সাতসকালে সুনসান চন্দ্রনাথ পাহাড়ের পাদদেশ। দর্শনার্থী নেই বললেই চলে। পুণ্যার্থীদের পদচারণও প্রাণ পায়নি। পূজার পসরা সাজিয়ে বসা দোকানি খদ্দরের অপেক্ষায় উদ্গ্রীব। তার পেছনে রেলিংয়ের ওপাশে অক্ষয় বট। বিড়বিড়িয়ে মন্ত্র আওড়ে যাচ্ছেন এক বৃদ্ধা। পাশেই সুবিশাল ব্যাসকুণ্ড।
পৌরাণিক আখ্যানে, মহামুনি ব্যাসদেব এখানে অশ্বমেধ যজ্ঞ করেছিলেন বলে ‘ব্যাসকুণ্ড’ নাম। আর ব্যাসদেব যে বৃক্ষের নিচে ধ্যান করতেন, সেটাই অক্ষয় বট। শিব চতুর্দশীতে স্বয়ম্ভূনাথ দর্শনের আগে ব্যাসকুণ্ডে স্নান সারার প্রথা অনেক প্রাচীন। এর পাড়জুড়ে শুধু মন্দির আকৃতির সমাধি আর সমাধি।
ব্যাসকুণ্ডের উল্টোদিকে শংকর মঠ। ওপাশে কেন্দ্রীয় মহাশ্মশান, তার উল্টোদিকে সবুজ মাঠের ওপাশের শ্মশানটাও খাঁ খাঁ। আজ কোনো শব আসেনি এখনো।
অনতি দূরেই পাহাড়ের চড়াই। গোড়া ঘেঁষে এক পাহাড়ি ছড়া। দূরে কোথাও থেকে আসছে ঝরনা চুয়ানো জলের তিরতিরে একটা প্রবাহ। আর একটা প্রবাহ ডান থেকে এসে মিশেছে মূল প্রবাহে। জল গড়ানোর মৃদু শব্দে, আহা! কি শান্তি! কাঁকরের ওপরে গড়িয়ে চলা জলের ছন্দে মগ্ন হয়ে আছে পাহাড়ি প্রকৃতি।
ছড়ার ওপরের সেতু পেরিয়ে শুরু হলো পাহাড় বাওয়া। পিচঢালা সরু রাস্তা নাক বরাবর ক্রমে ওপরে উঠেছে। চড়াইয়ের মাথায় পাহাড়ের একটা সমতল ঘাড়। একপাশে হনুমান মন্দির। পরিত্যক্ত। আগাছায় ছাওয়া। উল্টো দিকে সিঁড়ি বেয়ে পাহাড়ের কোলে কিছুটা নামলে সীতা মন্দির, সীতার কুণ্ড। কুলকুলিয়ে বয়ে চলা শীতল এক পাহাড়ি ছড়ার পাশে কুণ্ডটা বাঁধিয়ে রাখা হয়েছে। এই কুণ্ড থেকেই সীতাকুণ্ড নামের জন্ম বলে জনশ্রুতি আছে।
‘দেশে বিদেশে নাথ তীর্থ, মঠ ও মন্দির’ গ্রন্থে প্রফুল্ল কুমার দেবনাথ লিখেছেন, সপ্তদশ শতাব্দীতে রাজা চন্দ্রেশ্বর নাথের রূপবতী কন্যা কৈবল্যা সতীত্ব রক্ষায় জ্বলন্ত কুণ্ডে আত্মাহুতি দেন। প্রজারা তাঁকে ডাকত সীতা। তাঁর নামে কুণ্ডটির নাম হয় সীতাকুণ্ড। কালক্রমে এলাকার নামই হয়ে যায় সীতাকুণ্ড।
কিন্তু পাহাড়ের ওপর হনুমান মন্দির আর ছোট্ট উপত্যকায় পাশাপাশি তিনটি কুণ্ড অন্য উপাখ্যান স্মরণ করিয়ে দেয়। সেই উপাখ্যানে বনবাসকালে রামায়ণের রাম-সীতা ও লক্ষ্মণ এসেছিলেন এখানে। এই কুণ্ডটি সেই সীতার নামে। অনতিদূরে রাম আর লক্ষ্মণের নামেও কুণ্ড আছে। তাই রামায়ণের সীতার নামেই সীতাকুণ্ড নাম।
তবে আরেক উপাখ্যানে সীতা নন, সীতাকুণ্ড নামকরণের কারণ সতী। তার দেহাংশ যেখানটাতে পড়ে সেখানে এখন ভবানী মন্দির। শ্যামা সংগীতের আসর বসেছে সেখানে। পাশেই জ্যোতির্ময় শিবের সামনে প্রার্থনারত এক নববধূ।
একটু ওপরের দিকে স্বয়ম্ভূ নাথ মন্দির। তার উত্তরে অন্নপূর্ণা ও বিষ্ণু মন্দির। খানিক দূরে জগন্নাথ মন্দিরও আছে।
ইকো সিস্টেমের বারোটা বাজিয়ে পাহাড়ের ওপর বসানো পাকা রাস্তাটা ধরে আরও খানিক উঠতেই চন্দ্রনাথের একদিকের চূড়া দেখা গেল। খাড়া খাড়া শৈলশিরায় যেন সারি সারি মন্দিরের আকার। চূড়ার চন্দ্রনাথ মন্দিরকে খেলনা ঘরের মতো ছোট্ট দেখাচ্ছে। একরাশ মেঘ এসে চূড়াটাকে ঢেকে দিল হঠাৎ।
সামনে একটা সিঁড়ি। পাহাড়ের গায়ে ফুট দশেক উঁচু থেকে গড়িয়ে পড়ছে জলধারা। অবিরাম জলের পতন অগভীর এক জলাধার তৈরি করেছে পাহাড়ের ঘাড়ে। দুপাশ থেকে বাঁশের ডগা ঝুঁকে এসে যেন কুর্নিশ করছে ঝরনাটাকে।
পাশে এক টংদোকান। পাহাড়েরই বাঁশ আর কাঠের বেঞ্চ পাতা। ছোট্ট লম্বাটে বরই আকৃতির একটা ফলে চোখ আটকাল। এটাকে এরা বলছে সীতার সুপারি। বনবাসকালে এ পাহাড়ে এলে সীতা এই সুপারি খেতেন বলে বিশ্বাস প্রচলিত। এই সুপারির ভেতরটা সাধারণ সুপারির চেয়ে অনেক নরম। পান ছাড়াই খাওয়া যাচ্ছে।
সামনে ঝরনার ওপর দিয়ে রাস্তাটা ডানে বেঁকেছে। বাঁয়ে কিছুটা নেমে ফের পাহাড়ের গায়ে পেঁচিয়ে উঠে গেছে সরু ট্রেইল। ওই ট্রেইলে পথ বেশি। কিন্তু কষ্ট তুলনামূলক কম। মাটির ট্রেইল একটু উঠে ফের সমতলে এগিয়েছে। ফের উঠেছে একটু। তাই তীর্থযাত্রী ও দর্শনার্থীরা এখান থেকে ওই পথ দিয়েই উঠে থাকেন। মন্দির দর্শন শেষে নামেন ডানের সিঁড়ি পথে।
ট্রেইলটার কোথাও এক পাশে খাদ। কোথাও-বা দুপাশেই। কোথাও এক পাশে খাড়া দেয়াল। কোথাও-বা গিরিখাদের মতো দুপাশ থেকে পাহাড় চেপে এসেছে সিঁড়ির ওপরে।
পাহাড়ের গায়ে পাহাড়ি গাছগাছালি। ভাঁজে ভাঁজে মানুষ রোপিত বৃক্ষের দাপট।
একটা প্রশস্ত পাহাড়ি তাকে এসে চোখের সামনে ঝুলে রইল সবুজ উপত্যকা। আয়েশে ভেসে চলা মেঘের ভেলাগুলো সবুজ পাহাড়ের মাথায় অদ্ভুত এক রোদ-ছায়ার খেলা জমিয়েছে। মেঘের ছায়ায় সবুজের চাদর এই কালচে সবুজ, তো ফের রোদ পড়তেই উজ্জ্বল। চোখের সামনে প্রকৃতির কি অদ্ভুত খেলা। ওপাশে গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে সীতাকুণ্ড শহর। তার ওপাশে বঙ্গোপসাগর। আরও দূরে কালচে সবুজ রেখার মতো শুয়ে আছে সন্দ্বীপ। মেঘ-পাহাড়, সাগরের এমন মিতালি আর কোথায়ই-বা মিলবে?
এমন অনিন্দ্যসুন্দর প্রকৃতির রূপ গভীর দাগ কেটেছে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সৃজনশীল চেতনায়ও। সীতাকুণ্ডের পাহাড়, সমুদ্র ও ঝরনার সমন্বয়ে সৃজিত অপরূপ সৌন্দর্য অবলোকন করে মুগ্ধ নজরুল রচনা করেছিলেন সেই বিখ্যাত গান-
‘আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ওই।’
প্রতিবছর ফাল্গুন মাসে শিবরাত্রি বা শিব চতুর্দশীতে মেলা বসে চন্দ্রনাথ পাহাড়ে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে লাখো মানুষের সমাগম ঘটে তখন।
কিছু সিঁড়ি ডিঙানোর পর হয়তো কয়েক ফুট সমতল পথ। তারপর ফের খাড়া সিঁড়ি। শীতল আবহাওয়াতেও দরদরদিয়ে ঘাম ছুটছে। বুক ফুলে উঠছে হাঁপরের মতো।
সামনে একটা ঝরনা পেয়ে শীতল জলের পরশ মাখার লোভটা আর সামলানো গেল না। কিন্তু এ কি! কোত্থেকে একটা কেউটে ছুটে এল হঠাৎ। ছায়ায় ঝিমাতে থাকা একটা ব্যাঙকে ঘিরে ফণা তুলল। বড় আকারের ব্যাঙটাকে ঘিরে কয়েকটা চক্কর দিল। তারপর ফের ফণা তুলল। মেটে ব্যাঙটা চোখ খুলে একটু দেখল কি দেখল না। তাকে গিলে ফেলার মতো বড় নয় সাপটা। তাই পাত্তা দিল না। চোখ বুঁজে ঝিমোতে লাগল ফের। আর কিছুক্ষণ ফোঁসফাঁস করে রণে ক্ষান্ত দিল কেউটে।
আরও কিছু দূর সমতলে এগিয়ে আরও খাড়া হয়ে উঠল পথটা। বিরূপাক্ষ চত্বরে উঠে আর এক দফা জিরোতে বসতে হলো।
বিরূপ নেত্র হেতু শিবের আর এক নাম বিরূপাক্ষ। বিরূপাক্ষ নামে এক নাথগুরুরও সন্ধান মেলে। ‘নাথ সম্প্রদায়ের ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থে উপেন্দ্র কুমার দেবনাথ লিখেছেন, বিরূপাক্ষ নাথ একজন মহাসিদ্ধা, সর্বসিদ্ধিদাতা। তাঁর জন্ম ত্রিপুরায়। তিনি বাঙালি।
আরে, ওটা কী? গাছের ডালে একটা সাপ! সদ্য খোলস ছেড়ে দুর্বল। এতগুলো মানুষের উপস্থিতিতেও খুব একটা নড়তে পারছে না। এখান থেকে চন্দ্রনাথ চূড়াটাকে খুবই কাছে বলে মনে হলো। কিন্তু একটা ঘাসবন পেরোনোর পর খাঁড়া খাদের পাশে ঝুলে আরও খাঁড়া পাহাড় বাওয়ার হ্যাপাটা টের পাওয়া গেল। সমতল যে চত্বরটার ওপাশ থেকে পাতালপুরীর পথটা নেমেছে, সেখানে বসেই পড়তে হলো বাধ্য হয়ে।
উল্টোদিকের মেটে পথটা বাইতেই চন্দ্রনাথ মন্দির চত্বর। সিঁড়ির পাশের বুকসমান উঁচু জংলায় অসংখ্য মাকড়সার জাল। জল জমে রুপালি হয়ে ওঠা মুখে হাসছে যেন। গাছের ডালে মানত করে বাঁধা কাপড়, সুতো। কেউ কেউ সুতো না পেয়ে চিপসের প্যাকেট বা পলিথিন ছিঁড়ে বেঁধে রেখে গেছে। চন্দ্রনাথের কাছে কত জনের যে কত চাওয়া!
চূড়াটা অনেকটাই সমতল। মাঝখানে মন্দির। মেঝের ঠিক মাঝখানে কষ্টি পাথরের চকচকে শিবলিঙ্গ।
বিষাক্ত বিছার কামড়ে প্রধান পুরোহিতকে চিকিৎসার জন্য পাহাড় থেকে নামতে হয়েছে কদিন হলো। তার ছেলে সুজন ভট্টাচার্য দিনের পূজা শেষ করে সবে বিশ্রামে গেছেন। অনুরোধে ঢেঁকি গিলে বেরিয়ে এলেন ফের। সুদর্শন চেহারার নিপাট ভদ্রলোক। চন্দ্রনাথের বর্ণিল উৎসব আর মানুষের মেলার গল্প শুরু করলেন।
‘দেশে বিদেশে নাথ তীর্থ, মঠ ও মন্দির’ গ্রন্থে প্রফুল্ল কুমার দেবনাথ লিখেছেন, চন্দ্রনাথ শৈব তীর্থ। সপ্তদশ শতাব্দীতে সীতাকুণ্ড ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকার রাজা ছিলেন চন্দ্রেশ্বর নাথ। তার নামে এই পাহাড়ের নাম হয় চন্দ্রনাথ। এখানে চন্দ্রেশ্বর নাথের কুলদেবতা শিব প্রতিষ্ঠিত। তাই পাহাড়ের নামে এই মন্দিরের নাম হয় চন্দ্রনাথ শিব।
তবে কৈলাস চন্দ্র সিংহের রাজমালায় বলা হয়েছে, চন্দ্রনাথের শিবমন্দির ত্রিপুরার মহারাজা গোবিন্দ মানিক্যের প্রধান কীর্তি।
এই গোবিন্দ মানিক্যও কিন্তু সপ্তদশ শতকেরই রাজা। তাহলে কি এই চন্দ্রনাথ ওই শতকেরই মন্দির, নাকি আরও প্রাচীনকালের? চন্দ্রেশ্বর নাথের নামে চন্দ্রনাথ, নাকি চন্দ্রনাথ থেকেই চন্দ্রেশ্বর নাথ?
রাজমালাতেই বলা আছে, ১৫০১ খ্রিষ্টাব্দে চন্দ্রনাথ পাহাড় থেকে কালীমূর্তি নিয়ে উদয়পুরের ত্রিপুরেশ্বরী মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত করেন ত্রিপুরার রাজা ধন্য মাণিক্য।
প্রাচীন ত্রিপুরাপতিদের চন্দ্রবংশজ উল্লেখ করে রাজমালাতে আরও বলা হয়েছে, চন্দ্রনাথ তাদেরই অক্ষয় কীর্তি।
আবার নবম থেকে একাদশ শতাব্দীর মধ্যে বাঙ্গালা শাসনকারী চন্দ্রবংশের সঙ্গে এই চন্দ্রনাথের সম্পর্ক থাকার সম্ভাবনাও প্রবল। ‘পাল-সেন যুগের বংশানুচরিত’ গ্রন্থে দীনেশচন্দ্র সরকার লিখেছেন, এই রাজবংশের শেষ রাজা গোবিন্দ চন্দ্র ছিলেন শৈব।
সে সময়ের বিভিন্ন তাম্রশাসনের পাঠ বিশ্লেষণ করে ‘পূর্ববঙ্গের চন্দ্র রাজবংশ’ শীর্ষক প্রবন্ধে আহমদ হাসান দানী লিখেছেন, ‘চন্দ্রদের রাজত্বকালে বঙ্গ ও সমতটে পাল রাজারা প্রবেশ করতে সক্ষম হননি।’
এমন দোর্দণ্ড প্রতাপশালী রাজবংশের সঙ্গে চন্দ্রনাথের সম্পর্ক থাকতেই পারে। তবে জনশ্রুতি বলছে, নেপালের একজন রাজা স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে ভারতবর্ষের পাঁচ কোণে পাঁচটি শিবমন্দির নির্মাণ করেন। এগুলোর অন্যতম হলো এই চন্দ্রনাথ মন্দির।
এই মন্দিরের চূড়ার আকৃতিটা মুঘল আমলের গম্বুজের মতো। দরজা আর খিলানও তাই। মুঘল আমলে এ পাহাড়ের অনেক মন্দির সংস্কার করা হয় বলে বলা আছে সীতাকুণ্ড উপজেলা তথ্য বাতায়নে। বর্তমান মন্দিরটি টাইলসে মুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ফি বছর কেমন বদলে যাচ্ছে চন্দ্রনাথের পাহাড় ও প্রকৃতি।
প্রতিবছর ফাল্গুন মাসে শিবরাত্রি বা শিব চতুর্দশীতে মেলা বসে চন্দ্রনাথ পাহাড়ে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে লাখো মানুষের সমাগম ঘটে তখন।
জাকারিয়া মণ্ডল: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক