পিতৃহারা শিশুসন্তানের ক্রন্দন থামাবে কে
শত বীভৎস কাজ, শত মানববন্ধন, সবকিছুই কি এক সুতায় বাঁধা? প্রশ্নের উত্তর মেলানো ভার। বিবেকের দংশন যেখানে তাড়া করে, সেখানে করুণার উদ্রেক হয়। যে লোক কিছু সময় আগেও অটোরিকশার যাত্রী ছিলেন, চালক তাঁকেই মেরে ফেলতে এত উদগ্রীব! তাহলে যাত্রীসেবার মান তো প্রশ্নবিদ্ধই থেকে যায়। ২১ ফেব্রুয়ারি সিলেট নগরীর কোর্ট পয়েন্টে এমনই এক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ব্যাংক কর্মকর্তা মওদুদ আহমদকে দল বেঁধে পিটিয়ে হত্যা করেন অটোরিকশার পরিবহনশ্রমিকেরা। একপর্যায়ে মওদুদ আহমদের মৃত্যু হয়। ওই এলাকার সিসিটিভির ফুটেজ দেখে খুনের ঘটনার সত্যতা প্রকাশ পায়।
ভাড়া নিয়ে দ্বন্দ্ব। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে পৃথিবী থেকে চিরবিদায়ের পথ অটোরিকশার পরিবহনশ্রমিকেরা বাতলে দিতে পারেন! এই বীভৎস ঘটনার রূপায়ন তাঁরা নিজেরাই ঘটাতে পারঙ্গম। বর্বরতার চরম পর্যায় হত্যাকাণ্ড। নারকীয় হত্যাকাণ্ড ঘটাতে তাঁদের হৃদয় একটিবারের জন্যও নাড়া দেয়নি। এমন ন্যক্কারজনক ঘটনা বীভৎসতার কালক্রমে বিস্তৃতি লাভ করে। একা নয়, কয়েকজন মিলিত হয়ে খুন করেছেন। যদি সিসিটিভি ফুটেজে দেখা না মিলত, তবে নিছক দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেওয়া হতো। কতই না ফন্দি ছিল তাঁদের মনে।
সমাজের দায়বদ্ধতা হত্যাকারীদের কখনো ভাবায় না। ব্যক্তিস্বার্থ অবহেলিত হলে খুনের মতো ঘটনা ঘটাতেও তাঁদের বিবেক নাড়া দেয়নি। একাধিক মানুষ তাঁকে হত্যা করতে উন্মুখ হয়েছিল! তাঁদের উন্মত্ততা তাঁরা নিজেরাই তৈরি করে নিয়েছিলেন। পরিবেশ যখন নষ্টদের অধিকারে চলে যায়, তখন মানুষ ভ্রষ্ট পথে হাঁটতে থাকে। নষ্টদের ভিড়ে ভালো মানুষেরাও হারিয়ে যান। সমাজের ভালো মানুষগুলো দিন দিন খোলসের ভেতর মুখ লুকিয়ে রাখেন। খারাপ মানুষের সঙ্গে পেরে ওঠা দায়। সভ্য সমাজে তাঁদের মতো কিছু মানুষই কালিমা লেপটে দেয়। ভালোবাসার হৃদ্যতা সেখানে শোভা পায় না। দিন দিন আমাদের মন হিংস্র হয়ে উঠছে, নাকি আমরাই হিংসার কলেবরে মেতে উঠছি? অথচ নিজেরা সৃষ্টির সেরা জীব পরিচয়ে গর্ববোধ করি।
নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে সমাজ আবারও সরব উপস্থিতি জানান দেবে। ভেতরে জমে থাকা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবে। ইতিমধ্যে হত্যার প্রতিবাদে মানববন্ধনের আয়োজন হয়েছে। কী হবে মানববন্ধন করে? বিচারে হত্যাকারীর বিচার হবে। কিন্তু হত্যাকাণ্ডের শিকার যে পরিবার, তারা নিজেদের কী ভেবে সান্ত্বনা দেবে? শুধু মৃত স্বজনের ছবিটা কোনো ফ্রেমে বাঁধাই করে রাখবে হয়তো।
হত্যাকারীরা খুন করে কী জানান দিতে চাইছেন? ক্ষমতার দাপট নাকি ভবিষ্যতের সতর্কবাতা? অথবা ভবিষ্যতে কেউ যেন তাঁদের সঙ্গে বাক্বিতণ্ডায় না জড়ায়? এমন কাজ ঘটানোর চেষ্টা করলে শত্রুর হাতে শেষ পরিণতি হবে। সমাজের এহেন বিকৃত মানসিকতার পরিবর্তন করা অনেক কঠিন ব্যাপার। এসব অন্ধশ্লাঘা লোকেরা নিজেদের ধারণাকেই শ্রেষ্ঠ বলে মানে। মানবিকতার হৃদ্যতা সেখানে হার মানে। অথচ আমাদের সমাজ আমাদের সুন্দরভাবে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করে। সমাজের বিভাজনব্যবস্থা আমাদের শঙ্কিত করে তোলে।
মনে পড়ে, ২০১৯ সালে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়াসিম আফনান নামের এক ছাত্রকে বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে প্রাণ দিতে হয়েছিল। ভাড়া নিয়ে কথা–কাটাকাটির একপর্যায়ে তাঁকে চাকার নিচে ফেলে হত্যা করতে প্রাণ কাঁপেনি হত্যাকারীদের। ঘটনাগুলো মর্মান্তিক এবং হৃদয়বিদারক। শুনলেই গা শিউরে উঠে। কথা–কাটাকাটি থেকে খুন করা সভ্য সমাজের পরিচায়ক নয়।
শত আঘাত, শত লাঞ্ছনার ভিড়েও মওদুদ আহমদ সেবামূলক প্রতিষ্ঠান ব্যাংকে চাকরি করতেন। করোনার সময়ও দেশের সম্মুখযোদ্ধা হিসেবে ছিলেন। এক ব্যাংকারকে হত্যা করা মানে মানবতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা। কিন্তু গণমানুষের মধ্যে মানবিকতা উৎসারিত না হলে, তা কেবল আকাঙ্ক্ষা ও শুভ মানসের পরিচয় হয়ে দাঁড়াবে।
আমাদের সমাজ আমাদের অনেক কিছু বুঝতে শেখায়। আঙুল উঁচিয়ে দেখিয়ে দেয় নষ্টদের ভেতর জেগে থাকা রূঢ় আচরণ। সভ্য সমাজটাকেই আমরা নোংরা করে ফেলছি। একজন আরেকজনকে মেরে ফেলতে দ্বিধা বোধ করি না। হত্যা করা ব্যক্তির পরিবারের মানুষগুলোও বিচারের আশায় দিন পার করবে। তাঁকে মেরে ফেলা মানেই তো তাঁর পরিবারে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করা, সমাজের মানুষকে শঙ্কিত করে তোলা। সমাজের কয়জন মানুষ প্রতিবাদ করবে? কয়টা ঘটনার প্রতিবাদ জানাবে? বহু ঘটনার দায় নিয়ে কত দিন মানববন্ধনে শামিল হবে? অনেক ঘটনার দায় হয়তো তলানিতে আটকে আছে।
পুরো সমাজটাই কেমন যেন ধোঁয়াশায় নিক্ষেপিত এক সমাজ। অনেক কিছু দেখার চেষ্টা করলেও অন্ধকার জগতই ঠাঁই পায়। শিল্পীত সমাজটাকে আমরা এভাবেই অন্ধকারে ঠেলে দিচ্ছি। তাঁরা জানেন না, যাঁকে হত্যা করা হয়েছে, তাঁরও একটা স্বপ্ন ছিল। সেই স্বপ্ন নিয়ে তাঁর বেঁচে থাকার আকুতি ছিল। তাঁর সঙ্গে তাঁর পরিবারের স্বপ্নকেও হার মানতে হয়েছে। শুনেছি, যাঁকে হত্যা করা হয়েছে, তাঁর ৪০ দিনের একটি কন্যাসন্তান রয়েছে। কীভাবে বেড়ে উঠবে কন্যাশিশুটি? পিতার স্নেহ-মমতা, আদর-ভালোবাসার মধ্যে যে শিশুর বেড়ে ওঠার কথা, সে শিশুকে পিতৃহারা করা হলো। বিচারের মধ্য দিয়ে কি তাঁর স্নেহ–ভালোবাসা ফিরিয়ে দিতে পারবে? সমাজের ভেতর সে প্রশ্ন বারবার থেকেই যায়।
*অনজন কুমার রায়, ব্যাংক কর্মকর্তা