মহামারি ও ভাষা বদলের গল্প

আমাদের দেশে বাংলা ভাষাকে মেরে ফেলার অপচেষ্টা থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল একুশে ফেব্রুয়ারি। আর ব্রিটেনে ইংরেজির পুনর্জন্ম হয়েছিল মহামারি প্লেগের কারণে। গত দুই সহস্রাব্দে পৃথিবীতে অনেকবারই মহামারি প্লেগ এসেছে। কিন্তু দুটো প্লেগ মহামারি ইতিহাসকে অনেকটাই বদলে দিয়েছিল। বিশেষ করে ইংল্যান্ডের। এই দুই মহামারির কারণে বদলেছে ইংল্যান্ডের ভাষা, সমাজ ও সংস্কৃতি। ইতিহাস মহামারি দুটোর নাম দিয়েছে: জাস্টিনিয়ান প্লেগ এবং ব্ল্যাক ডেথ।

জাস্টিনিয়ান প্লেগ এবং ওল্ড ইংলিশ

পঞ্চম শতাব্দীতে ব্রিটেন ছিল ক্রমশ দুর্বল হতে থাকা রোমান সাম্রাজ্যের একটি অচল প্রদেশ। ওই সময় ব্রিটেনের ভাষা ছিল ল্যাটিন (Latin), গলজাতি (Gaulish) এবং কেল্ট (Celtic) ভাষার সংমিশ্রণ। রোমান শাসনের পর ব্রিটেনে আসল বিভিন্ন জার্মানিক জনগোষ্ঠী। এরা মূলত ছিল অ্যাংলো-স্যাক্সন ও জুট জাতি। এ অ্যাংলো সাক্সন (Anglo Saxon) অভিবাসন চলেছিল পঞ্চম থেকে সপ্তম শতাব্দী পর্যন্ত। ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জে তাদের এ অভিবাসন এবং ক্ষমতার বিজয়কে ত্বরান্বিত করেছিল ছয় শতকের জাস্টিনিয়ান প্লেগ। ৫৪১ সালে মিসর থেকে শুরু হয় এই প্লেগের। পরবর্তীকালে বাইজেনটাইন সাম্রাজ্য এবং সেখান থেকে পুরো ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে এই প্লেগ। বাইজেনটাইন সাম্রাজ্যের সম্রাট জাস্টিনিয়ান ওই সময় রোমান সাম্রাজ্যের সঙ্গে বাইজেনটাইনকে একীভূত করার পরিকল্পনা করছিলেন। মহামারির তাণ্ডবে তা আর হয়নি। এ সম্রাটের নাম থেকেই মহামারির নামকরণ হয়েছিল। একসময় এ রোগ ইউরোপ, এশিয়া, উত্তর আমেরিকা ও আরব অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। এ প্লেগের মূল বাহক ছিল ইঁদুর। বলা হয়ে থাকে, ভয়ংকর এ মহামারিতে প্রায় পাঁচ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। ওই সময় এই প্লেগে ব্রিটেনেও ব্যাপক প্রাণহানি ঘটেছিল। যাঁরা মারা গিয়েছিলেন, তাঁদের অধিকাংশই ছিলেন স্থানীয় লোক। আর এই কারণেই অ্যাংলো সাক্সনেরা সুযোগ পেল তাদের এই দ্বীপপুঞ্জে তাদের উপনিবেশকে শক্তিশালী করার। সেই সঙ্গে তাদের ভাষাকেও। ইতিমধ্যে রোম সাম্রাজ্যের পতনের ফলে ব্রিটেনে এমনিতেই ল্যাটিন ভাষার প্রভাব কমে এসেছিল। আর এই সময় জাস্টিনিয়ান প্লেগ এসে তাদের জন্য কাজটা সহজ করে দিল। আর তাই ছয় শতকের শেষের দিকে ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের প্রধান ভাষা হয়ে গেল অ্যাংলো সাক্সন ইংলিশ। দেখা গেল, ব্রিটেনের অভিজাত শ্রেণিতে আর ল্যাটিন ভাষী কেউ রইল না। আর সাধারণ প্রজা হিসেবে রয়ে গেল কেল্টরা। এ অ্যাংলো সাক্সন ইংলিশ এখনকার ইংরেজির চেয়ে অনেক আলাদা ছিল। আমরা অনেকেই এর নাম জানি ‘ওল্ড ইংলিশ’ হিসেবে। এই ‘ওল্ড ইংলিশ (Old English)’ প্রায় পরবর্তী চার শ বছর ব্রিটেনের প্রধান ভাষা হয়েই রইল।

নর্মানরা নিয়ে এল ফরাসি ভাষা

১০৬৬ সালে ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জে হামলা করে নর্মানরা অ্যাংলো স্যাক্সন রাজা হ্যারল্ড গডউইনসকে হেস্টিংসের যুদ্ধে পরাজিত করে। ওই সময় নর্মান রাজা ছিলেন উইলিয়াম দি কনকোয়ারার। যুদ্ধে জয়ী হয়ে ইংল্যান্ডের সিংহাসনে বসলেন তিনি। পরবর্তীকালে তিনি ইংল্যান্ডে ফরাসি নর্মান আভিজাত্য প্রতিষ্ঠা করলেন। তিনি তাঁর সমর্থকদের মধ্যে জমি এবং বিভিন্ন রাজকীয় উপাধি ভাগ করে দিলেন। তাঁর এই ব্যবস্থা তখন সমাজে অভিজাত এবং কৃষক—এই দুই শ্রেণির সৃষ্টি করে। এ সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রধান হিসেবে রাজা উইলিয়াম প্রথম ছিলেন বিশাল পরিমাণ ভূসম্পত্তির মালিক। কিন্তু রাজ্য চালাতে তো খালি ভূসম্পত্তি থাকলে চলবে না। দরকার অর্থ, খাদ্য এবং সেনাবাহিনী। তাই তিনি তাঁর এসব বিশাল ভূসম্পত্তি খণ্ডে খণ্ডে বিভক্ত করে বৃহৎ ভূস্বামীরা যেমন ব্যারনস, নাইটস—এঁদের অধীনে দিয়ে দেন। আর এঁদের অধীনে অগণিত কৃষককুল জমি চাষাবাদ করে যে ফসল পেত, তার অধিকাংশই দিয়ে দিত এসব ভূস্বামীকে। ফলে এসব ভূস্বামীর কাছ থেকে রাজা উইলিয়াম পেতেন কর আর সেনাবাহিনীর নিশ্চয়তা। এসব ভূস্বামী ও পেতেন সমাজের অভিজাত শ্রেণির মর্যাদা। এ ফরাসি আভিজাতেরা একে অপরের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সমাজের মধ্যে একটি বিচ্ছিন্ন আলাদা অভিজাত শ্রেণি হিসেবে বসবাস করতে লাগলেন। আর সেই সঙ্গে তাঁদের ভাষা ফরাসিও হয়ে গেল গুরুত্বপূর্ণ ভাষা। প্রশাসন ও বিচার বিভাগে ইংরেজি বদলে আমদানি হলো ফরাসি ভাষার। আর ইংরেজি তখন গুরুত্ব হারিয়ে হয়ে গেল দ্বিতীয় শ্রেণির ভাষা।

বিউবনিক প্লেগ আবার এল

এল চতুর্দশ শতাব্দী। সেবার চীনে প্রথম দেখা দিল ‘বিউবনিক প্লেগ’। ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ংকর এ মহামারি ‘ব্ল্যাক ডেথ’ নামে সমধিক পরিচিত। ধারণা করা হয়, সারা পৃথিবীতে ৭৫ থেকে ২০০ মিলিয়ন মানুষ এ মহামারির সময় মারা গিয়েছিল। সংক্রমিত মানুষের প্রায় ৫০ শতাংশই মারা গিয়েছিল তখন। এ মহামারির জীবাণুটি ইঁদুর ও একধরনের মাছির মাধ্যমে ছড়িয়েছিল প্রথমে। উপসর্গ ছিল জ্বর, বিষফোড়া, রক্তবমি ও নিউমোনিয়া। একটি কাকতালীয় বিষয় হলো, এ মহামারির শুরুর দিকের আক্রান্তদের ৮০ ভাগই ছিল হুবেই প্রদেশের। আর সেই হুবেই প্রদেশের একটি শহর ছিল উচাং, যা বর্তমানে হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহানের একটি অংশ। আর এই উহানকেই বর্তমান কোভিড-১৯ মহামারির জন্মস্থান বলা হচ্ছে।

সিল্করোড

ওই সময় ইউরোপ আর এশিয়ার বিভিন্ন দেশের মধ্যে বাণিজ্য চলত ‘সিল্ক রোড’ দিয়ে। এই ‘সিল্ক রোড’ বা রেশম পথ ছিল কতগুলো পাহাড়, জঙ্গল, নদী পেরিয়ে যাওয়া রাস্তার সমষ্টি। প্রায় ৪০০০ মাইল (৬৫০০ কিলোমিটার) দীর্ঘ এ পথের নামকরণ করা হয়েছিল চীনা সিল্ক ব্যবসার নামে, যা হান রাজত্বকালে শুরু হয়েছিল। যদিও সিল্কই ছিল প্রধান পণ্য, অন্যান্য নানা পণ্যও এই পথে আনা-নেওয়া করা হতো। বলা যায়, তৎকালীন সময়ের একটি প্রধান বাণিজ্যিক রুট ছিল এটি।

লন্ডনে থেকে শুরু

এ রেশম পথ দিয়েই মধ্য এশিয়া ও ভারতীয় উপমহাদেশ পাড়ি দিয়ে ১৩৪৭ সালে প্রথমে ইতালির সিসিলিতে গেল এ রোগ। সেখান থেকে ভেনিস আর মার্সেই হয়ে ধীরে ধীরে সমগ্র ইউরোপে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল এটি। এ একই রেশম পথ দিয়েই একজন নাবিক রোগ নিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিম ইংল্যান্ডের ডরসেট কাউন্টির ওয়েইববমাউথ শহরে হাজির হলেন ১৩৪৮ সালের কোনো একদিন। সেই বছরই শরৎকালের মধ্যে লন্ডনে আবির্ভাব হলো মহামারিটির। রাজা এডওয়ার্ড তৃতীয় ইংল্যান্ডের রাজা ছিলেন তখন এডওয়ার্ড তৃতীয়। মহামারির শুরুর দিকে তাঁর আচরণ ছিল অনেকটা এ সময়ের করোনা মহামারির শুরুর দিকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের আচরণের মতো। মহামারিকে মোটেই পাত্তা দেননি প্রথমে; বরং ওই সময় উইন্ডসর ক্যাসেলসহ আরও অন্যান্য জায়গায় নাইটদের নিয়ে বিভিন্ন রাজকীয় টুর্নামেন্ট আয়োজনের দিকেই তাঁর মনোযোগ ছিল বেশি। তাঁর এসব আয়োজনে থাকত নাইটদের মধ্যে ঘোড়ায় চড়ে যুদ্ধ, রাজকীয় ভোজ, নাচসহ আরও নানা আয়োজন। এসব অনুষ্ঠানে মানুষের কাছাকাছি সংস্পর্শের ফলে রোগ সংক্রমণের ঝুঁকিও বাড়ছিল ক্রমশ। তাঁর অনেক রাজকীয় পরামর্শদাতা যদিও তাঁকে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিতে বলেছিলেন। তাঁদের সতর্কবার্তাতে কিন্তু তিনি তেমন কর্ণপাত করেননি। ঠিক এ সময় তাঁর ১৪ বছরের কন্যা রাজকুমারী জউন মারা গেলেন এ প্লেগে। তিনি স্পেনে যাচ্ছিলেন তখন পেডরো অব ক্যাসটিওলের ক্রাউন প্রিন্সকে বিয়ে করার জন্য। আর যাত্রাপথে এ রোগে আক্রান্ত হন। আর তাঁর মৃত্যুতেই রাজা এডওয়ার্ড তৃতীয় রোগটির ভয়াবহতা উপলব্ধি করলেন এবং বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে শুরু করলেন।

ইংরেজি আবার গুরুত্বপূর্ণ হতে লাগল

১৩৪৯ সালের গ্রীষ্মের মধ্যে সারা ইংল্যান্ডে ছড়িয়ে পড়ল মহামারিটি। হাজারো মানুষ মরতে শুরু করল। ওই সময় সমাজে চার্চের যাজকদের গুরুত্ব ছিল অনেক বেশি। কেউ অসুস্থ হলেই তাঁদের ডাক পড়ে, প্লেগের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হলো না। মরণাপন্ন হলেও সাধারণ মানুষ যাজকদেরই শরণাপন্ন হতেন। আর মারা যাওয়ার পর শেষকৃত্যও তাঁদেরই দায়িত্ব। অতএব দেখা গেল, ইংল্যান্ডের গোটা যাজক সম্প্রদায়ের বেশির ভাগই এই নতুন সংক্রামক রোগের কবলে পড়ছেন এবং মারা যাচ্ছেন। শুধু ধর্মযাজকেরা নন, অনেক অভিজাত সমাজের বহু সদস্যও মারা যাচ্ছিলেন। এমনও ঘটল যে কোনো কোনো ধনী পরিবারের সব সদস্যকেও নিয়ে নিল প্লেগ। নতুন রোগের সঙ্গে বুঝে ওঠা গেল না কিছুতেই। একসময় কাউকেই ছাড়ল না রোগটি। কৃষক, শ্রমিক, ভূমিদাসেরাসহ সমাজের সব শ্রেণির মানুষও মরতে শুরু করল সমানে। পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত যত মহামারি এসেছে, তা নিজেই একসময় শক্তি হারিয়ে ফেলে। বিউবনিক প্লেগও এর ব্যতিক্রম ছিল না। ইংল্যান্ডেও একসময় আস্তে আস্তে ঝিমিয়ে পড়ল বিউবনিক প্লেগ। কিন্তু তত দিনে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের সংখ্যা অনেকটা কমে গিয়েছিল। তাতে সৃষ্টি হলো বিভিন্ন সংকটের। যেমন যাজক সমাজের কথাই ধরি। বহুসংখ্যক যাজক মরে যাওয়ায় সবচেয়ে সংকট দেখা দিল যাজক সমাজে। ফলে চার্চের জন্য ল্যাটিন না জানা স্থানীয় লোকদের যাজক করা হলো। ধর্মীয় উপাসনা এবং সামাজিক অনুষ্ঠান—সবই ধীরে ধীরে শুরু হতে শুরু করল স্থানীয় ইংরেজি ভাষায়। অভিজাত সমাজেও একই সমস্যা হলো। এখানে উল্লেখ্য, যেহেতু নর্মান রাজারা তখন ইংল্যান্ড শাসন করতেন, তাই অভিজাত সমাজের ভাষা ছিল ফরাসি। ফরাসি মানে নর্মান ফ্রেঞ্চ। রাজভাষাও ওই সময় ছিল এটি। তাই সমাজের অভিজাতদের সেই ভাষা শিখতে হতো। প্লেগের পরে তাঁদের সংখ্যা যেমন কমে গেল, তেমনি কমতে লাগল তাঁদের ভাষার জৌলুশ। এদিকে গরিব চাষিদের একটি অংশ মারা গেলেও কেবল তাঁদের অংশটাই সবচেয়ে বেশি বেঁচে রইল। তাঁরা সারা বছরই কঠিন পরিশ্রমের কাজ করেন। তাই তাঁদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বেশি। দেখা গেল, তাঁদের মৃত্যুর হারও তাই অন্যদের তুলনায় কম। ফলে প্লেগ–পরবর্তী সময়ে দেখা গেল, তাঁরা শুধু সংখ্যায় বেশি রইলেন না, তাঁদের সামাজিক জোরও বেড়ে গেল। রাজকাজেও পড়ল তার প্রভাব। সবচেয়ে নাটকীয় যেটা ঘটল, তা হলো তাঁদের ভাষা ইংরেজি হঠাৎ করেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল গোটা সমাজে। শাসকের কাছেও। অভিজাত শ্রেণির কাছেও।

সামাজিক পরিবর্তন

শুধু ইংরেজির গুরুত্ব বেড়ে যাওয়া নয়, সেই সঙ্গে ব্রিটেনে আরও অনেক ধরনের পরিবর্তন করছিল এ মহামারি। সেখানকার মোট জনসংখ্যার তিন ভাগের এক ভাগই মারা গিয়েছিল তখন। তিন শ বছরের পুরোনো সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছিল অনেকটা। ক্যাথলিক চার্চের ওপর মানুষের অগাধ আস্থা আর বিশ্বাসে ধরেছিল ফাটল। ওই সময় জন উইক্লিফ নামের এক ধর্মযাজক পোপের কর্তৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুললেন এবং বাইবেলের শ্রেষ্ঠত্বের ওপর জোর দিলেন। তাঁর এ মতামতই মহামারির দুই শতাব্দী পরে ইংল্যান্ডে প্রটেস্ট্যান্ট সংস্কারের ভিত রচনা করেছিল। এ সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় অভিজাত শ্রেণির কেবল লাভই হচ্ছিল। কৃষক শ্রেণির অবস্থা ছিল দাসের মতো। তাঁদের যেকোনো কিছু করার আগে সামন্ত প্রভুদের অনুমতি নিতে হতো। বিউবনিক প্লেগ এ সমাজ ব্যবস্থায় ধীরে ধীরে নিয়ে আসছিল পরিবর্তন। শ্রমিকের সংখ্যাও কমে যাওয়ায় কাজের মজুরিও গেল বেড়ে। খাজনা ও কর গেল কমে। শ্রমিক আর ভূমিদাসেরা নিজেদের অনেকটাই গুরুত্বপূর্ণ ভাবতে শুরু করল। তারাও প্রথমবারের মতো নিজেদের মজুরি নিয়ে ও দর–কষাকষি করার সুযোগ পেল। অনেক মানুষ হতে শুরু করল শহরমুখী। সেই সঙ্গে আরও অনেক ধরনের পরিবর্তন হতে লাগল রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক জীবনে। ভূস্বামীরা কৃষক ও ভূমিদাসদের এসব মজুরি বৃদ্ধির বিষয়টিকে সহজভাবে মেনে নিতে পারছিলেন না। তাঁদের কাছে মনে হলো, বিষয়টি কৃষক শ্রেণির উথান এবং এত দিন ধরে চলে আসা নিয়মের বিরুদ্ধে তাঁদের অবাধ্য করে তুলবে। অভিজাত ভূস্বামীরা বিষয়টিকে নিগ্রহের চেষ্টা শুরু করলেন। আর তাই ১৩৪৯ সালে রাজা এডওয়ার্ড তৃতীয় প্লেগ–পূর্ব মজুরি স্থির রেখে অর্ডিন্যান্স অব লেবারারস নামে একটি অর্ডিন্যান্স জারি করলেন। পরবর্তীকালে ১৩৫১ সালে পার্লামেন্টও একে বৈধতা দিয়ে স্ট্যাটুট অব লেবারারাস নামে আইন পাস করল। এসব আইনের আওতায় খুবই নিষ্ঠুরভাবে বেশ কয়েক দশক ধরে চলল ভূমিদাসদের ওপর শোষণ।

ইংরেজি আবার হয়ে গেল প্রধান ভাষা

বিউবনিক প্লেগের গল্পে আবার আসি। ওই সময় প্লেগে ইংল্যান্ডের রানি ফিলিপ্পাও মারা গেলেন। প্রিয়তমা স্ত্রীকে হারিয়ে রাজা এডওয়ার্ড অনেকটাই ভেঙে পড়লেন। একদিকে স্ত্রী–কন্যা হারানোর শোক, অন্যদিকে রাজ্য ও নানা ধরনের পরিবর্তনের সম্মুখীন। প্লেগে মারা যাওয়ার কারণে ফরাসিভাষীর সংখ্যা গেল কমে। আর ইংলিশভাষী কৃষক আর অনভিজাত শ্রেণির প্রভাব বাড়তে লাগল সমাজে। এমতাবস্থায়, একদিন তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন ইংরেজিকে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে। তিনি ভাবলেন, ল্যাটিন আর ফরাসি বলা মানুষগুলোর জোরটাই যখন আর সমাজে নেই, তখন সেই শ্রেণির ভাষাই থেকে কী লাভ? ধর্ম আর রাজকাজে এরই মধ্যে ইংরেজি চালু হওয়ায় এমনিতেই তার প্রতিপত্তি বেড়ে গিয়েছিল। আর তাই ১৩৬২ সালে পার্লামেন্টে আইন পাসের মাধ্যমে নর্মান ফ্রেঞ্চকে বদলে ইংরেজিকে তিনি করে ফেললেন বিচার বিভাগের ভাষা। ওই সময় তিনি প্রথম নিজেও পার্লামেন্টে বক্তৃতা দিলেন, যা তিনি এত দিন এড়িয়ে গিয়েছিলেন। এভাবে ইংরেজি ভাষা আবারও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে শুরু করল ব্রিটেনে। কিন্তু এত দিনের প্রধান ভাষা ফরাসির প্রভাব সম্পূর্ণ এড়ানো গেল না। এই পুনরুজ্জীবিত ভাষাটির সঙ্গে ওল্ড ইংলিশের মিল থাকল না তেমন। এ নব্য ইংরেজি ভাষাতে ঢুকে পড়ল প্রচুর ফরাসি শব্দ। যেমন ‘Captain’, ‘Colonel’ , 'Lieutenant' , 'Sergeant', ‘Able’, ‘Car’, ‘Different’, ‘Fine’, ‘Journey’-র মতো যে শব্দগুলো আমরা প্রায়ই ব্যবহার করে থাকি, এসবই আসলে ফরাসি থেকে আগত, জন্ম সেই সময়ে। ‘Détente’ বা ‘Coup d’état’-এর মতো শব্দগুলো তো শুনলেই বোঝা যায় ফরাসি । আর এ নব্য ইংরেজির নাম হলো ‘মিডল ইংলিশ’।

ওই দিকে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক পরিবর্তনের কারণে অভিজাত ও কৃষক শ্রেণির মধ্যে ও বিভিন্ন ধরনের উত্তেজনা বাড়তে লাগল। সামাজিক পরিবর্তন দমিয়ে রাখার জন্য অভিজাতদের বিভিন্ন ষড়যন্ত্র কৃষক শ্রমিকদের মাঝে আরও অসন্তোষ বাড়িয়ে দিল। এর ফলে ১৩৮১ সালে ঘটল কৃষক বিদ্রোহ। আর তখন ইংল্যান্ডের রাজা ছিলেন রিচার্ড দ্বিতীয়। শেষ পর্যন্ত তিনি এই বিদ্রোহ থামিয়েছিলেন অদ্ভুত এক কৌশলে। সেটা হচ্ছে বিদ্রোহী চাষিদের সঙ্গে ইংরেজি ভাষায় বাক্য বিনিময় করেছিলেন তিনি। তাতেই কৃষকদের ক্ষোভ অনেকখানি প্রশমিত হয়ে যায়। যদিও রিচার্ড দ্বিতীয় বিদ্রোহ থামিয়েছিলেন, কিন্তু তত দিনে যে সামাজিক পরিবর্তন হয়েছিল, তা তিনি আর দমাতে পারেননি। ফলে ১৪০০ সালের মধ্যেই ভূমিদাসপ্রথা প্রায় বিলুপ্ত হয়ে ভাড়াটে জমির প্রথা চালু হয়। ওই সময় ফরাসিভাষী অভিজাত শ্রেণির বদলে ইংরেজিভাষী অভিজাত শ্রেণির মানুষগুলোর উথানের কারণে ইংরেজি সাহিত্যের ও প্রসার ঘটতে শুরু করে চাহিদার কারণে। ইংরেজি সাহিত্যের মধ্যযুগীয় দুই বিখ্যাত কবি জিওফ্রে চসার এবং জন গাওয়ার ওই সময়ে সাহিত্যচর্চা শুরু করেন। ‘The Canterbury Tales’ , ‘Piers Plowman’ এবং ‘Sir Gawain and the Green Knight’–এর মতো বিখ্যাত সাহিত্য ওই সময়ে রচিত হয়েছিল।

দ্বিতীয় রিচার্ডের পর ইংল্যান্ডের রাজা হলেন চতুর্থ হেনরি। তাঁর মাতৃভাষা ছিল ইংরেজি। এর পরের রাজা পঞ্চম হেনরি ইংরেজিতে চিঠিপত্রও লেখা শুরু করলেন। প্রায় দুই শ পরে, ১৬০৬ সালের ২৬ ডিসেম্বরে শেক্‌সপিয়ারের লেখা ইংরেজি নাটক ‘কিং লিয়র’ অভিনীত হলো রাজা প্রথম জেমসের সামনে। যাহোক, তত দিনে ইংরেজি হয়ে গেছে ইংল্যান্ডের প্রধান ভাষা। একসময় বাইবেলও অনূদিত হলো ইংরেজিতে। ১৬১১ সালে ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত হলো ‘কিং জেমস বাইবেল’। খ্রিষ্টান–অধ্যুষিত ইংল্যান্ডে এ বাইবেল ইংরেজি-বলা জগতের মূল চালিকাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হলো তখন। তিন শ বছর ধরে ধরে যে ভাষা সমাজে দ্বিতীয় শ্রেণির ভাষা হিসেবে ছিল, তার এত দ্রুত সমৃদ্ধি ঘটল যে ধর্মীয় গ্রন্থ বাইবেলও অনূদিত হয়ে গেল সেই ভাষায়। আর একসময় সেই ইংলিশও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হয়ে উঠল ‘মডার্ন ইংলিশ’। আর এভাবেই ব্ল্যাক ডেথ মহামারির কারণেই ইংরেজির আবার পুনরায় জন্ম হলো ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জে। মহামারি বদলে দিল ভাষাকে। প্রায় তিন শ বছর নর্মান রাজত্বের পরেও সাধারণ দ্বীপবাসীর কাছে ফরাসি বিদেশি ভাষা হয়েই থেকে গিয়েছিল। আর তাদেরকে মাতৃভাষা আবার পুনরুদ্ধারের সুযোগটা করে দিয়েছিল বিউবনিক প্লেগ।

  • লেখক: ব্যাংকার