রাসেলের ‘পথকলি’ নরসিংদী শহরে পথশিশুদের আনন্দের ঠিকানা
নরসিংদী রেলস্টেশন ও নরসিংদী সরকারি কলেজের মাঝখানে সম্প্রতি গড়ে তোলা হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু উদ্যান’। উন্মুক্ত এই উদ্যান সাজানো হয়েছে নানা ধরনের গাছ ও বাচ্চাদের খেলাধুলার বিভিন্ন উপকরণ দিয়ে। পাশাপাশি রয়েছে সুদৃশ্য বেঞ্চও। ফলে, সকাল থেকে রাত পর্যন্ত নানা বয়স ও পেশার মানুষের আড্ডামুখর উপস্থিতি লেগেই থাকে এখানে। সারা দিনই বাচ্চারা মত্ত থাকে খেলাধুলায়। কিন্তু এই চিত্র সম্পূর্ণ পাল্টে যায় সপ্তাহের শুক্র ও শনিবার। শুক্রবার সকাল থেকে দল বেঁধে আসতে শুরু করে সারা শহরের পথশিশুরা। কেউ খালি গায়ে, কেউ ছেঁড়া জামা-প্যান্ট গায়ে চাপিয়ে।
উদ্যানের সবুজ ঘাসে বসেই সকালের হালকা নাশতা সেরে ফেলে সবাই। তারপর শুরু হয় মূল কাজ। কোনো এক মহৎ কদমগাছের নিচে বোর্ড আর মার্কার হাতে দাঁড়িয়ে পড়েন শিক্ষক। বর্ণপরিচয় থেকে শুরু করে জীবনের গভীরে প্রবেশ করতে চান গল্পের ছলে। বাচ্চাদের চোখে-মুখে যেন স্বপ্নের বীজ বুনে দেন। বাচ্চারাও তাদের করুণ বাস্তবতা থেকে ডুব দেয় আনন্দ আর স্বপ্নিল জীবনের ভেতর। দুপুরের খাবারও উদ্যানেই ব্যবস্থা করা থাকে। খাওয়াদাওয়ার পর নির্দিষ্ট সময় বিরতি এবং তারপর আবার পাঠকার্যক্রমে ফিরে আসে তারা। পাঠের ভেতর কাটিয়ে দেয় সারা বিকেল। দিনভর আনন্দ আর অর্জিত অক্ষরজ্ঞান পকেটে পুরে সন্ধ্যার আগমুহূর্তে তারা ফিরে যায় নিজ নিজ গন্তব্যে। পরদিন শনিবার, আবার সকাল থেকে শুরু, সন্ধ্যা পর্যন্ত রুটিনওয়ার্ক, শিশুদের কলরবে মুখরিত উদ্যানের পরিমণ্ডল। শুক্র-শনিবার ছাড়াও সপ্তাহের বাকি দিনগুলোয় বিকেলবেলা চলে পাঠদান কার্যক্রম। পাঠকার্যক্রমের মূল অংশে থাকে বাংলা, অঙ্ক, ইংরেজি ও ধর্মশিক্ষার মতো বিষয়।
নরসিংদী শহরের পরিচিত এসব দৃশ্যে পথশিশুদের মধ্যে প্রতিনিয়ত দেখা যায় একজনকে। তিনি আবদুল্লাহ আল মামুন রাসেল। ব্যাংকার আবদুল্লাহ আল মামুন ১০ বছর ধরে মেতে আছেন এই পথশিশুদের নিয়ে। তাঁর এই আয়োজনের নাম দিয়েছেন ‘পথকলি’। নিজের খরচে, নিজের প্রত্যক্ষ শ্রমে শিশুদের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎকে কিছুটা হলেও ত্বরান্বিত করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। সকালের নাশতা, দুপুরের খাবার, বাচ্চাদের খাতা-কলম, শিক্ষকদের সম্মানীসহ সব খরচ বহন করছেন একা। নিজের বেতনের একটা নির্দিষ্ট অংশ তিনি জমিয়ে রাখেন ‘পথকলি’র জন্য। তবে কেউ স্বপ্রণোদিত হয়ে বাচ্চাদের কিছু দিতে চাইলে তা-ও তিনি গ্রহণ করেন। প্রায়ই তিনি নিজেই বাচ্চাদের পড়িয়ে থাকেন। আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘আমার মূল লক্ষ্য হচ্ছে তাদের অক্ষরজ্ঞান দেওয়া। পাশাপাশি তারা যেন নিজেদের অধিকার সম্পর্কে জানতে পারে। অন্যান্য স্বাভাবিক বাচ্চার চেয়ে নিজেদের দুর্বল না ভাবে। একদিন ওরা যেন সমাজের বোঝা না হয়।’
২০১১ সালে ১২ জন পথশিশু নিয়ে যাত্রা করলেও বর্তমানে ‘পথকলি’র শিশুর সংখ্যা প্রায় ৬০। তবে ৪০ থেকে ৪৫ জন নিয়মিত আসা-যাওয়া করে। এদের কারও কারও মা–বাবা নেই, কারও পরিবারের অবস্থা সংকটাপন্ন। কেউ আবার স্টেশনেই রাত কাটায়। বেশির ভাগই ৫ থেকে ১০ বছর বয়সী। অক্ষরজ্ঞান আয়ত্তে এলে তাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করা হবে। ইয়াসিন, কালো, সুজন, রুমা, শান্তারা একদিন বিদ্যালয়ে পা রাখবে, সমাজের অন্য সব শিশুর মতো করে পৃথিবীটাকে দেখবে—এমনটাই প্রত্যাশা আবদুল্লাহ আল মামুন রাসেলের। ‘পথকলি’ নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কেও বলেন তিনি, ওদের জন্য স্থায়ী একটি ব্যবস্থা করতে চাই। খাওয়াদাওয়া আর কাপড়-চোপড়ের জন্য যাতে তাদের জীবন থেমে না থাকে, এমন একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান গড়তে চাই, যেন আমি না থাকলেও ওদের সমস্যা না হয়। এ লক্ষ্যে কাজও করছি।
আবদুল্লাহ আল মামুনের এই বিশাল কর্মযজ্ঞের সবচেয়ে চমৎকার দৃশ্যটি ধরা পড়ে গত ঈদের আগে। নতুন কাপড় কিনে দেওয়া হয় সবাইকে। নতুন কাপড়ের রং, মাঠের সবুজ ঘাস আর শিশুদের হাসিমুখ যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। নতুন কাপড় পেয়ে বাচ্চাদের মুখে যে হাসি ফুটে ওঠে, তা দেখতে কার না ভালো লাগে?