রাজনীতিতে মিথ্যাচার

রাজনীতি

মার্কিন অভিনেতা জন ট্রাভল্টা অভিনীত ‘প্রাইমারি কালারস’ নামে একটি চলচ্চিত্র মুক্তি পেয়েছিল ১৯৯৮ সালে। রাজনীতিবিষয়ক এ চলচ্চিত্রে বিল ক্লিনটনের কাল্পনিক চরিত্র জ্যাক স্ট্যান্টনের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন জন ট্রাভল্টা। চলচ্চিত্রটির কাহিনিতে দেখা যায় মিথ্যা দিয়ে একটি মৃত্যুকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা। আর অনাকাঙ্ক্ষিত এ ঘটনায় এক রাজনৈতিক কর্মীর মনে রাজনীতি নিয়ে উচ্চতর ধারণা ছিল, তার সমাপ্তি ঘটে। তখন বিল ক্লিনটনের কাল্পনিক চরিত্র জ্যাক স্ট্যান্টন সেই কর্মীকে উপদেশ দিতে গিয়ে যা বলে, তার যথার্থ সারমর্ম হলো: রাজনৈতিক নেতা হতে হলে মিথ্যা বলতে হয়। আর নেতা হওয়ার পর মানুষের জন্য ভালো কাজ করা যায়। তখন সেই মিথ্যার প্রায়শ্চিত্ত হয়ে যায়। চলচ্চিত্রের দেওয়া ওই উপদেশমূলক কথাগুলোর একটির সঙ্গে বাস্তবতার মিল রয়েছে। সেটি হচ্ছে বাস্তবেও রাজনৈতিক নেতারা মিথ্যা বলেন।

রাজনীতি

সাধারণ জনগণ যাঁরা সক্রিয় রাজনীতির বাইরে অবস্থান করেন কিন্তু রাজনীতির খোঁজখবর রাখেন, তাঁদের সবাই এ জিনিস প্রত্যক্ষ করে থাকেন। রাজনীতিবিদেরা রাজনীতির খাতিরে অনেক মিথ্যা কথা বলে থাকেন। রাজনীতিতে এ মিথ্যাচারিতা কি কেবল উপরিউক্ত চলচ্চিত্রে উল্লেখিত কারণে কি না জানি না, কিন্তু বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় রাজনীতিতে এ মিথ্যাচারের নজির রয়েছে এবং তা বেশ অতীত থেকেই ঘটে আসছে। বিষয়টা এখন এ রকম যে রাজনীতি করতে হলে মিথ্যা বলতে হয়। এটি অনেকটা স্বাভাবিক ব্যাপার এবং বেশ পুরোনো রাজনৈতিক কৌশল।

২.

‘বিগ লাই থিওরি’-র সঙ্গে আমরা অনেকেই হয়তো পরিচিত। এটিকে অনেকে প্রোপাগান্ডা থিওরিও বলে থাকেন। এর মানে হচ্ছে একটা মিথ্যাকে যদি বারবার ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয়, তখন সেটি সত্যের মতো শোনায় এবং মানুষ আর আসল সত্যটা খুঁজে পায় না। এর কাজ হচ্ছে সত্যকে মিথ্যা আর মিথ্যাকে সত্য বলে চালিয়ে দেওয়া অথবা সত্যের সঙ্গে মিথ্যা কিংবা মিথ্যার সঙ্গে সত্যকে মিশ্রিত করে ফেলে সত্যকে আর ‘সত্য’ না রাখা। সত্যকে বদলে ফেলা।

সাম্প্রতিক ইতিহাসে বিগ লাইয়ের ব্যবহার আমরা দেখেছি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এর ব্যবহার স্বৈরাচারী শাসনের সঙ্গে জড়িত সরকার—যেমন অতীতে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং রাশিয়া, চীন, হিটলারের জার্মান ও উত্তর কোরিয়া—যা তাদের সরকার নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার করে মিডিয়া ও অন্যান্য উপায়ে মিথ্যা আখ্যানকে পুনরাবৃত্তিমূলক ভিত্তিতে উপস্থাপন করার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। বিগ লাই থিওরির কথা ইদানীং আবার বেশ শোনা যাচ্ছে। এখন এটি কেবল স্বৈরশাসকেরা ব্যবহার করে থাকেন তা নয়, অনেক গণতান্ত্রিক দেশেও রাজনীতিবিদেরা এটি ব্যবহার করে থাকেন। আমেরিকার কথাই ধরি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় ডোনাল্ড ট্রাম্পের কারণে বিগ লাই থিওরি আবার আলোচনায় এসেছে। ট্রাম্প তাঁর মেয়াদের পুরোটা সময় মিথ্যাকে একটি ‘অস্ত্র’ হিসেবে ব্যবহার করেছেন। তিনি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে মিথ্যা অপবাদ দিয়েছেন। এমনকি সংবাদমাধ্যমকে দিয়েছেন ‘ফেক নিউজ’-এর তকমা। প্রেসিডেন্ট থাকার সময় করোনা নিয়ন্ত্রণে আছে বলে মিথ্যা দাবি করেছিলেন। তাঁর মিথ্যা দাবির পর যুক্তরাষ্ট্রে লাখ লাখ মানুষ এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।

সর্বশেষ প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে ট্রাম্প মিথ্যার সীমা ছাড়িয়ে গেছেন। নির্বাচনে কারচুপি-জালিয়াতির মিথ্যা অভিযোগ তুলে তিনি নিজেকে জয়ী দাবি করেছেন। আর এই মিথ্যা দিয়ে তিনি তাঁর সমর্থকদের উসকে দিয়ে ক্যাপিটল ভবনে রক্তক্ষয়ী হামলার কারিগর হিসেবে কাজ করেন।

রাজনীতি

গণতান্ত্রিক আরেক দেশ ব্রিটেনেও রাজনৈতিক মিথ্যাচারের ঘটনার নজির রয়েছে। এই তো বেশি আগের ঘটনা নয়; ব্রেক্সিটের পক্ষের নেতারা গণভোটের আগে ফলাও করে বলেছিলেন, ব্রেক্সিট হলে সপ্তাহে ৩৫০ মিলিয়ন পাউন্ড যুক্তরাজ্যের গচ্চা কমে যাবে। সব মানুষ হয়তো সেটা বিশ্বাস করেননি। কিন্তু তবু তাঁরা এই ক্যাম্পেইনের পক্ষে ভোট দিয়েছেন। যদিও এখন ওই সব নেতা স্বীকারও করছেন, তাঁরা মিথ্যা বলেছিলেন। বরিস জনসন তো বলেছেনই, এটি একটি ভুল ছিল।

বিশ্বের রাজনীতিবিদেরা এই তত্ত্বের ওপর কৃতজ্ঞ থাকবেন যুগে যুগে। ইতিহাসে অনেকের ক্ষমতায় আসা, অনেকের ক্ষমতাচ্যুত হওয়া কিংবা ক্ষমতায় দীর্ঘদিন থাকা—এ ফর্মুলাকেই ব্যবহার করে।

৩.

নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি (১৪৬৯-১৫২৭) ছিলেন রেনেসাঁ বা ইউরোপীয় নবজাগরণ যুগের একজন রাজনৈতিক দার্শনিক, সংগীতকার, কবি ও রোমান্টিক কমেডি ধাঁচের নাট্যকার। ইতালীয় রেনেসাঁর অন্যতম পুরোধা এবং রেনেসাঁকালীন রাজনৈতিক পরিবর্তনের রূপকার। তিনি ১৫৩২ সালে ‘দ্য প্রিন্স’ নামে একটি বই লিখেছিলেন। এটি তাঁর সবচেয়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী ও বহুলপঠিত গ্রন্থ। অনেকে মনে করেন, ম্যাকিয়াভেলি এ বই লিখেছিলেন ফ্লোরেন্সের তৎকালীন রাজা পিয়ারো ডি মেডিচির ছেলে প্রিন্স লরেঞ্জোর প্রতি উপদেশমূলক গ্রন্থ হিসেবে। লরেঞ্জো যদিও সেই সময় এ উপদেশ গ্রহণ করেননি; কিন্তু পরবর্তী সময় দুনিয়ায় যত স্বৈরশাসক ও ডিক্টেটর এসেছেন, তাঁরা সবাই ‘দ্য প্রিন্স’কে মূল উপজীব্য হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। এ কথা সুবিদিত যে মুসোলিনি ‘দ্য প্রিন্স’-এর এক সংস্করণে ভূমিকা পর্যন্ত লিখেছিলেন। হিটলার তাঁর শয্যাপাশে সব সময় ‘দ্য প্রিন্স’ রাখতেন বলে শোনা যায়। নৈতিকতার স্থান না রেখেই কীভাবে রাজনীতিকে জনকল্যাণমুখী করা যায়, তা নিয়ে লেখা ‘দ্য প্রিন্স’ বইটি।

ম্যাকিয়াভেলি তাঁর এই অমর কীর্তি ‘দ্য প্রিন্স’-এর জন্য খ্যাতি-কুখ্যাতি, আলোচনা-সমালোচনা সবই পেয়েছেন। বইটিতে তাঁর রাজনৈতিক ফায়দাবিষয়ক তত্ত্বটি বহুল আলোচিত ও সমালোচিত, যে তত্ত্বে তিনি বলেছেন, সামষ্টিক ভালোর জন্য কোনো কাজ করতে গেলে নৈতিক-অনৈতিক বিবেচনার প্রয়োজন নেই।

ম্যাকিয়াভেলি বলেছেন, রাজনীতিবিদদের নৈতিকতা বলতে কিছু থাকার প্রয়োজন নেই; বরং তাঁদের প্রধান কাজ হবে জনগণের নিরাপত্তা ঠিক রাখা এবং জনকল্যাণমূলক কাজ করা। এ কল্যাণসাধনে রাজনীতিবিদের যদি কোনো অনৈতিক পন্থাও অবলম্বন করতে হয়, তা-ও তিনি করবেন তাঁর জনগণের ভালোর জন্য। কেননা, ম্যাকিয়াভেলির কাছে পন্থার চেয়ে ফলাফল অধিক গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের ব্যক্তিগত নৈতিকতা তাদের দেশের ‘অনৈতিক’ উপায়ে নিশ্চিত করা নিরাপত্তার ওপরই নির্ভর করে। তবে তাঁর মতে, অনৈতিক পন্থায় কেবল তখনই যেতে হবে, যখন তা সামগ্রিক ভালোর জন্য প্রয়োজন।

আরেক দার্শনিক প্লেটোও কিন্তু এ রকমই মনে করতেন। প্লেটোর মতে, ‘মহৎ ও সৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ হলে মিথ্যা বলা যায়। প্লেটো বিশ্বাস করতেন, যাঁরা দেশ চালাবেন, তাঁরা দেশ চালানোর স্বার্থে দু-চারটা মিথ্যা কথা বলতেই পারেন। এই মিথ্যা বলায় যদি দেশ ও দশের ভালো হয়, তাহলে সেই মিথ্যা বলায় কোনো অপরাধ নেই।

ধরে নিলাম, ম্যাকিয়াভেলি বা প্লেটোর এ উপদেশ অনেক রাজনীতিবিদ মেনে চলছেন, সেই পুরোনো সময় থেকে আজ অবদি। আর সে কারণে মনে হয় তাঁরা মিথ্যাও বলেন অনায়াসে। অনেক সময় মনে মনে যেটা বিশ্বাস করেন, প্রকাশ্যে সেটির উল্টোও বলে থাকেন। অনেকে অনৈতিক পন্থা অনুসরণ করে তারা রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষমতায় বসেন ও থাকতে চান। কিন্তু তারা হয়তো ভুলে যান, প্লেটো কিংবা ম্যাকিয়াভেলি কেবল নোবেল লাই বা মহৎ মিথ্যার কথা বলেছেন। কিন্তু রাজনীতিবিদদের সব মিথ্যাই কি মহৎ? এর উত্তর আমরা সবাই জানি।

জনগণ কখনোই আশা করে না রাজনীতিবিদেরা একদম সম্পূর্ণরূপে নিষ্কলঙ্ক ও উত্তম গুণাবলির অধিকারী হবেন। সত্যবাদী হবেন, সেটাও আশা করে না। কিন্তু তাই বলে তাঁদের কাছ থকে নির্জলা কিংবা ডাহা মিথ্যাও কি তারা আশা করে? রাজনীতিবিদেরা হয়তো ভাবতে পারেন, ভুয়া খবরের যুগে জনগণ সচেতন থেকে সত্য-মিথ্যার পার্থক্য আর কতটুকুই বুঝতে পারবে। কিন্তু এ রকম ভাবার মধ্যে ঝুঁকি আছে। ইন্টারনেট আর তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগে সত্য-মিথ্যা যাচাই করাও তাদের জন্য তেমন কঠিন কাজ নয়। আসলে সাময়িকভাবে হয়তো মানুষকে বোকা বানানো যায়; কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে তা কোনো কাজে আসে না, বরং ক্ষতির কারণ হয়। ইতিহাস কিন্তু সেটাই বলে।

শেষ করার আগে পিনোকিওর কথা মনে পড়ে গেল। ইতালিয়ান শিশুসাহিত্যিক কার্লো কলোডির লেখা রূপকথা ‘দ্য অ্যাডভেঞ্চারস অব পিনোকিও’। ১৮৮৩ সালে ‘দ্য টেইল অব আ পাপেট’ নামে এ বইটি প্রকাশিত হয়। ‘পিনোকিও’ গল্পে পিনোকিও মিথ্যা বললেই তার নাকটি লম্বা হয়ে যেত। বাস্তবে যদি মানুষের ক্ষেত্রে সত্যি সত্যি এ রকম ঘটত, তাহলে পৃথিবীতে লম্বা নাকওয়ালা রাজনীতিবিদের দেখা আমরা পেতাম।

* লেখক: ব্যাংকার