দাদাভাইকে দাদির শাড়ি পরে দেখানো হলো না
গেটের বাইরে ফেরিওয়ালা হাঁক দিচ্ছে। পাশের বাড়ির সমবয়সী মেয়েরা চুড়ি কিনছে। মনের মধ্যে আমারও উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে ফেরিওয়ালার থেকে কাচের চুড়ি কেনার। কিন্তু বাড়িতে আম্মুর এক কথা, অন্যের কিছু দেখে বায়না করে পচা বাচ্চারা। কিন্তু ফেরিওয়ালাকে ডাকার ইচ্ছাকে দমাতেও পারছি না। তখন ভরসা আর আবদারের একমাত্র জায়গা দাদাভাই। গিয়ে বলতেই ফেরিওয়ালাকে ডেকে বসিয়ে শখের চুড়ি কিনে দিলেন।
আমার দাদাভাই হবিগঞ্জের জজ কোর্টের আইনজীবী ও ভাষাসৈনিক শওকত আলী খান। আমাদের দুই বোনের দৈনন্দিন রুটিন ছিল দাদাভাইকে ঘিরে। ভোরে ঘুম থেকে ওঠা থেকে রাতে ঘুমোতে যাওয়া—সবই দাদাভাইয়ের নিয়মে। সকালে স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি হওয়ার আগেই দাদাভাই মোটরসাইকেল নিয়ে তৈরি স্কুলে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। স্কুলে টিফিন পিরিয়ডে দাদাভাই হাজির টিফিন নিয়ে। স্কুল ছুটির সঙ্গে সঙ্গে স্কুলের গেটে দাঁড়িয়ে কিংবা স্যারদের সঙ্গে কথা বলায় সত্তরোর্ধ্ব যে ভদ্রলোক নিয়ম করে আমাদের অপেক্ষায় থাকেন, তিনি আমার দাদাভাই। ভাষাসংগ্রামী শওকত আলী খান।
সারা জীবন পার করেছেন কঠোর সময়ানুবর্তী হয়ে। ঘড়ির কাঁটায় নিয়ম বেঁধে খাওয়া, ঘুম—সবকিছুই। সময়ের পাঁচ মিনিট হেরফের হয়েছে, তো খাওয়াই বাদ। ঘড়ির কাঁটায় ২টা বেজে ৫মিনিট হয়ে গেলে ওই দিন আর খাওয়ার টেবিলে বসেনই না। যখন থেকে শারীরিক অসুস্থতার জন্য আর মোটরসাইকেল চালাতে পারছেন না, নাতনিদের মোটরসাইকেলের পেছনে বসিয়ে স্কুল থেকে নিয়ে আসতে পারছেন না; তখন ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে তাল মিলিয়ে খাবার টেবিলে বসা বাদ দিয়ে নাতনিদের স্কুল থেকে ফেরার অপেক্ষায় হয়তো রিকশা নিয়ে ছুটে গেছেন স্কুলের দিকে কিংবা সমানে ফোনকলে শিক্ষকদের থেকে আপডেট নিচ্ছেন।
আমার বর্ণপরিচয় শেখাই হতো না যদি না দাদাভাই ঘণ্টার পর ঘণ্টা জেদি একগুঁয়ে আমাকে ধৈর্য নিয়ে না শেখাতেন। ঠিক তেমনিভাবে ক্লাস ফাইভের বৃত্তি পরীক্ষার জন্য যেখানে অন্যান্য শিক্ষার্থীর মা–বাবা প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করেছেন, সেখানে পুরো প্রস্তুতিই আমার থেকেও বেশি নিয়েছেন দাদাভাই।
আমার এখনো মনে পড়ে, মাধ্যমিক পর্যন্ত কোনো দিন একটা খাতা–কলমও আব্বুকে দিয়ে আনাতে হয়নি। কখন কোনো জিনিসটা প্রয়োজন সব সময় আব্বু-আম্মুর চেয়েও সজাগ দৃষ্টি ছিলই দাদাভাইয়ের।
পেশাগত জীবনে দাদাভাই বহুবিধ পেশায় অভিজ্ঞতা অর্জনের পর থিতু হয়েছিলেন আইন পেশায়। আমি আর আমার বড় বোন দাদাভাইয়ের কোর্ট থেকে ফেরার সময় কান পেতে থাকতাম মোটরবাইকের সেই পরিচিত আওয়াজের। কারণ, মোটরবাইকের হ্যান্ডেলে ঝুলতো চকলেট, বেলুন, পুতুল। আসরের নামাজের পর দাদাভাই দুই হাতের তালুতে আমাদের দুই বোনকে ধরে হেঁটে বেড়াতেন বাড়ির রাস্তা ধরে। রাতে হয়তো দাদাভাইয়ের সঙ্গে ‘সিন্দাবাদ’ দেখতে দেখতে না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়তাম। তখন দাদাভাই ঘুম থেকে উঠিয়ে খাওয়াতেন, মশারি টাঙিয়ে দিতেন।
আমার সাঁতার শেখার, ক্রিকেট খেলা কিংবা ব্যাডমিন্টন শেখানোর গুরুর দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছেন দাদাভাই।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে দাদাভাই সক্রিয় অংশগ্রহণের করেন। পরবর্তী সময়ে হবিগঞ্জের জজ কোর্টের আইনজীবী। এবারের একুশে ফেব্রুয়ারিতে নবীগঞ্জ পৌরসভা থেকে সংবর্ধনার আয়োজন করা হলে শারীরিক অসুস্থতার জন্য যেতে পারলেন না। পাঠিয়ে দিলেন আমাকে। ওইখানে দাদাভাইকে নিয়ে বলতে গিয়ে গর্ব হচ্ছিল। এরই ঠিক ছয় মাস পর হলো বড়সড় রকমের স্ট্রোক। হারালেন বাক্শক্তি। তবু ইশারা–ইঙ্গিতে বারবার জিজ্ঞেস করতেন খেয়েছি কি না, কলেজ হোস্টেলে কবে ফিরে যাব! ধীরে ধীরে অবস্থা যখন খারাপের দিকে, তখন দাদাভাইয়ের সার্বক্ষণিক সঙ্গী হলাম আমি।
অন্য নাতি-নাতনিরা তখন বিভিন্ন কাজে বাড়ির বাইরে। পাহাড়ের মতো দৃঢ় মানুষটার গুটিয়ে যাওয়া মেনে নিতে খুব কষ্ট হতো। আমার জীবনে দাদাভাইয়ের ঋণ কখনো শোধ করতে পারব না। তাও দাদাভাইয়ের মতো না হোক, সময়মতো খাইয়ে দেওয়া, ওষুধ খাইয়ে দেওয়া, হাত ধরে বাড়িময় হাঁটানো, সারা রাত নির্ঘুম দাদাভাইয়ের সঙ্গে রাতভর জেগে থাকা—ওসবে কিছুটা স্বস্তি মিলত। মনে আর তো কটা দিন এরপরেই আগের মতো শুনতে পাব, ‘দাদা, আবার কলেজ কবে খুলবে কিংবা আজ হোস্টেল ফিরে গিয়ে কাজ নেই বাড়িতেই থাকো, তোমরা না থাকলে বাড়ি খালি খালি লাগে।’
কিন্তু না, অবস্থার আরও অবনতি হলো। দাদাভাইকে ভর্তি করানো হলো হাসপাতালে। আমি আর সারা রাত ঘুমোতে পারি না। সারাক্ষণ মনে হয় দাদাভাই ডাকছেন। আমার স্বাভাবিক জীবনে নেমে এল অস্বাভাবিকতা। রাতভর দাদাভাইয়ের আওয়াজ শুনতে থাকি আমি।
হঠাৎ একদিন হাসপাতাল থেকে খবর এল দাদাভাইয়ের জন্য রক্ত দরকার। কিন্তু রক্তের গ্রুপ আমার সঙ্গে মিলল না। সারা জীবনের আক্ষেপ রক্তের ঋণ শোধ করতে পারলাম না।
স্বাভাবিক জীবনে ফেরার চেষ্টায় ১৬ নভেম্বর দাদাভাইয়ের আলমারি থেকে দাদির শাড়ি পরে ছবি তুললাম পরদিন হাসপাতালে দাদাভাইকে দেখাতে যাব বলে। খুব তাড়াতাড়ি রাতে ঘুমিয়ে গেলাম ভোরবেলাই দাদাভাইকে দেখতে হাসপাতালে যাব বলে। পরিকল্পনামাফিক রওনা দিলাম। হাসপাতালের মাত্র কয়েক ফুট দূরত্বে আছি। সঙ্গে দাদাভাইয়ের জন্য পায়েস আর সেমাই। হঠাৎ আব্বুর কল। দাদাভাই আর নেই। দাদাভাইকে আর দাদির শাড়ি পরে দেখানো হলো না।
লেখক : আবৃত্তি প্রশিক্ষক, জেলা শিল্পকলা একাডেমি, হবিগঞ্জ