মাসুদ পারভেজ হয়ে গেলেন সোহেল রানা
মাসুদ পারভেজ বাবলু একজন ছাত্রনেতা এবং সম্মুখ সমরের মুক্তিযোদ্ধা। ইত্তেফাকের চিত্রালী পাতার লেখক মাসুদ পারভেজের লেখা চারটি বই বাজারে বিক্রি হতো। তত্কালীন ইকবাল হলের (বর্তমানে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ভিপি মাসুদ পারভেজ তাঁর আবেগ আর মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বন্ধুদের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে নির্মাণ করেন মুক্তিযুদ্ধের প্রথম ও পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র ‘ওরা ১১ জন’। চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত ‘ওরা ১১ জন’ ছবিটি প্রশংসা পেয়েছে অনেক। এরপর আগ্রহ থেকেই নির্মাণ করতে আগ্রহী হন কাজী আনোয়ার হোসেনের বিখ্যাত কাল্পনিক চরিত্র মাসুদ রানা সিরিজের ‘বিস্মরণ’ গল্প অবলম্বনে ‘মাসুদ রানা’ চলচ্চিত্র। কিন্তু নায়কসংকটে পড়ে সুমিতা দেবী আর আহমেদ জামান চৌধুরীর পরামর্শে নিজেই নায়ক হিসেবে ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে পড়েন। ‘মাসুদ রানা’ ছবিতে আমরা পেলাম পরিচালক মাসুদ পারভেজ এবং অ্যাকশন অ্যাম্পায়ার হিরো নায়ক সোহেল রানাকে। স্বাধীন বাংলাদেশে চলচ্চিত্র প্রযোজক মাসুদ পারভেজ হয়ে গেলেন নায়ক সোহেল রানা! মাসুদ পারভেজ সোহেল রানার পদাঙ্ক অনুসরণ করেই চলচ্চিত্র প্রযোজনায় আসেন তাঁর ছোট ভাই কামাল পারভেজ, আবার আরেক ছোট ভাই রুবেলও আসেন নায়ক হয়ে।
নায়ক রুবেল নায়ক হয়ে এসে আবার বড় ভাইয়ের মতো হয়ে ওঠেন সিনেমার প্রযোজক ও পরিচালক। নায়ক সোহেল রানা, নায়ক রুবেল, অভিনেতা ও প্রযোজক কামাল পারভেজ সবাই সফল। প্রযোজক ও পরিচালক হিসেবে মাসুদ পারভেজ অনন্য ছিলেন। নতুন প্রতিভা চলচ্চিত্রে ব্রেক দেওয়ার জন্য মাসুদ পারভেজ ছিলেন অনন্য।
নায়ক সোহেল রানা
বাংলাদেশি সিনেমায় নায়ক হিসেবে ড্যাশিং হিরো সোহেল রানাকে নিয়ে নতুন করে বলার কিছুই নেই। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি থেকে আশির দশক পর্যন্ত তিনি সুপারস্টার ইমেজে ঢাকাই ছবিতে অভিনয় করেছেন। তাঁর মূল্যায়নও দর্শক করেছেন। তিনি দর্শকদের অগণিত সুপার হিট সিনেমা উপহার দিয়েছেন। নায়ক সোহেল রানা অভিনীত ও নিজ পরিচালনায় ‘মাসুদ রানা’, ‘এপার ওপার’, ‘গুনাহগার’, ‘জীবন নৌকা’, ‘নাগপূর্ণিমা’, ‘ঘেরাও’, ‘রিটার্ন টিকেট’, ‘ভালোবাসার মূল্য কত’, দেওয়ান নজরুল পরিচালিত ‘দোস্ত দুশমন’, ‘আসামী হাজির’, ‘ওস্তাদ-সাগরেদ’, ‘বারুদ’, ‘জনি’, ‘দোজখ’; সারথি পরিচালিত ‘দস্যু বনহুর’; এজে মিন্টু পরিচালিত ‘মিন্টু আমার নাম’, ‘চ্যালেঞ্জ’, ‘প্রতিহিংসা’, দেলোয়ার জাহান ঝন্টুর ‘সেলিম জাভেদ’, ‘আল হেলাল’; কামাল আহমেদের ‘দাতা হাতেম তাই’, ‘লালুভুলু’; দিলীপ বিশ্বাসের ‘জিঞ্জির’, ‘অস্বীকার’, ‘অজান্তে’, ‘মায়ের মর্যাদা’; শিবলী সাদিকের ‘তিনকন্যা’; বাবুল চৌধুরীর ‘মা’, কাজী হায়াতের ‘রাজবাড়ী’; ইকরাম বিজুর ‘স্ত্রী’, ‘মহারাজা’, ‘সুখ দুঃখের সাথী’; শহীদুল ইসলাম খোকনের ‘বীর পুরুষ’, ‘বজ্রমুষ্টি’, ‘লড়াকু’, ‘কমান্ডার’, ‘টপ রংবাজ’, ‘টাকা’; গাজী মাজহারুল আনোয়ারের ‘বিচারপতি’; চাষী নজরুল ইসলামের ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’, ‘বাসনা’; আবুল খায়ের বুলবুল পরিচালিত ‘আলী আসমা’, ‘হীরন পাশা’, ‘জারকা’; ফজল আহমেদ বেনজীরের ‘রাজা জনি’; কমল সরকারের ‘গোয়েন্দা’; মারুফ হোসেন মিলনের ‘মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা’; মনতাজুর রহমান আকবরের ‘ভয়ঙ্কর বিষু’; মাসুম পারভেজ রুবেলের ‘প্রবেশ নিষেধ’; মিজানুর রহমান খান দিপু পরিচালিত ‘মোঘলে আজম’; পিএ কাজলের ‘মুক্তি’; গাজী জাহাঙ্গীরের ‘রাজা সূর্য খাঁ’ প্রচণ্ড দর্শক নন্দিত হয়েছে। ড্যাশিং হিরো সোহেল রানা এ ছাড়া দুই শতাধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। অভিনয়ে তাঁর অবদানের জন্য তিনি তিনবার (দিলীপ বিশ্বাসের ‘অজান্তে’, মুহাম্মদ হান্নানের ‘সাহসী মানুষ চাই’) জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। পারভেজ ফিল্মসের কর্ণধার প্রযোজক ও পরিচালক মাসুদ পারভেজ (সোহেল রানা) ছিলেন অনন্য রুচির ধারক।
প্রযোজক-পরিবেশক সমিতির সাবেক এই সভাপতি বৈচিত্র্যময় কাজ করতে পছন্দ করতেন, হোক তা অভিনয়ে, সংগীতে, মারপিট দৃশ্য চিত্রায়নে, কাহিনি নির্বাচনে অথবা শিল্পী মনোনয়নে। তিনি ঢাকাই বাণিজ্যিক ধারার চলচ্চিত্রে কিছু অসাধারণ সিনেমা উপহার দিয়েছেন। মাসুদ পারভেজ সোহেল রানা এতটাই জনপ্রিয় ছিলেন যে সিনেমার পোস্টারে মাসুদ পারভেজ অথবা সোহেল রানা এই দুটি নামের যেকোনো একটি থাকলেই সেই ছবি দেখতে দর্শক সিনেমা হলে হুমড়ি খেয়ে পড়তেন। তাঁর নিত্যনতুন মারামারির কৌশল আর পর্দায় ব্যক্তিত্বসম্পন্ন উপস্থিতি দর্শকদের আন্দোলিত করেছে বহুবার। কী রোমান্টিক আর কী অ্যাকশন মুভি! সব ধরনের ছবিতেই ড্যাশিং হিরো সোহেল রানা ছিলেন সফল। তাঁর জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে পরিচালক খসরু নোমান নির্মাণ করেন ‘সোহেল রানা’ মুভিটি। বাংলাদেশে কোনো সিনেমার নায়কের নামে এই প্রথম বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র।
লেখক: চলচ্চিত্রের ভক্ত