে চেয়েছিল। প্রথমে সংস্কৃতি সংহার করে ক্রমেই তা মানবসংহারে রূপ নেওয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। সে জন্যই ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইটের সময় বিভিন্ন গুণীজনের পাশাপাশি সংস্কৃতিকর্মীরাও হায়েনাদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হতে হন। এ কারণে আমাদের হারাতে হয়েছে অসংখ্য সংস্কৃতি ব্যক্তিত্বকে। সার্চলাইটের পরিকল্পনার চতুর্থ ধারায় উল্লেখ করা হয়, ‘গ্রেপ্তার করতে হবে সর্বোচ্চসংখ্যক রাজনীতিক ও ছাত্রনেতাদের এবং শিক্ষকমণ্ডলী ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের মধ্যকার চরমপন্থীদের।’ তাতে বলা যায়, সংস্কৃতিমনা ব্যক্তিরা পাকিস্তানি দোসরদের চক্ষুশূলে পরিণত হয়েছিল। কী পার্থক্য রইল জার্মানির হিটলারের নাৎসি বাহিনী ও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীদের মধ্যে। হিটলারের নাৎসি বাহিনী আগুনে দগ্ধ করেছিল বই, অন্যদিকে পাকিস্তানিরা হত্যা করেছিল বইয়ের রচয়িতাদের! পাকিস্তানিরা বাজেয়াপ্ত করেছিল কিছুসংখ্যক বই।
শিল্প–সংস্কৃতিচর্চা মানুষকে একধরনের আত্মপ্রকাশের সুযোগ দেয়। শিল্পিত মনের ব্যক্তিরা মনের উৎকর্ষ সাধনে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে আবিষ্কার করে সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত। সেই নতুন পথ ধরে এগিয়ে যায় সমাজ। সে ক্ষেত্রে সংস্কৃতি হচ্ছে সমাজের ক্যানভাসস্বরূপ। মার্ক্সবাদী দার্শনিক শিবদাস ঘোষ যথার্থই বলেছেন, ‘মানুষের মননশীলতার সামগ্রিক ও সুন্দরতম প্রকাশ হচ্ছে সংস্কৃতি। শিল্প, সাহিত্য, কাব্য প্রভৃতি এই সংস্কৃতির বাহন।’ মননশীলতা গড়ে ওঠে বুদ্ধি ও হৃদয়বৃত্তির যথার্থ সম্মিলনে। অথচ পাকিস্তানিরা সে জায়গাতেও বাঙালিদের আঘাত করেছিল।
স্বাধীনতা অর্জনের ৫০ বছরে অনেকটা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে দেশ আজ এগিয়ে চলেছে। যে বাংলা ভাষার জন্য অনেককেই প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছে, তা আজ বিশ্বদরবারে আসীন হয়ে আন্তর্জাতিক মর্যাদা লাভ করেছে। ১৯৯৭ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেসকোর স্বীকৃতি নিয়ে অমর একুশের আত্মবলিদান আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি নিয়ে জ্বল জ্বল করছে।
একটা জাতির মেরুদণ্ড ভেঙে গেলে সে জাতি আর উঠে দাঁড়াতে পারে না। অথচ বাঙালি জাতির হাজার বছরের পথচলাকে আরও ঋদ্ধ–শাণিত করে বৈশাখের বর্ণিল আয়োজন, দেশীয় সব উৎসব ও আনুষ্ঠানিকতা। তবে বাংলাদেশের ভাষা ও সংস্কৃতি মুক্তিসংগ্রামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বস্তুত তাঁর সাধনার মধ্য দিয়েই ভাষা, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকেন্দ্রিক বাঙালিদের পূর্ণাঙ্গ ভিত্তি রচিত হয়। রাজনীতিবিদ হওয়া সত্ত্বেও তিনি আমাদের মধ্যে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন ভাষা, সংস্কৃতি ও রাষ্ট্রভিত্তিক জাতীয়তাবাদ।
লেখক: অনজন কুমার রায়, ব্যাংক কর্মকর্তা ও কলামিস্ট