ভালো থেকো তুমি, ভালো রেখো আমাদের; স্বাগত ২০২১
২০২১, তোমাকে বলতে চাই কতগুলো গোপন বেদনার কথা। ভাবছি বলব কি না। এভাবে একদিন ২০২০ ও ২০১৯–কেও বলেছিলাম। কিন্তু জানো, কেউ কথা রাখেনি। গভীর রাত বিনিদ্র থেকে ২০২০–কে অভিবাদন জানিয়েছিলাম। তাকে বলেছিলাম, তুমি ২০১৯–এর মতো হয়ো না। ২০১৯ আগুনে অনেকের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল। সহায়–সম্পদ হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছিল কত মানুষ। ২০২০–কে বলেছিলাম, তুমি এমন কোরো না।
মাত্র কিছুদিন আগে মহাখালীর সাততলা বস্তি, মোহাম্মদপুর জহুরি মহল্লা ও মিরপুর বাউনিয়াবাদ এলাকার বস্তি পুড়ে যায়। কয়েক দিনের মধ্যে তিনটি বস্তিতে কী করে আগুন লাগে, এটি হয়তো চিরকাল প্রশ্ন হয়েই থেকে যাবে। সাধারণত, বস্তির আগুনের অনেক গল্প থাকে। এটা হতে পারে ক্ষমতা, দখল অথবা ভবন নির্মাণের ষড়যন্ত্রের আগুন। সে আগুন যেমনই হোক, তাতে কিছু এসে–যায় না। কিন্তু যারা নিঃস্ব হয়ে পথে বসে, প্রিয়জন হারায়, তাদের জীবনের স্বপ্ন ফিরে আসে না আর কোনো দিন। এমনি করে ২০২০ আগুনে বিপন্ন করে দিয়েছে হাজার হাজার মানুষের স্বপ্ন। তাই ভাবছি ২০২১, তোমাকে বেদনার কথা বলব কি না। তুমি তো তোমার অগ্রজের মতোই হবে।
মৃত্যু অনিবার্য বলেই মানুষ জীবনকে এত ভালোবাসে। ২০১৯ সালের মৃত্যুর ঘটনাগুলোর মধ্যে বুয়েটের মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ ও ফেনীর মাদ্রাসাশিক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফির মৃত্যু আমাদের স্তম্ভিত করে দিয়েছিল। এ মৃত্যু ছিল ভয়ংকর হৃদয়বিদারক।
২০২০–এর কাছে প্রার্থনা করেছিলাম, আর যেন এমন মৃত্যু না হয়। তোমার কি মনে হয় ২০২১, সে কথা রেখেছে। এক কবি বলেছিলেন, ৩৩ বছর কেটে গেল, কেউ কথা রাখেনি। তাই হয়তো কথা রাখেনি ২০২০–ও। বিচারহীন নিষ্ঠুর, অমানবিক মৃত্যুর মিছিল নিয়ে সে এল আমাদের মধ্যে।
২০২০ সালে চারটি ভয়ংকর মৃত্যুর কথা তোমাকে না বলে পারছি না। এদের মধ্যে মেজর সিনহা ও সিলেটের রায়হান আহমদের মৃত্যু হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে, সহকারী পুলিশ সুপার আনিসুল করিমকে মেরে ফেলেছে হাসপাতালের কর্মীরা, লালমনিরহাটে ইউনুস মোহাম্মদ শাহেদুন্নবীকে মারা হয়েছে জীবন্ত পুড়িয়ে। আধুনিক সভ্যতায় এসব মৃত্যু ভীষণভাবে আমাদের বর্বর সময়ের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
এবার বলো ২০২১, কী বলব তোমাকে। যার কাছে আশ্রয় চাই, সেই আঘাত দেয়। কত ভালোবেসে ছিলাম ২০২০–কে! এই তার মূল্য দিল সে!
কত কথাই না তাকে বলেছিলাম। এত কি আর মনে থাকে? তাকে বলেছিলাম, ২০১৯–এ এক কেজি পেঁয়াজের দাম ছিল ৩০০ টাকা! সেবার দেশি পেঁয়াজ কিনতে পারতাম না। অল্প করে আফ্রিকার পেঁয়াজ কিনে মনের দুঃখে রেললাইন ধরে ঘরে ফিরতাম।
২০২০–এর কাছে তখন প্রার্থনা করে বলেছিলাম, তুমি গরিব মানুষদের দেখে রেখো। প্রতিদিন তারা যা খেয়ে বেঁচে থাকে, এর দাম যেন না বাড়ে। কোনো কথাই সে রাখল না, শুনল না। চাল, ডাল, আলু হলো গরিবের প্রায় নিত্যদিনের খাবার। এবার এক কেজি আলুর দাম হয়েছে ৫০ টাকা! চাল, ডাল, তেল, সবজির দাম প্রায় সারা বছরই বাড়ছে। ভরা মৌসুমেও খেটে খাওয়া মানুষকে বেশি দামে চাল কিনতে হচ্ছে।
দরিদ্র–অসহায় মানুষের জন্য গরুর মাংস এখন স্বপ্নের মতো। সারা বছর ধরে এক কেজি মাংসের দাম থাকে প্রায় ৬০০ টাকা। দিনে যাঁরা ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা আয় করেন, তাঁরা কি কোনো দিন এক কেজি মাংস কিনে খেতে পারবেন?
এবার বলো ২০২১, তোমাকে যে গোপন বেদনার কথা বলতে চেয়েছিলাম তাতে কি কোনো কাজ হবে। ২০২০–কে এত দুঃখ–যন্ত্রণার কথা বলার পরও সে শুরুটাই করেছিল এক অমানবিক নিষ্ঠুরতা দিয়ে। কথায় বলে সকালটা দেখে দিনটা বোঝা যায়।
তোমাকে মনে করিয়ে দিই ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের সেই মেয়েটির কথা। ২০২০–এর একেবারে শুরুর দিকের ঘটনা। সেদিন ঘরে ফিরতে তার প্রায় সন্ধ্যা হয়ে যায়। কিন্তু বাস থেকে ভুল করে ভুল জায়গায় নেমে পড়ে। সেই ছোট্ট ভুলই তার জীবনের স্বপ্নগুলো, আনন্দগুলো ভেঙে চুরমার করে দেয়। সে রাতে মেয়েটি ধর্ষণের শিকার হয়েছিল।
এভাবেই শুরু হলো ২০২০–এর নিষ্ঠুরতা। ইতিহাসে এর নাম লেখা থাকবে এক ভয়াবহ দুর্যোগের বছর হয়েছে। করোনার মতো এক বিরল প্রজাতির ভয়ংকর মৃত্যুদূত ঘাড়ে চেপে বসেছে। এতেও যেন শান্তি নেই। আঘাত হানল প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় আম্পান। ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, অতিবৃষ্টিতে ভেসে গেল ঘরবাড়ি, জনপদ। বিরান হলো ফসলের মাঠ। প্রাণ হারাল কত মানুষ! শুধু কি আম্পান? এবারের মতো দীর্ঘ বন্যা অতীতে হয়েছিল কি না জানি না। পরপর চারটা বন্যায় গৃহহীন হয়েছে লাখ লাখ মানুষ। দরিদ্র মানুষ আরও নিঃস্ব হয়ে পথে বসেছে। তুমি বলো ২০২১, ২০২০ আমাদের কোথায় এনে ঠেকিয়েছে।
২০২১, আরেকটু শোনো। তুমি হয়তো ক্লান্ত। কিন্তু শুরুতেই তো বলেছি তোমাকে কিছু গোপন বেদনার কথা বলতে চাই। ২০২১, তোমাকে শুধু স্বার্থপরের মতো কেবল নিজেদের কথাই বলছি। এবার তোমাকে একটু পৃথিবীর কথা বলতে চাই। সবাইকে নিয়েই তো সমাজ।
বছরের শুরু থেকেই জ্বলতে থাকে অস্ট্রেলিয়ার অঞ্চলের পর অঞ্চল। কত কোটি প্রাণী ও গাছের মৃত্যু হয়েছে, এর হিসাব হয়তো কোনো দিন জানা যাবে না। প্রায় ৫০ কোটি বন্য প্রাণীর মৃত্যু হয়েছে বলে ধারণা।
লেবাননের বৈরুত বন্দরে ৪ আগস্টের ভোরটা এসেছিল অন্যদিনের মতোই। কিন্তু সন্ধ্যায় আকাশ-বাতাস বিদীর্ণ করে এক বিস্ফোরণ। বৈরুত শহরের ৫ হাজার বছরের ইতিহাসে সাতবার ধ্বংস হয়েছে এই শহর। আবার গড়ে উঠেছে। কিন্তু পারমাণবিক বোমার কথা বাদ দিলে এটা ছিল বিশ্ব ইতিহাসের সবচেয়ে শক্তিশালী বিস্ফোরণ। কয়েক হাজার মাইল দূরের বাংলাদেশও এ হামলা থেকে রক্ষা পায়নি। বিস্ফোরণের দুজন বাংলাদেশি নিহত ও ৫৯ জন আহত হয়।
২০২১, এবার তোমাকে শোনাতে চাই একটা বর্ণবাদের গল্প। অধৈর্য হয়ো না ভাই, একটু শোনো। যারা মানবতার কথা বলে, তাদের ঘরেই বর্ণবাদের বাস। এ বছর ২৫ মে শভনি নামে যুক্তরাষ্ট্রে এক শ্বেতাঙ্গ পুলিশ কৃষ্ণাঙ্গ যুবক জর্জ ফ্লয়েডকে প্রায় ৯ মিনিট ঘাড়ে হাঁটু চেপে ধরে মৃত্যু নিশ্চিত করে। বিশ্বজুড়ে এটা ছিল পুলিশি বর্ণবাদ ও নিষ্ঠুরতার এক ভয়ংকর কালো দাগ। পূর্ব আফ্রিকার কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয় পঙ্গপালের ভয়াবহ আক্রমণে।
পৃথিবীর ইতিহাসে ২০২০ সাল এক নিষ্ঠুর ও নীরবতার বছর। ২০২০ প্রমাণ করেছে, প্রকৃতির কাছে মানুষ কত অসহায়। এটা হলো এক অভিশপ্ত বছর। এ বছর প্রায় প্রত্যেকেরই কোনো না কোনো খারাপ মুহূর্ত রয়েছে।
খুব মনে পড়ছে ২০১৯–এর কথা। শেষ হচ্ছে ২০১৯, শুরু হচ্ছে ২০২০। একই সঙ্গে শুরু হচ্ছে এক নতুন দশক। আমাদের সেকি আনন্দ! সেকি উচ্ছ্বাস! অনেক প্রত্যাশা নিয়ে তাকিয়ে ছিলাম নতুন একটা দশকের দিকে। কিন্তু ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা রোগী ধরা পড়ে। সেই শুরু। ইতিমধ্যে দেশে সাড়ে সাত হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আক্রান্ত হয়েছে পাঁচ লাখের বেশি। বিশ্বজুড়ে প্রাণ হারিয়েছে প্রায় ১৮ লাখের বেশি মানুষ। আক্রান্ত আট কোটির বেশি। পৃথিবীর মানুষের স্বপ্ন ভেঙে দিয়েছে করোনা। প্রিয় এই শহর ছেড়ে চলে যেতে হয় লাখ লাখ মানুষকে। এত মানুষ ঢাকা ছেড়ে আর কখনো যায়নি। কেউ জানে না এই শহরে আবার তারা ফিরবে কি না।
করোনায় প্রায় সব শ্রেণি–পেশার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আমাদের যুদ্ধের বছর ছাড়া দেশের এত গুণী মানুষ আর কখনো মারা যায়নি।
এত কিছুর পরও ২০২০–কে ইতিহাসের সাফল্যের বছরই বলব। এ বছরই পদ্ম সেতুর শেষ ৪২তম স্প্যানটি বসানো হয়। আর কোনো দিন শিরোনাম হবে না পদ্মা সেতুর এত মিটার দৃশ্যমান বা এতটি স্প্যান বসানো হলো।
২০২১ অনেক কথা বললাম তোমাকে। মানুষ আপনকেই মনের কথা বলে। তুমি পৃথিবীকে মুক্তি দিয়ো। ২০২০–এর মতো হয়ো না তুমি। ভালো হয়ে এসো। আপন ও বন্ধু হয়ে এসো। তোমাকে নিয়ে যেন ২০২২–এর কাছে অভিযোগ করতে না হয়।
ভালো থেকো তুমি। ভালো রেখ আমাদের। স্বাগত তোমাকে ২০২১।
লেখক: আশফাকুজ্জামান, সাংবাদিক ও সংগঠক