বিসিএসে দীর্ঘসূত্রতার অবসান হোক

চলতি সপ্তাহের সোমবারে প্রকাশিত জোড়া বিসিএস বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পরে আলোচনায় এসেছে বহুল আলোচিত বিসিএস ইস্যুটি। গত এক দশকে বিসিএস এ দেশের তরুণ প্রজন্মের কাছে স্বপ্ন থেকে হয়ে উঠেছে অনেকটা আসক্তি। এ যুগের ‘ট্রেন্ড’ বনে যাওয়া বিসিএস জায়গা করে নিয়েছে চাকরিপ্রত্যাশীদের পছন্দের শীর্ষে। ফলে প্রতিটি বিসিএসে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আবেদনকারীর সংখ্যা। চাকরির নিরাপত্তা, সামাজিক মর্যাদা, সব সুযোগ–সুবিধা, ক্ষমতাচর্চাসহ বিভিন্ন বিবেচনায় নতুন প্রজন্মের মধ্যে গড়ে উঠছে বিসিএস–প্রবণতা।

বর্তমানে চিকিৎসক বা প্রকৌশলীদের মধ্যেও বিসিএসের মাধ্যমে সাধারণ ক্যাডারে যোগদানের জনপ্রিয়তা বহুলাংশে বৃদ্ধি পাচ্ছে। মেধাবী এ তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এ প্রবণতাও লক্ষণীয় যে ক্যারিয়ার গঠনে বিকল্প ধারার চিন্তাকে পাশ কাটিয়ে বিসিএসের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে তাদের, যা গবেষণাকেন্দ্রিক পড়াশোনার পথে অন্তরায় এবং তরুণ উদ্যোক্তা তৈরির পথে অন্যতম প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করছে। এমনকি অন্যান্য সেক্টরেও দেখা মিলছে না তরুণ কোনো মেধাবী মুখের। অপর দিকে আবেদনকারীর সংখ্যার তুলনায় সীমিত পদসংখ্যা, বহুমাত্রিক যাচাই-বাছাইসহ নানা জটিলতার মারপ্যাঁচে বিসিএসপ্রত্যাশীদের সিংহভাগই বাদ পড়ছেন তাঁদের স্বপ্নের চাকরির সুযোগ থেকে। তারুণ্যের দীর্ঘ তিন থেকে চার বছর শুধু একটি বিসিএসের পেছনে সময় ব্যয় করেও চূড়ান্ত ফলাফলে ব্যর্থতা চাকরিপ্রার্থী তরুণদের হতাশার করালগ্রাসে ঠেলে দিচ্ছে। অনির্ধারিত সময়ের এই গণ্ডিতে চাকরিপ্রার্থীদের জন্য নিরাশা আর অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ ছাড়া আর কিছুই বাকি থাকছে না।

বিসিএসের এই দীর্ঘসূত্রতায় যে শুধু কালক্ষয় হচ্ছে, তা নয়, হারাচ্ছে তারুণ্য, নষ্ট হচ্ছে অজস্র সম্ভাবনা। ফলে দিন দিন বেড়ে উঠছে হতাশায় নিমজ্জিত বিশাল এক প্রজন্ম। অধৈর্য আর নৈরাশ্যে মুহ্যমান এই প্রজন্মের অসহায়ত্ব দেখার কি সত্যিই কেউ নেই?
ইতিপূর্বে কর্ম কমিশনের পক্ষ থেকে বিসিএসের নিয়োগপ্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতা কমানোর আশ্বাস দিলেও বাস্তবে তার প্রমাণ মেলেনি, ঘোচেনি দুর্ভোগও৷ প্রতিটি বিসিএসেই গেজেট প্রকাশ থেকে শুরু করে নিয়োগপ্রক্রিয়ার সময় ক্রমশ দীর্ঘতর হচ্ছে। হতাশার কথা হচ্ছে, প্রতিটি বিসিএসের প্রজ্ঞাপন জারির পর থেকে চূড়ান্ত নিয়োগ কার্যক্রম শেষ করতে লেগে যাচ্ছে তিন বছরেরও বেশি সময়। ২০১৭ সালে ৩৮তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হওয়ার পর তিন বছরেও সম্পন্ন হয়নি নিয়োগ কার্যক্রম। ৩৮তম বিসিএসের চলমান কার্যক্রমের মধ্যেই স্পেশাল বিসিএসে চিকিৎসক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর নিয়োগ কার্যক্রম সম্পন্নকরণে কালক্ষয়ের দরুন ৩৮তম বিসিএস প্রার্থীদের পোহাতে হয়েছে সর্বোচ্চ কালক্ষেপণের দুর্ভোগ, যা দীর্ঘসূত্রতার দিক থেকে রেকর্ড গড়েছে বিসিএসের ইতিহাসে। ৪০তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়েছিল প্রায় ২৭ মাস আগে। চলতি বছরের শুরুতে ৪০তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা শেষ হলেও এখন পর্যন্ত শেষ হয়নি ফলাফলের অপেক্ষা। গত বছরের ২৭ নভেম্বরে ৪১তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর এখনো প্রিলিমিনারি নেওয়া সম্ভব হয়ে ওঠেনি। গত সোমবার প্রায় ২ হাজার চিকিৎসক নিয়োগের জন্য ৪২তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হয়েছে। বিসিএসে দীর্ঘসূত্রতাকে ঘিরে ঘনীভূত হতাশার মধ্য ৪২তম ‘স্পেশাল’ বিসিএসেরর এ ঘোষণা। ৪০তম ও ৪১তম বিসিএসের চলমান কার্যক্রম শেষ না হতেই ৪২তমের তোড়জোড়ে ঘটতে চলেছে ৩৮তম বিসিএসের দীর্ঘসূত্রতার পুনরাবৃত্তি। ফলে উদ্বেগ–উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছেন চাকরিপ্রার্থী অসংখ্য ভুক্তভোগী।

অন্যদিকে ৪০তম, ৪১তম, এমনকি ৩৮তম বিসিএসের নিয়োগ কার্যক্রম ব্যতিরেকে ৪৩তমের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ বিসিএসপ্রত্যাশীদের কাছে প্রহসন মনে হতে পারে।
কর্ম কমিশনের নিজস্ব জনবল বৃদ্ধির মাধ্যমে কমিশনের কর্মতৎপরতা বাড়ানো গেলে গতিপ্রাপ্ত হবে বিসিএসে দীর্ঘসূত্রতা হ্রাসের প্রয়াস। স্বাস্থ্য পরীক্ষা, পুলিশ ভ্যারিফিকেশনের মতো প্রক্রিয়ার সংস্কার সাধন এখন সময়ের দাবি। বিশ্লেষকদের অনেকে খাতা মূল্যায়নে দীর্ঘ সময় ব্যয়কে বিসিএসে দীর্ঘসূত্রতা বৃদ্ধির অন্যতম নিয়ামক মনে করেন। প্রিলিমিনারির উত্তরপত্র মূল্যায়নে সময়ের ব্যপ্তি হ্রাস বাঞ্ছনীয়। লিখিত খাতা মূল্যায়নে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাজে লাগানো গেলে তা হয়ে উঠতে পারে বিসিএসে দ্রুততা আনয়নের এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। বিসিএস প্রিলিমিনারি থেকে শুরু করে পুরো নিয়োগ কার্যক্রম সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করা গেলে বেঁচে যাবে তারুণ্যের গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলো, তরুণ নিয়োগপ্রাপ্তরা নতুন উদ্যমে শুরু করতে পারবে দেশমাতৃকার সেবা, অপর দিকে সুযোগ না পাওয়া বিশাল এক সম্প্রদায় বিসিএসে অনুত্তীর্ণের ভাগ্যবরণ করে একাগ্রভাবে ব্যক্তি ও দেশের নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচনে ব্রতী হতে পারবেন।

লেখক: শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ