শিক্ষার্থীদের বাড়ি গিয়ে পড়াচ্ছেন শিক্ষকেরা

ছবি: লেখক

ময়মনসিংহের ত্রিশালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পাঠদান করছেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা। পড়া দিচ্ছেন পড়া নিচ্ছেন। পড়াশোনা নিয়ে অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলছেন।

ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার ত্রিশাল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আনোয়ার হোসাইন, আমিরুল ইসলাম, বইলর কানহর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা ফারহানা জামানসহ বিভিন্ন বিদ্যালয়ের বেশ কিছু শিক্ষক কাজ করছেন গ্রামের শিশুদের শিক্ষার মান উন্নয়নে।

করোনার সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। এতে পিছিয়ে পড়ছে গ্রামের শিক্ষার্থীরা। তবে বাস্তবতা হচ্ছে গ্রামের শিক্ষার্থীদের বেশির ভাগেরই নেই কোনো স্মার্টফোন বা কম্পিউটার। এসব কারণে পাঠ কার্যক্রম থেকে ছিটকে পড়ছে এসব শিশু। এ ধরনের পরিস্থিতিতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে পড়ার খোঁজখবর নিচ্ছেন শিক্ষকেরা। এতে খুশি শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা। বাসায়, স্কুলে বা বাড়ির উঠানের পাশে গাছতলায় বোর্ড টাঙিয়ে পাঠদান করাচ্ছেন শিক্ষকেরা।

সামনে কোনো শিক্ষার্থী নেই। সেখানে মোবাইল একটি ট্রাইপডে বসিয়ে দাঁড়িয়ে পাঠদান করান একজন শিক্ষিকা। এভাবেই অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা ফারহানা জামান। এ অনলাইন ক্লাসের আওতায় যেসব গ্রাম পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করতে পারে না, তাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে খোঁজ নিচ্ছেন শিক্ষিকা ফারহানা জামান।

বইলর কানহর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র জোবায়ের আহমেদ জানায়, তার শিক্ষক ফারহানা জামান প্রতি সপ্তাহে একবার তার বাড়িতে যান এবং পড়ার খোঁজখবর নেন। ত্রিশাল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী সুমাইয়া আক্তার জানায়, তার শিক্ষক তার বাড়িতে যান পাশাপাশি ফোনে নিয়মিত খোঁজখবর নেন।

স্থানীয় অভিভাবক মামুনুর রশীদ বলেন, ‘শিক্ষকেরা বতর্মান পরিস্থিতিতে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা নিয়ে শিক্ষকেরা মাঠপর্যায়ে কাজ করছেন। এতে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনায় মনোযোগী হচ্ছে।’

শিক্ষিকা ফারজানা জামান জানান, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা। এমন পরিস্থিতিতে বাড়ছে অনলাইন ক্লাসের গুরুত্ব। সংসদ বাংলাদেশ টিভি চ্যানেলে প্রচারিত হচ্ছে বিভিন্ন শ্রেণির ক্লাস। পাশাপাশি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা নিয়মিত অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছেন। প্রযুক্তিগত নানা সীমাবদ্ধতার মাঝেও গ্রামগঞ্জের শিক্ষকেরা অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছেন। অনেকে নতুন করে শিখছেন প্রযুক্তির ব্যবহার। তবে প্রযুক্তির ব্যবহারের সঙ্গে সম্পৃক্ত না থাকায় এ ক্লাসগুলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছে প্রত্যন্ত গ্রামের শিক্ষার্থীরা।

ত্রিশাল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আনোয়ার হোসাইন বলেন, ‘প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অনলাইনে ক্লাস নেওয়া দিন দিন বাড়লেও বাস্তবতা হচ্ছে গ্রামের বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর অনলাইন ক্লাসে অংশ নেওয়ার সুযোগ নেই। স্মার্টফোন, ইন্টারনেট ও কম্পিউটার ব্যবহারের সুবিধা নেই গ্রামের বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর। এমনকি অনেকের ঘরে টিভিও নেই যে তারা সংসদ টিভির মাধ্যমে ক্লাসে অংশগ্রহণ করবে। এমন পরিস্থিতিতে শিশুদের লেখাপড়া সচল রাখতে আমার এ উদ্যোগ। অনলাইন ক্লাসে শহরের শিক্ষার্থীদের যুক্ত করা গেলেও গ্রামের চিত্র ভিন্ন। তাই অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার পাশাপাশি সপ্তাহে একবার করে হলেও শিক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে খোঁজ নিচ্ছি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা পড়ার টেবিলে বসছে কম। তাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের খোঁজখবর রাখছি। পড়া দিচ্ছি, আবার তা আদায়ও করে নিচ্ছি।’

দরিরামপুর মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবদুল কাইয়ুম জানান, গ্রামে শিশুরা পড়ালেখায় মনোযোগী কম। আর বেশির ভাগ শিক্ষার্থী গরিব পরিবারের, তাই নানা সমস্যা রয়েছে তাদের। শিক্ষকেরা তাঁদের জায়গা থেকে চেষ্টা করছেন, এতে যদি বিন্দুমাত্র শিক্ষার্থীদের উপকার হয়, তাহলেই শিক্ষকদের পরিশ্রম সার্থক।

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মোহাম্মদ সফিউল হক জানান, ময়মনসিংহ অনলাইন প্রাইমারি স্কুল নামে একটি ফেসবুক পেজে প্রতি উপজেলা থেকে ৩৫ জন করে শিক্ষক অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছেন। জেলার ১৩টি উপজেলা থেকে অংশ নেওয়া শিক্ষকদের সংখ্যা ৪৫৫ জন। অনলাইনে ক্লাসের পাশাপাশি ত্রিশাল উপজেলার শিক্ষকদের মতো বাড়ি বাড়ি গিয়ে অনলাইন ক্লাসের আওতায় যাঁরা আসেননি স্বাস্থ্যবিধি মেনে, তাঁদের নিয়মিত মনিটরিং করার জন্য উপজেলা শিক্ষা অফিসার ও সহকারী শিক্ষা অফিসারদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

*লেখক: মেহেদি জামান লিজন, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ