বৌদ্ধধর্মে নারীর সম্মান ও সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ

৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। ‘করোনাকালে নারী নেতৃত্ব, গড়বে নতুন সমতার বিশ্ব’ স্লোগান ধারণ করে সীমিত আয়োজনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে দিবসটি পালিত হচ্ছে। নারীর ন্যায্য অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ১৮৫৭ সালের এ দিনে আন্দোলন হয়েছিল। তাই দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য দিবসটি পালন করা। ১৯১০ সালে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক সম্মেলনে জার্মানির ক্লারা জেটকিন দিনটিকে নারী দিবস হিসেবে ঘোষণা দেন এবং ১৯৭৫ সালে জাতিসংঘ এ দিনে নারী দিবস পালন করে। আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৭৭ সাল থেকে দিবসটি পালন শুরু হয়।

আজ থেকে ২৫০০ বছর আগে বৌদ্ধধর্মের জনক মহামানব গৌতম বুদ্ধ কপিলাবস্তু রাজ্যে জন্মগ্রহণ করেন। বুদ্ধের জন্মের আগে প্রাচীন ভারতবর্ষে নারীদের অবস্থান ছিল চার দেয়ালে বন্দী। পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নারীদের জীবন ছিল স্বামী কিংবা পুত্রদের অধীন। নানা সামাজিক কুসংস্কার, বৈষম্য ও অবহেলায় নারীরা ছিল জরাগ্রস্ত। ঠিক তখনই শাক্যরাজা শুদ্ধোধন ও মায়াদেবীর ঘরে বুদ্ধের আগমন। তাঁর জন্মের পর জ্যোতিষেরা বলেছিলেন, তিনি গৃহত্যাগ করবেন এবং বুদ্ধ হবেন। পরে রাজা শুদ্ধোধন পুত্রকে সংসারী বানানোর জন্য খুব অল্প বয়সে বিয়ে দেন যশোধরোর সঙ্গে এবং তাঁদের ঘরে পুত্র রাহুলের জন্ম হয়। এত কিছুর পরও তিনি সংসারের প্রতি মনোনিবেশ করতে পারেননি, জগতের সব প্রাণীর দুঃখমুক্তির জন্য ৬ বছর কঠোর ধ্যান-সাধনা করে বুদ্ধত্ব লাভ করেন। তাঁর অর্জিত জ্ঞান শিষ্য-প্রশিষ্যরা দেশ ও বিদেশে প্রচার করেন। তিনি সুদীর্ঘ ৪৫ বছর মানবের কল্যাণের জন্য ধর্মপ্রচার করে মহাপরিনির্বাণ লাভ করেন এবং তিনি কোনো বিশেষ সম্প্রদায় কিংবা বিশেষ লিঙ্গের জন্য ধর্মের দেশনা দেননি, তাঁর দৃষ্টিতে নারী-পুরুষ সবাই সমান ছিল।

মহাকারুণিক বুদ্ধ নারীর মর্যাদার কথা অনুভব করেন এবং নারীদের সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছিলেন। ত্রিপিটকের অন্তর্গত সূত্রপিটকের দীর্ঘনিকায় গ্রন্থের সিগালোকবাদ সূত্রে ষড়দিক বন্দনায় উল্লেখ আছে, মাতা, স্ত্রী, দাসী ও আত্মীয়স্বজন যাঁরা আছেন, তাদের যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করতে হবে। অপর দিকে খুদ্দকনিকায়ের অন্তর্গত খুদ্দকপাঠো ও সূত্তনিপাতে গ্রন্থে বৌদ্ধদের নিত্য আবৃত্তিযোগ্য মহামঙ্গল সূত্রে উল্লেখ আছে, ‘মাতা-পিতু উপট্ঠানং, পুত্তদারস্সা সঙ্গহো’ অর্থাৎ, মা-বাবার সেবা করা, স্ত্রী-পুত্রের ভরণপোষণ করলে জীবনে মঙ্গল হয়। এতে নারী জাতির প্রতি বুদ্ধের অগাধ শ্রদ্ধা ও সহানুভূতিতার বহিঃপ্রকাশ দেখিয়েছেন। সূত্রপিটকের দীর্ঘনিকায় গ্রন্থের মহাপরিনির্বাণ সূত্রে উল্লেখ আছে, বুদ্ধ ভিক্ষু সংঘকে বলেছিলেন, বৃদ্ধ স্ত্রীলোককে মাতার মতো, তরুণীকে ভগ্নির মতো আর বালিকাকে নিজ সন্তানের মতো জ্ঞান দান করবে। কেননা নারীকে বাদ দিয়ে পুরুষ অচল। নারীরা এ বিশ্বে যত মহামানব, মুনি-ঋষি আছেন, সবার ধাত্রী। উল্লেখ্য, বুদ্ধ সুজাতা নামে এক শ্রেষ্ঠীর হাতে তৈরি পায়েস খেয়ে বুদ্ধত্ব লাভ করেন। এমনকি চাল কন্যারাও বুদ্ধের ভালোবাসা পেয়েছিল। বুদ্ধ নারীদের ন্যায্য সম্মান, মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠা করে দিয়েছেন।

বুদ্ধযুগে বহু বৌদ্ধ নারী তাদের পাণ্ডিত্য, বাগ্মিতা ও তর্কযুদ্ধে পারদর্শিতার জন্য খ্যাতি লাভ করেন, যা থেরীগাথা গ্রন্থে বিস্তারিত পাওয়া যায়। তাঁরা বুদ্ধের ধর্ম উপলব্ধি ও দেশনা করতে পারতেন। অন্তর্দৃষ্টি ও সুগভীর জ্ঞানের জন্য বিম্বিসার মহিষী ক্ষেমা এবং উৎপলবর্ণা ভগবান বুদ্ধ কর্তৃক অগ্রশ্রাবিকা উপাধি লাভ করেন। অপূর্ব বাগ্মিতার জন্য খ্যাতি লাভ করেন কৃশা গৌতমী, শুক্লা, ভদ্র-কপিলানী, পূর্ণা, শুভা ও ধর্মদিন্না। তাঁরা তাঁদের কর্মের জন্য ভারতবর্ষের বাইরে বেশ সুনাম অর্জন করেছিলেন। এমনকি ধনাঢ্য বিশাখা বুদ্ধধর্ম প্রচারে যে অবদান রেখেছেন, তা বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসে আজও স্মরণীয় হয়ে আছেন। থেরি পটাচরা ধর্মীয় শিক্ষায় বেশ পারদর্শী ছিলেন এবং বহু নারীকে ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান করেন। বুদ্ধই প্রথম নারী জাতির শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যক্তিস্বাধীনতা আদায়ের জন্য নারী সংগঠন বা ভিক্ষুণী সংঘ প্রতিষ্ঠা করেন। ভিক্ষু সংঘ প্রতিষ্ঠার পাঁচ বছর পর ভিক্ষুণী সংঘ প্রতিষ্ঠা করা হয়। এর জন্য বুদ্ধের বিমাতা মহাপ্রজাপতি গৌতমীর অবদান অনস্বীকার্য। নর-নারীর সম অধিকার প্রতিষ্ঠা এ প্রতিষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য। বিহারে বা মন্দিরে নর-নারী একত্রে ধর্মাচরণ পালনের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ভিক্ষুণী সংঘ প্রতিষ্ঠা বুদ্ধের এক অমর অবদান। বুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে সম্রাট অশোকের কন্যা সংঘমিত্রা ও পুত্র মহেন্দ্র ভিক্ষু সংঘে প্রবেশ করেন, যার ধারাবাহিকতা এখনো বিদ্যমান।

সিংহলি বৌদ্ধ গ্রন্থ ‘দিব্যবদান’ ও ‘অশোকাবদান’-এ উল্লেখ আছে, শ্রাবস্তীর শ্রেষ্ঠী ও বুদ্ধের শিষ্য অনাথপিকি তাঁর মেয়ে সুমাগাধাকে পুণ্ড্রবর্ধনের এক যুবকের সঙ্গে বিবাহ দেন। সে সময় এ এলাকা বৌদ্ধ অধ্যুষিত ছিল না। সুমাগাধার শ্বশুরবাড়ির সবাইকে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত করার জন্য বুদ্ধকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। বুদ্ধ সুমাগাধার আমন্ত্রণ গ্রহণ করে পাঁচ শ শিষ্য নিয়ে পুণ্ড্রবর্ধনে আসেন। এতে প্রতীয়মান হয়, বুদ্ধ নারী বলে কাউকে তুচ্ছ করেননি। সবার আবদার তিনি গুরুত্ব সহকারে গ্রাহ্য করতেন। মহামানব নারীদের যে সম্মান দিয়েছেন, তা ভূয়সী প্রশংসাযোগ্য। ‘দীর্ঘনিকায়’ গ্রন্থে মহাপরিনির্বাণ সূত্রে বুদ্ধ বৃজিদের শ্রীবৃদ্ধির জন্য সপ্ত অপরিহানীয় ধর্মে বলেছেন, যে জাতি তাদের নারী জাতির সম্মান সুরক্ষা করবে এবং যথাযথ সম্মান প্রদান করবে, সে জাতির উন্নতি হবে এবং যে জাতি একতাবদ্ধ (নারী ও পুরুষ) হয়ে সভা-সমিতিতে অংশগ্রহণ করে এবং একত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, তাদের কখনো পরাজয় হয় না। সুতরাং নারীর প্রতি মানবিকতার সবটুকু বৌদ্ধধর্মে রয়েছে।

বাংলাদেশে ভিক্ষুসংঘের পাশাপাশি ভিক্ষুণী সংঘ রয়েছে। চট্টগ্রামে বাংলাদেশে একমাত্র ভিক্ষুণীসঙ্ঘারাম ও ধ্যানকেন্দ্রের প্রধান ভিক্ষুণী গৌতমী। বৌদ্ধ নারীরা পুরুষের পাশাপাশি দেশ-বিদেশে সুনামের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন। বাংলাদেশ বিনির্মাণে অন্যদের মতো যথেষ্ট অবদান রাখছেন। ভাষা আন্দোলনে প্রতিভা মুৎসুদ্দি, মহান মুক্তিযুদ্ধে রেণুকনা বড়ুয়া, প্রিংছা খে প্রমুখের অবদান অনস্বীকার্য ও তাঁরা বাংলাদেশ বৌদ্ধ সমাজের গর্ব।

বাংলাদেশে বৌদ্ধ নারীরা বর্তমানে শিক্ষকতা (স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের), খেলোয়াড়, শিল্পী, প্রশাসন, প্রকৌশলী, আইনজীবী, সাংসদ, ডাক্তার, নার্স, সাংবাদিক, সমাজকর্মী, বৈজ্ঞানিক, গবেষক, উদ্যোক্তা, শিল্প-কলকারখানা, রাজনীতিবিদ, স্থানীয় প্রতিনিধি, ব্যাংক-বিমা, বিউটি পারলার কর্মী এবং সব ক্ষেত্রে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছেন। বিহার, সভা-সেমিনারে নানা ধর্মীয়-সামাজিক কর্মকাণ্ডে বৌদ্ধ পুরুষের মতো নারীদের দেখা যায়। বাংলাদেশের বৌদ্ধ নারীর অধিকার, বৈষম্য রোধ, ক্ষমতায়ন ও অংশগ্রহণের জন্য কাজ করছে বাংলাদেশ বৌদ্ধ মহিলা সমিতি, বাংলাদেশ বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘ (মহিলা শাখা), বাংলাদেশ বুড্ডিস্ট ফেডারেশন ফর উইমেন। অপর দিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধ নারীদের সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতি, হিল উইমেন্স ফেডারেশন, বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্ক (পাহাড় ও সমতল) পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘ, ঘিলাছড়ি নারী নির্যাতন প্রতিরোধ কমিটি, সিএইচটি উইমেন হেডম্যান-কারবারী নেটওয়ার্ক, সিএইচটি উইমেন অ্যাকটিভিস্ট ফোরামও কাজ করে যাচ্ছে।

বাংলাদেশে বৌদ্ধ নারীরা বিভিন্ন সভা-সেমিনার, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠানে ত্রিপিটক পাঠ করেন। এটা সম-অধিকারের উৎকৃষ্ট উদাহরণ। বাংলাদেশের বর্তমান সরকার নারীবান্ধব, দেশের প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার ও শিক্ষামন্ত্রীও নারী। নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশের অর্জন চোখে পড়ার মতো। সরকার নারীশিক্ষা অতি গুরুত্বের সঙ্গে দেখে। বিনা মূল্যে বই, শিক্ষাবৃত্তি, বাল্যবিবাহ রোধ, মাতৃত্বকালীন ছুটি, নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে ১০৯ হেল্পলাইন চালু, নারী-শিশুমৃত্যুর হার কমানো, মহিলা বাস সার্ভিস, বিধবা ভাতা ও বয়স্ক ভাতা প্রভৃতি সুযোগ সরকার নারীদের জন্য প্রদান করে। এই সুবিধা বাংলাদেশের জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সব নারী নাগরিকেরা সুবিধা ভোগ করে থাকেন। সাম্প্রতিক একটি টেলিভিশন চ্যানেলে প্রথম ট্রান্সজেন্ডার তাসনুভা আনান শিশির সংবাদ পাঠক হয়েছেন। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর চিরাচরিত প্রথা ভেঙে প্রথম কোনো ট্রান্সজেন্ডার নারী এ পেশার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সুযোগ পেলেন। উদ্যোগটি প্রশংসিত। করোনা মোকাবিলায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী যে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন, তা সম্প্রতি কমনওয়েলথ মহাসচিব প্রশংসা করেন এবং বলেন, অসাধারণ নারী নেতৃত্ব ও গভীর অনুপ্রেরণা। এটা আমাদের জন্য অতি গর্বের। আশা করি বৌদ্ধ নারীরা তাঁদের দক্ষতা ও কর্ম দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাবেন।

চলুন বিশেষ দিনে প্রতিজ্ঞা করি, কোনো নারীকে অবহেলা নয়, আসুন নারীদের সমস্যায় পাশে থেকে সহযোগিতা করি, তাদের সমস্যা সমাধানে তৎপর হই, তাদের যথাযথ মর্যাদা দান করি এবং তাদের প্রাপ্য অধিকার দিই। নারীদের জন্য ঘর ও বাহির হোক নিরাপদ। বুদ্ধের অমিয় বাণী, ‘সব্বে সত্তা সুখিতা ভবন্তু’ অর্থাৎ, জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক সেটা ধারণ করি। সবার সুস্বাস্থ্য ও মঙ্গল কামনা করি। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের বৌদ্ধ নারী সংগঠনগুলো নারী দিবস উপলক্ষ্যে প্রতিবছর সভা ও আলোচনার আয়োজন করে থাকে৷

  • লেখক: রোমানা পাপড়ি, খণ্ডকালীন শিক্ষক, পালি অ্যান্ড বুড্ডিস্ট স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]

  • নাগরিক সংবাদে লেখা পাঠাতে পারেন [email protected]-এ