বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়: হীরকজয়ন্তী পেরিয়ে
উপমহাদেশের প্রথম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় দক্ষিণ এশিয়ার কৃষিশিক্ষার অন্যতম সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ ও আয়তনে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয় ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি)। কৃষিশিক্ষা, গবেষণার গৌরবোজ্জ্বল ৬০ বছর পেরিয়ে ৬১–তে পা রেখেছে। ১৯৬১ সালের ১৮ আগস্ট প্রতিষ্ঠা লাভ করে প্রকৃতির মায়ার চাদরে ঘেরা ১ হাজার ২৩০ একরের সবুজ এই অরণ্য।
করোনা পরিস্থিতিতে শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ থাকায় এবং শোকের মাস হওয়ায় গত বছরের মতো এবারও জাঁকজমক কোনো আয়োজন নেই প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশ ঘেঁষে অতিবাহিত ব্রহ্মপুত্র নদে মাছের পোনা অবমুক্ত করা ও ক্যাম্পাসে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচিতেই সীমাবদ্ধ রয়েছে হীরকজয়ন্তী উদযাপন।
গেল ছয় দশকে বাকৃবির রয়েছে অসংখ্য গৌরবময় অর্জন, যার মধ্যে বাউ ধান-৩, ডেঙ্গুর সিরোটাইপ নির্ণয় প্রযুক্তি, মানুষ ও পশুর ব্রুসেলোসিস রোগের জীবাণু শনাক্তকরণ, ইলিশ ও ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের জিন রহস্য উন্মোচন, ক্ষতিকর অ্যান্টিবায়োটিকের বিকল্প উদ্ভাবন, হিমায়িত ভ্রুণ হতে ভেড়ার কৃত্রিম প্রজনন, শুকনা মৌসুমে বোরো ধান চাষের প্রযুক্তি উদ্ভাবন অন্যতম। এ ছাড়া বিভিন্ন প্রকার উদ্ভিদ ও মাছের কৃত্রিম প্রজনন পদ্ধতি আবিষ্কার, শস্য ও পশুর একাধিক জাত উদ্ভাবনের মতো কৃষির সম্প্রসারণ ও প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনে অনন্য উচ্চতায় এখন বাকৃবি। যার স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৭ ও ’১৮–এর পর সম্প্রতি আবারও দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় প্রথম হয়েছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।
অর্জনের ধারাবাহিকতা রক্ষা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম অক্ষুণ্ণ রাখার চ্যালেঞ্জ নিয়ে বর্তমানে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার শিক্ষার্থী ছয়টি অনুষদে অধ্যয়নরত। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে সাত থেকে আটটি বছরে পড়াশোনার পাশাপাশি বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, হলজীবনের রোমাঞ্চ, শিক্ষাসফর, বার্ষিক বিভিন্ন অনুষ্ঠান আলাদাভাবে দাগ কেটে রাখে মনে। রাতে ঘুমাতে যতই দেরি হোক না কেন, ভোরবেলা মুঠোফোনের অ্যালার্ম ঠিকই জানিয়ে দেয় সকাল আটটায় ক্লাস ধরার তাড়া আছে। প্রশান্তির ঘুম ছেড়ে চরম অনিচ্ছা সত্ত্বেও দৌড়াতে দৌড়াতে ক্লাসে উপস্থিত হওয়া বাকৃবির একজন শিক্ষার্থীর নিত্যদিনের ঘটনা। ক্লাসরুম, ল্যাব, ফার্ম, ফিল্ড করতে করতে সারাটা দিন কেটে যায়। তবুও একবিন্দু দমে যাওয়ার জো নেই। সন্ধ্যায় লাইব্রেরিতে পড়াশোনা আর রাতে হলে প্র্যাকটিক্যাল লিখা। তবুও ব্যস্ত সূচির মধ্যেই আনন্দ খুঁজে নিতে হয়। সেখান থেকেই গড়ে ওঠে অসংখ্য গল্প, স্মৃতি। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্ল্যাটফর্ম, কেআর মার্কেট, আমবাগান, টিএসসি, বোটানিক্যাল গার্ডেন কিংবা ফিশ মিউজিয়ামে প্রতিনিয়ত রয়ে যায় বাকৃবিতে পদচিহ্ন ফেলে আসা মধুর স্মৃতিগুলো। ৬০ বছরে ৫০ হাজারের বেশি গ্র্যাজুয়েট দেখেছে এই সবুজ ক্যাম্পাস। একঘেয়ে রুটিনে বিরক্ত হয়ে যাওয়া পুরোনো মুখগুলো আজ মনে মনে খুঁজে ফেরে ক্যাম্পাসের সেই দিনগুলো।
১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে কৃষিবিদরা প্রথম শ্রেণির মর্যাদা লাভ করে বাকৃবির সবুজ চত্বর থেকে। সেই মর্যাদার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে মিশে যায় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম। ইতিহাস–ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ এই ক্যাম্পাস বেঁচে থাকুক হাজার বছর, অবদান রাখুক দেশ, দেশের কৃষি ও দক্ষ কৃষিবিদ তৈরিতে—হীরকজয়ন্তী পেরিয়ে এমনটাই প্রত্যাশা সবার।