মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের শান্তিচুক্তি ফিলিস্তিনের স্বপ্নভঙ্গ
ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলেও গত ৭২ বছরে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা অধরাই রয়ে গেছে। নিজ ভূখণ্ডে ফিলিস্তিনিরা এখনো পরাধীন হিসেবে বাস করছে। ১৯১৭ সালে বোলফোর ঘোষণার মাধ্যমে ১৯৪৮ সালের ১৪ মে মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোড়া বিশ্বের একমাত্র ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েল প্রতিষ্ঠিত হয়।
ইহুদিরা পৃথিবীতে নৃতাত্ত্বিক জাতি। পৃথিবীতে তাদের নিজস্ব কোনো আবাসভূমি ছিল না। সারা পৃথিবীতে শতাব্দীর পর শতাব্দী ছড়িয়ে–ছিটিয়ে বাস করত। ঊনবিংশ শতাব্দীতে অধিকাংশ ইহুদি বাস করত ইউরোপজুড়ে, বিশেষত জার্মান ও রুশ অঞ্চলে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত বর্তমান ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন অঞ্চল ছিল অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে। অটোমান বর্তমানে তুরস্কে। ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্ব যুদ্ধে তুরস্কের ওসমানীয় সাম্রাজ্যের পতন এবং মুসলিম খিলাফত ভেঙে যায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ বাহিনী ১৯১৭ সালে ইরাক, সিনাই উপত্যকা, ফিলিস্তিন ও পবিত্র জেরুজালেম দখল করে নেয়। অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর বর্তমান ইসরায়েল, ফিলিস্তিন, সিরিয়া, জর্ডান, লেবানন অঞ্চলগুলো ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের অধীনে চলে যায়।
১৯১৭ সালের ২ নভেম্বর তৎকালীন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার জেমস বেলফোর ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ইহুদিদের কাছে একটি চিঠি লেখেন। একে বেলফোর ঘোষণা বলা হয়। বেলফোর ঘোষণার মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইহুদিদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র গঠনের সম্ভাবনা দেখা দেয়। এই ঘোষণার ফলে ইহুদিরা দলে দলে ইউরোপ থেকে এসে ফিলিস্তিনে বসতি স্থাপন করতে শুরু করে। ১৯০৫ থেকে ১৯১৪ সাল পর্যন্ত কয়েক হাজার ইহুদি, ১৯১৪ থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত ২০ হাজারে, ১৯১৯ থেকে ১৯২৩ সালের মধ্যে ৩৫ হাজারে, ১৯৩১ সালে প্রায় পাঁচ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে ১ লাখ ৮৯ হাজারে উন্নীত এবং ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ৬ লাখ ইহুদি বসতি স্থাপন করে।
১৯৪৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ১৮১ নম্বর প্রস্তাবে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডকে দুই ভাগে ভাগ করা–সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। প্রস্তাবে ফিলিস্তিনের জন্য ৪৫ শতাংশ এবং ইসরায়েলের জন্য ৫৫ শতাংশ ভূমি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু আরব দেশগুলো মেনে নেয়নি। মার্কিনদের চাপ ও মুসলমানদের দুর্বলতার সুযোগে ১৯৪৮ সালের ১৪ মে ব্রিটিশ সরকার এক দিন আগেই আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিনের নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দেয়। ওই দিনই ইহুদি নেতারা ইসরায়েল রাষ্ট্রের ঘোষণা দেন। যুক্তরাষ্ট্র ওই দিনই ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়। আর সেদিন থেকেই ফিলিস্তিনের দুর্যোগ বা বিপর্যয় শুরু হয়। ফিলিস্তিনিরা এই দিনটিকে ‘নাকবা’ বা বিপর্যয়ের দিন হিসেবে পালন করে থাকে। পরদিনই আরব দেশগুলোর সঙ্গে ইসরায়েলের যুদ্ধ বেধে যায়। প্রস্তাবিত আরব রাষ্ট্রের একটা বড় অংশ দখল করে ইসরায়েল এবং সাড়ে ৭ লাখ ফিলিস্তিনি তাদের ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ হয়।
মধ্যপ্রাচ্যে ফিলিস্তিনকে কেন্দ্র করে ইসরায়েল ও আরবদের সঙ্গে চারটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। প্রতিটি যুদ্ধেই আরবরা পরাজিত হয়। ১৯৪৮ সালের ১৫ মে মিসর, সিরিয়া, জর্ডান, ইরাক ও লেবানন সম্মিলিতভাবে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। যুদ্ধে আরবরা পরাজিত হয়। ইসরায়েল জাতিসংঘ কর্তৃক ভূমির চেয়ে ২০ ভাগ ভূমি বেশি দখল করে সীমানা নির্ধারণ করে। ইহুদিদের কাছে ছিল এটি স্বাধীনতার যুদ্ধ। যুদ্ধে জয়ী হয়ে ইসরায়েল পশ্চিম জেরুজালেম দখল করে। জর্ডান পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেম নিজেদের মধ্যে রাখতে সক্ষম হয় আর গাজা ভূখণ্ড মিসর নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়। যুদ্ধে আরবদের উদ্দেশ্য ছিল ইহুদিদের উৎখাত করা আর ইহুদিদের উদ্দেশ্য ছিল নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা। মূলত আরব–ইসরায়েলের এই যুদ্ধই ছিল ফিলিস্তিনকে দুই ভাগ করে জাতিসংঘের বিভাজন প্রক্রিয়াকে স্বীকৃতি দেওয়া। যুদ্ধে আরও সাত লাখ ফিলিস্তিনি নিজেদের ঘরবাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়।
‘ইয়োম কিপুর’ যুদ্ধ
১৯৫৬ সালে সুয়েজ খালকে কেন্দ্র করে ইসরায়েলের সঙ্গে মিসরের যুদ্ধ হয়। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ব্রিটেন ফ্রান্স এবং ইসরায়েল পিছু হটতে বাধ্য হয়। কোনো মীমাংসা ছাড়াই সংকট শেষ হয়। ১৯৬৭ সালের ৬ থেকে ১০ জুন পর্যন্ত আরব বিশ্ব ও ইসরায়েলের মধ্যে ছয় দিন ধরে যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে ইহুদিরা জয়ী হয়। গাজা ও সিনাই উপদ্বীপ মিসরের কাছ থেকে তারা দখল করে নেয়, যা ১৯৪৮ সাল থেকে মিসরের নিয়ন্ত্রণে ছিল। পূর্ব জেরুজালেম ও পশ্চিম তীর জর্ডানের কাছ থেকে এবং গোলান মালভূমি সিরিয়ার কাছ থেকে দখল করে নেয়। এ যুদ্ধে আরও ৫ লাখ ফিলিস্তিনি নিজেদের ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ হয়। ১৯৭৩ সালে ঘটে চতুর্থ আরব–ইসরায়েল যুদ্ধ। এটি ‘ইয়োম কিপুর’ যুদ্ধ নামে পরিচিত। একপক্ষে মিসর ও সিরিয়া অন্যদিকে ছিল ইসরায়েল। মিসর সিনাই অঞ্চলের কিছু অংশ পুনরুদ্ধার করে, কিন্তু গাজা বা গোলান মালভূমি থেকে ইসরায়েলকে হটানো যায়নি।
১৯৭৩ সালের যুদ্ধের ছয় বছর পর ইসরায়েল ১৯৭৯ সালে আরব বিশ্বের প্রথম দেশ মিসরের সঙ্গে শান্তিচুক্তি করে। দুই দেশের মধ্যে শান্তিচুক্তি অর্থনৈতিক সহযোগিতামূলক হলেও পরে নিরাপত্তার বিষয়টিও চলে আসে। মিসরের শান্তিচুক্তির প্রায় ১৫ বছর আরব বিশ্বের দ্বিতীয় দেশ জর্ডান ১৯৯৪ সালে ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তিচুক্তি করে। কিন্তু দুটি দেশের সঙ্গে শান্তিচুক্তি করলেও ইসরায়েল মধ্যপ্রাচ্যে খুব একটা সুবিধা করতে পারছিল না। আরব বিশ্বের একাকিত্ব কাটছিল না। ইসরায়েল যুগের পর যুগ চেষ্টা করে আসছিল মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের। চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে তাদের সেই মাহেন্দ্রক্ষণটি আসে। জর্ডানের সঙ্গে চুক্তির দীর্ঘ ২৬ বছর পর ইসরায়েল উপসাগরীয় দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় হোয়াইট হাউসে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করে। শান্তিচুক্তি করার জন্য দুই দেশের ওপর সৌদি আরবেরও চাপ ছিল। শান্তিচুক্তির পর সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রতিনিধিদল আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরায়েল সফর করে। দুই দেশের মধ্যে ভিসামুক্ত ভ্রমণ, বিমান চলাচল, বিনিয়োগ, নিরাপত্তা, বিজ্ঞান প্রযুক্তিসহ বেশ কিছু চুক্তি স্বাক্ষর হয়। আরব বিশ্বের সৌদি আরব, ওমান, মরক্কো, কাতার ও সুদান ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য গোপনে যোগাযোগ করে যাচ্ছে। ইসরায়েল মধ্যপ্রাচ্যে নতুন নতুন দেশের সঙ্গে সম্পর্কের মাধ্যমে কোণঠাসা অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে।
উপসাগরীয় অঞ্চলে সংযুক্ত আরব আমিরাত বাণিজ্য, পর্যটন ও সামরিক খাতে বেশ শক্তিশালী। ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তিচুক্তির মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে উপসাগরীয় দেশগুলোকে তাদের নেতৃত্ব দেওয়ার খায়েশ হয়েছে। ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে মধ্যপ্রাচ্যে দুটি বলয় গড়ে উঠেছে। ইরান, সিরিয়া, ইরাক, লেবানন, তুরস্ক ও কিছু ক্ষেত্রে কাতারকে নিয়ে একটি শক্তি গড়ে উঠেছে। অন্যদিকে সৌদি আরবের নেতৃত্বে মিসর, জর্ডান, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন মিলে একটি বলয় গড়ে উঠেছে। মধ্যপ্রাচ্যে ইরান ও সৌদি আরবের দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিনের। মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের উত্থান উপসাগর থেকে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত পুরো অঞ্চলে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিতে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে সৌদি আরব, মিসর, জর্ডান ও ইসরায়েল। মধ্যপ্রাচ্যে ইরান ও সৌদি আরব একে অপরের চির শত্রু। তাদের প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে দুই দেশের মধ্যে বছরের পর বছর ধরে মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব চলে আসছে। ইরানের প্রভাব মোকাবিলা করতে বেশ কিছু মধ্যপন্থী সুন্নি আরব দেশের সঙ্গে ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠতা বাড়ছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো এখন নিজেদের স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়ে তাদের প্রভাবকে টিকিয়ে রাখতে চাচ্ছে। দেশগুলো আলাদাভাবে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। ১০ থেকে ১৫ বছর আগেও ফিলিস্তিন সংকটে মুসলিম বিশ্ব যেভাবে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলত, এখন কিছুটা হলেও কমে আসছে। এখন আর তাদের স্বাধীনতার জন্য মুসলিম বিশ্ব একযোগে কথা বলে না। মুসলিম বিশ্বের এই দুর্বলতার সুযোগটাই কাজে লাগাচ্ছে ইসরায়েল। ইসরায়েল এখন মধ্যপ্রাচ্যে অনেক কিছুতে নাক গলাতে শুরু করবে। তিন দশক ধরে গোপনে সম্পর্ক রাখা দেশগুলো সামনে চলে আসতে পারে। দেশগুলো শান্তিচুক্তি করার জন্য উৎসাহী হয়ে উঠতে পারে।
ফিলিস্তিন জনগণও বুঝতে পারছে তাদের মুক্তি খুব সহজে হচ্ছে না। চুক্তিকে তাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে দেখছে। তারা বলছে আমাদের পিঠে চাবুক মারা হয়েছে। বলা যেতে পারে ফিলিস্তিনের মুক্তি এখন অনেকটাই চাপা পড়ে যেতে পারে। ফিলিস্তিন নিজ ভূখণ্ডে স্বাধীনতা না পেয়ে ইসরায়েলের কলোনি হয়েই থাকতে হতে পারে।
লেখক: মো. বাবুল হোসেন, জনসংযোগ কর্মকর্তা, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পাবনা।