নদীবিধৌত এক জনপদে লাল-সবুজের গল্প
একটি কাহিনি যদি এমন হয়, সৌরজগতে পৃথিবী নামক গ্রহে একটি দেশ ছিল। দেশটি প্রায় ২০০ বছর পরাধীন ছিল। অনেক সংগ্রামের পর একদিন দেশটি স্বাধীন হলো। তারপর একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে ২৩ বছর কোনো নির্বাচন হলো না। একটি স্বাধীন দেশ; অথচ দুই দশকের বেশি সময় নির্বাচন হয় না। এটা কি ভাবা যায়! কিন্তু বাস্তবতা হলো উপমহাদেশে পূর্ব পাকিস্তান নামক দেশটিতে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত এমনই হয়েছিল।
অথচ এই দেশে বঙ্গবন্ধু উপাধি পাওয়া একজন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি ছিলেন, যাঁকে মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য জীবনের দীর্ঘ সময় জেলে থাকতে হয়েছে। ২৩ বছর ধরেই দেশটিতে দুঃশাসন, অপশাসন ও সামরিক শাসন ছিল। এর সব দায় ছিল স্বৈরাচারী শাসকের। দেশটি যদি গণতান্ত্রিক হতো, তাহলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই হতেন এ দেশের প্রধানমন্ত্রী। জাতীয় পরিষদে হতেন সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা। কারণ, তিনি দীর্ঘ দুই দশকের বেশি সময় ধরে জনগণের অধিকার আদায়ের আন্দোলন করছেন। এই সংগ্রামের ফলে অবশেষে ১৯৭০ সালের একেবারে শেষের দিকে এসে সামরিক শাসক সাধারণ নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়েছিল।
এই নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগ ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন পেয়ে বিশাল বিজয় অর্জন করে। এটি ছিল বঙ্গবন্ধুর ছয় দফার প্রতি জনগণের রায়। এবার আমরা আশা করতে পারি, দেশটি নিশ্চয়ই তার মাটি ও মানুষের নেতার কাছে ফিরে যাবে। কিন্তু অবস্থা হলো কবিগুরুর ওই কবিতার মতো—
সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালোবাসিলাম...।
বঙ্গবন্ধুর আর ক্ষমতায় যাওয়া হলো না। দেশটি আগের মতোই থেকে গেল স্বৈরাচারী ও অগণতান্ত্রিক। এ রকম একটি রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হলেন বঙ্গবন্ধু। এ সময় পাকিস্তানের আরেক নেতা ছিলেন। তাঁর নাম জুলফিকার আলী ভুট্টো। তাঁর রাজনৈতিক দলের নামের সঙ্গে তিনটা ‘পি’ (পাকিস্তান পিপলস পার্টি) আছে। এই দল জাতীয় পরিষদে ৩০০ আসনের মধ্যে ৮৩টি আসন পেয়ে দ্বিতীয় হয়েছে। এই দলের নেতা ভুট্টোই তখন পাকিস্তানের রাজনীতির ষড়যন্ত্র ও ঘুঁটি চালের মূল হোতা।
নির্বাচনের পর দিন, সপ্তাহ, মাস যায়। কোনোভাবেই পাকিস্তান সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর করে না। কেবলই ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে থাকে। বঙ্গবন্ধুও নীতিতে অবিচল থাকেন। সময় গড়িয়ে একদিন এল ৩ জানুয়ারি ১৯৭১। বঙ্গবন্ধু আর কত অপেক্ষা করবেন। তিনি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ডাকলেন। সেখানে এক জনসভা হলো। তারপর তিনি তাঁর প্রতিনিধিদের ছয় দফার আলোকে শাসনতন্ত্র রচনা ও জনগণের রায়ের প্রতি বিশ্বস্ত থাকার জন্য শপথ পাঠ করলেন। এদিকে ষড়যন্ত্র চলতেই থাকে। এরই মধ্যে ১৩ ফেব্রুয়ারি ইয়াহিয়া ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকেন। কিন্তু ১৫ ফেব্রুয়ারি ভুট্টো বলেন যে তিনি অধিবেশনে আসবেন না। তাঁর কথা হলো ছয় দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র হলে পাকিস্তান ভেঙে যাবে। আরও উদ্ভট কথা বলেন যে তিনি ঢাকায় এলে তাঁর দলের সদস্যদের মেরে ফেলা হতে পারে।
তখন দ্রুত কিছু ঘটনা ঘটতে থাকে। প্রতিনিয়ত পরিস্থিতি বদলে যায়। ২২ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া হঠাৎ মন্ত্রিপরিষদ বাতিল করেন। এর মধ্যে ভুট্টো বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে তা হবে ‘ডিক্টেটরশিপ অব দ্য মেজরিটি’—সংখ্যাগরিষ্ঠের একনায়কত্ব। ২৮ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু বলেন, গণতন্ত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলই সরকার গঠন করে। ভুট্টো সাহেবের ইচ্ছা পাকিস্তানে সংখ্যালঘুদের একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হোক, ডিক্টেটরশিপ অব দ্য মাইনরিটি। বাংলার মানুষ এটা মেনে নেবে না।
বঙ্গবন্ধু বলেন যে ছয় দফা কারও ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে না। কোনো সদস্য যদি যুক্তিসংগত দাবি করেন, তা গ্রহণ করা হবে। দেশের সর্বশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে তিনি মাওলানা ভাসানী, নুরুল আমিন, আতাউর রহমান খান, মোজাফ্ফর আহমদসহ অন্যান্য দলের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করেন।
৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন। এ জন্য প্রস্তুতি দরকার। তাই ১ মার্চ পূর্বাণী হোটেলে আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের বৈঠক হচ্ছিল। সে সময় আকাশ ভেঙে পড়ার মতো একটা খবর এল। রেডিওতে ঘোষণা হলো প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করেছেন।
ইয়াহিয়া সেদিন বুঝতে পারেননি যে তাঁর এ ঘোষণায় পূর্ব পাকিস্তানের ইতিহাস চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে। মূলত, এ ঘোষণার মধ্য দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের কবর রচিত হয়। শাসকশ্রেণির স্বৈরতান্ত্রিক আচরণে বাংলাদেশের মানুষ আগেই বিক্ষুব্ধ ছিল। ইয়াহিয়ার বেতার ভাষণে দলমত-নির্বিশেষে সবাই রাজপথে নেমে আসে।
সবার কণ্ঠে স্লোগান:
‘তোমার আমার ঠিকানা—পদ্মা মেঘনা যমুনা’
‘পিন্ডি না ঢাকা—ঢাকা ঢাকা’ ইত্যাদি।
পূর্বাণীর বৈঠক স্থগিত করেন বঙ্গবন্ধু। তিনি ছয় দিনের কর্মসূচি দেন। এর মধ্যে ২ মার্চ ঢাকায় পূর্ণ হরতাল। ৩ মার্চ সারা দেশে হরতাল। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে জনসভায় ভাষণ।
পূর্বাণীর চত্বর লোকে লোকারণ্য। সাধারণ মানুষ চরম উত্তেজিত। তারা পাকিস্তান লেখা সাইনবোর্ড ফেলে দিচ্ছে।
পূর্বাণী হোটেলের পাশে ‘পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনস’–এর সাইনবোর্ডের ওপরে লেখা হলো ‘বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনস’। গুলিস্তান চত্বরের ‘জিন্নাহ অ্যাভিনিউ’ হয়ে গেল ‘বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ’।
বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘২৩ বছর যাবৎ একই ষড়যন্ত্র করছেন, আর ষড়যন্ত্র করবেন না।’
পূর্ব বাংলায় আগুন জ্বলে ওঠে। সারা দেশে এক অভূতপূর্ব গণজাগরণের সৃষ্টি হয়। বাণিজ্য, যোগাযোগ, ব্যাংক, প্রশাসন, শিক্ষাসহ সব প্রশাসনিক ব্যবস্থা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে চলতে থাকে। প্রচণ্ড চাপে ইয়াহিয়া ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের সভা আহ্বান করেন। আবার আলোচনার প্রস্তাব দেন। এমন একটি পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে ভাষণের কথা বলেন।
৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু কী ঘোষণা দেন, তার জন্য সবাই রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছে। জনগণ এতটাই ক্ষুব্ধ যে স্বাধীনতার চেয়ে কম কিছু তারা আশা করছে না। একজন সাংবাদিক জানতে চান, বঙ্গবন্ধু একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন কি না। বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘অপেক্ষা করুন। জনগণ আমার সঙ্গে আছে। ভালোর আশা করছি, তবে মন্দের জন্যও প্রস্তুত আছি। কাল থেকেই কর্মসূচি চলবে।’
বঙ্গবন্ধু সারা জীবন আদর্শের রাজনীতি করেছেন। নীতির সঙ্গে কোনো দিন আপস করেনেনি। তাঁর কাছে গণতান্ত্রিক ও মানবিক চেতনাই ছিল প্রধান। ওই সময়ে আন্তর্জাতিক সংবাদে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের জন্য তাঁর প্রতি বিশ্বের ব্যাপক সমর্থন রয়েছে। অন্যদিকে ইয়াহিয়া খানকে জানিয়েছে ধিক্কার।
বঙ্গবন্ধুর দেশব্যাপী অসহযোগ আন্দোলনের ডাকের মাধ্যমে বাঙালি উন্মুখ হয়ে ওঠে স্বাধীনতার জন্য। তাদের দরকার একটি ঘোষণার, একটি আহ্বানের। এমনি একটি কঠিন বাস্তবতা সামনে রেখে এই জনপদের ইতিহাসের সবচেয়ে বিশাল জনসভায় বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চে ভাষণের কথা বলেন। ভোর থেকেই মানুষ জনসমুদ্রের মতো ছুটে আসে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। সবার চোখেমুখে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা। ঘনিয়ে আসে ৭ মার্চের বিকেল। ২টা ৪৫ মিনিটে বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ শুরু করেন। শেষ করেন ৩টা ৩ মিনিটে। বাঙালি জাতির ইতিহাসে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ একটি স্মরণীয় দিন। বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণে ছিল বাঙালির মুক্তির ডাক। স্বাধীনতার দিকনির্দেশনা।
মুক্তিকামী জাতি প্রস্তুত হয় চূড়ান্ত লড়াইয়ের জন্য। ইস্পাতকঠিন দৃঢ়তা বাঙালিকে নিয়ে যায় কাঙ্ক্ষিত মুক্তির লক্ষ্যে।
ওই ভাষণের নির্দেশনার পথ ধরেই নয় মাসের রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধে লাখো প্রাণের বিনিময়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে পৃথিবীর বুকে জন্ম নেয় নতুন একটি দেশ। শহীদের আত্মদান, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগ আর লাখো মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে বাঙালি অর্জন করে বাংলাদেশ নামের একটি মানচিত্র। আর এভাবেই সৃষ্টি হয়েছিল নদীবিধৌত এক জনপদে লাল-সবুজের গল্প।