বাবা শব্দটা যাদের কাছে অজানা

তাবাসসুমের বয়স চার বছর। জন্মের পর নানার বাড়িতে বেড়ে ওঠা। মা-বাবার দীর্ঘদিনের প্রেম একসময় বিয়েতে পরিণত হয়। কিন্তু বিয়ে হতে না–হতেই বাবা মায়ের ওপর অমানবিক নির্যাতন শুরু করেন। সবকিছু সহ্য করতেন তাবাসসুমের মা। সুন্দর একটা পরিবারের স্বপ্ন দেখতেন। ভাবতেন, সংসারে ছেলেমেয়ের জন্ম হলে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।

তাবাসসুমের বাবা মাদ্রাসাশিক্ষক, মা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স-মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন। জামাতা ও মেয়ের সুখের কথা চিন্তা করে তাবাসসুমের নানা মাদ্রাসায় চাকরি নেওয়ার সময় আর্থিক সহায়তা করেছেন।

কিন্তু তাবাসসুমের দাদা-দাদির পরিকল্পনা ভিন্ন ছিল। একবার ছেলের চাকরিটা হয়ে গেলে নতুন বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তাঁরা। কারণ, শ্বশুরের টাকায় ছেলে চাকরি নিয়েছে, যেকোনো সময় বউ বড় কথা বলতে পারে!

দিনরাত একটাই চিন্তা ছিল, কীভাবে এই বউকে সংসারচ্যুত করা যায়। প্রথমত, তাঁরা শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতনের পরিকল্পনা করেন। নির্যাতনের সহ্য করতে না পেরে ডিভোর্স দিয়ে বাবার বাড়ি চলে গেলে নতুন বউ আনা যাবে। এ পরিকল্পনা থেকেই তাবাসসুমের মায়ের ওপর শ্বশুরবাড়ির লোকজন অমানবিক নির্যাতন শুরু করেন। হাজারো নির্যাতন সহ্য করে সংসার টিকিয়ে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করতেন তাবাসসুমের মা। নির্যাতনে বাবার বাড়ি পাঠাতে ব্যর্থ হয়ে তাবাসসুমের মাকে হত্যার পরিকল্পনা করেন শ্বশুরবাড়ির লোকজন!

শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে একপর্যায়ে তিনি গাগল হয়ে যান। কথিত আছে, স্বামী-শাশুড়ি তাবাসসুমের মাকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের পাশাপাশি কালোজাদুর মাধ্যমেও হত্যাচেষ্টা করেন।

হঠাৎ একদিন খবর আসে তাবাসসুমের মা খুব অসুস্থ। একবারের জন্য হলেও তাঁর মা–বাবাকে দেখতে চেয়েছেন। জরুরি খবর পেয়ে একমুহূর্ত দেরি না করে মেয়ের বাড়ির উদ্দ্যেশে রওনা দেন তাবাসসুমের নানা-নানি।

মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার পর এবারই প্রথম জামাইয়ের বাড়িতে যাচ্ছেন তাঁরা। বহুবার জামাইয়ের নির্যাতনের খবর শুনলেও মেয়ের সংসারের কথা চিন্তা করেই কখনো প্রতিবাদও করেননি; বরং সুযোগ পেলে নিজের মেয়েকেই শাসিয়েছেন।
মৃত্যুপথযাত্রী সন্তানের মুখ একপলক দেখতে গিয়ে আর সহ্য করতে পারেননি তাবাসসুমের নানা-নানি।

এবার তাঁরা নির্যাতনের প্রতিবাদ করেছেন, তা–ও আবার জামাইয়ের বাড়িতে! শ্বশুর-শাশুড়ির এত বড় স্পর্ধা মোটেও সহ্য করতে পারেননি এই মাদ্রাসাশিক্ষক তথা তাবাসসুমের কথিত বাবা। তাই তো সেদিন এই নামমাত্র শিক্ষকের হাতে মার খেতে হয়েছে তাবাসসুমের নানা-নানিকে। শুধু মেরেই ক্ষান্ত হননি, হত্যা করার উদ্দেশে ঘরবন্দী করেও রাখা হয়। পরে পুলিশ ও স্থানীয় লোকজন উদ্ধার করেন। সেই থেকে তাবাসসুমের নানা মেয়েকে আর জামাইয়ের বাড়ি পাঠাননি। পরে তাবাসসুমের বাবা বিচ্ছেদের পর নতুন বিয়ে করেন।

ঘটনার কয়েক মাস পর তাবাসসুম জন্মগ্রহণ করে। নানা ও মামারা জন্মের পর থেকেই অভাব কি জিনিস বুঝতে দেননি। যখন যা চেয়েছে, তখন তা–ই এনে দিয়েছেন।

তার জীবনে অভাব শুধু একটাই। সেটা হলো, কেউ তাকে বাবা শব্দটার সঙ্গে পরিচয় করায়নি। এককথায় বলতে গেলে তাবাসসুমের অভিধানে বাবা শব্দটা নেই। সে জানে না বাবা শব্দের অর্থ কী, বাবা কী জিনিস, আর এই ব্যক্তি কতটা মূল্যবান! নামমাত্র সেই বাবাও কোনো দিন তাঁর মেয়ের খোঁজখবর নেননি। কত ঈদ আসে-যায়; কিন্তু তাবাসসুমের বাবা-চাচারা খোঁজ নিতে আসেন না।

তাই বাবা শব্দটার সঙ্গে সে আজও অপরিচিত। বাবা বেঁচে থাকতেও সে জানে না বাবা কী জিনিস।

এ রকম হাজারো তাবাসসুম আমাদের সমাজে আছে, যাদের বাবা থাকা সত্ত্বেও এই শব্দটার সঙ্গে অপরিচিত। নিরপরাধ হয়েও বাবার স্নেহ-ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত। এসব তাবাসসুমও একদিন বড় হবে, সেদিন বুঝতে পারবে বাবা বলে কোনো শব্দ আছে। কিন্তু সেদিনও তাদের কাছে অজানা রয়ে যাবে, বাবার ভালোবাসা কেমন! হয়তো সেদিন তাবাসসুমেরা দুই ফোঁটা চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলবে বাবা দিবস সবার জন্য নয়।

আজ বাবা দিবসে কোনোভাবেই সমাজের কাছে বাবাকে তুচ্ছ করে তুলে ধরার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা আমার নেই। কিন্তু বাবা নামক শব্দটার বিশালতায় কিছু অমানুষ আজীবন দৃষ্টির অগোচরেই রয়ে যাচ্ছে। তাদের চরিত্র উন্মোচন আর তাবাসসুমের মতো হাজারো নিষ্পাপ শিশুর মনের বেদনা সমাজের কাছে তুলে ধরাই ছিল আমার মুখ্য উদ্দেশ্য।

প্রকৃত বাবা তো তিনিই; যিনি সন্তানের জন্য শুধু মার নয়, জীবন দিতেও প্রস্তুত। শুভকামনা সেসব বাবার জন্য।

লেখক: শিক্ষার্থী: হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর