শরদিন্দু বেঁচে আছেন বাঙালি পাঠক হৃদয়ে
বিংশ শতাব্দীতে বাংলা সাহিত্যের আকাশ আলোকিত হয়েছে অসংখ্য নক্ষত্রের আলোয়—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কিংবা কাজী নজরুল ইসলাম ছাড়াও বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়সহ আরও অনেকের সাহিত্যচর্চা বাংলার সাহিত্যভান্ডারকে দিয়েছে অমৃত সমৃদ্ধি। সমসাময়িক সময়ে বাংলা সাহিত্যজগতে আরও একজন মানুষ নিজ স্বকীয়তায় অনন্য হয়ে উঠেছিলেন, তিনি শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের জগতে গোয়েন্দাসাহিত্য জনপ্রিয় হয়েছে তাঁরই বিখ্যাত সৃষ্টি ব্যোমকেশ বক্সীর হাত ধরে। শরদিন্দু নিজেই বলেছেন, ব্যোমকেশ শরদিন্দুর ‘সেলফ-প্রজেকশন’ বা আত্মকৃতি। শাণিত মস্তিষ্ক ও মানবিক বোধসম্পন্ন এই সুপার হিরো তাঁকে দিয়েছিল আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা।
শরদিন্দু অর্থ শরৎকালের চাঁদ, যে চাঁদ বর্ষার মেঘ কেটে গেলে আকাশে আপন ঔজ্জ্বল্যে দীপ্তিমান হয়। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ও ছিলেন তেমনই একজন। ১৮৯৯ সালের ৩০ মার্চ ভারতের উত্তর প্রদেশের জৌনপুর শহরে মামাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা তারাভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন মুঙ্গেরে ডাকসাইটে উকিল। ছোটবেলা থেকেই বাবা চাইতেন ছেলে আইন পেশায় যুক্ত হয়ে জীবন গড়ুক। কিন্তু বাড়িতে ছিল আলমারিঠাসা বই। সে সময়ের সব বিখ্যাত সাহিত্যপত্রিকা নিয়মিত আসত বাড়িতে, তাই সাহিত্যের সঙ্গে তাঁর সখ্য শুরু হয় বেশ ছেলেবেলায়। প্রথম মুগ্ধতা এল রমেশচন্দ্র দত্ত পড়ে, কৈশোর পেরোতেই বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর মনজুড়ে বসলেন। একটু একটু করে মাথায় চাপল গল্প লেখার ভূত, লিখতে লিখতে হয়ে গেল রীতিমতো এক উপন্যাস, বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও ছাপাতে পারলেন না সে লেখা। সেই উপন্যাস ‘দাদার কীর্তি’ দেরাজেই বন্দী হয়ে পড়ে রইল।
বাবার চাপাচাপিতে আইন নিয়ে পড়তেই হলো শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়কে। পাটনা থেকে ওকালতি পাস করে বাবার সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করলেন, এ সময়েই বসুমতীতে প্রকাশিত হলো তাঁর প্রথম গল্প ‘উড়ো মেঘ’, কিছুদিন যেতেই বুঝলেন আইন পেশা তাঁর জন্য নয়। ১৯২৯ সালে ওকালতি থেকে হাত গুটিয়ে নিলেন।
১৯৩২ সালে আবির্ভূত হলো ব্যোমকেশ। একই বছর বসুমতীতে ছাপা হলো তিনটি গল্প, ‘পথের কাঁটা’, ‘সীমান্ত হীরা’, ‘সত্যান্বেষী’। দেখা গেল, গল্প বলিয়ে হিসেবে শরদিন্দুর সম্মোহনী শক্তি এতটাই দুর্নিবার যে ব্যোমকেশ সিগারেট ধরালেও তার গন্ধটা আপনি পাবেন। মনে হবে যেন ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকেই যেন পুরো বিষয়টা নিজের চোখে দেখছেন। এভাবেই শরদিন্দুর হাত ধরেই গোয়েন্দাসাহিত্য বাংলা সাহিত্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। আর্থার কোনান ডয়েল, এডগার অ্যালান পো, আগাথা ক্রিস্টির মতো বিদেশি লেখকদের লেখার পাশে দেশীয় গোয়েন্দাসাহিত্যকে একটা মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেন, যা আজকের দিনের পাঠককেও রোমাঞ্চিত করে, অনুরণন দেয়।
প্রাচীন ভারতের ইতিহাসকে আশ্রয় করেও শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন বেশ কিছু উপন্যাস। মগধ, পাটলীপুত্র, বৈশালী, রাজপুতানা কিংবা বিজয়নগর সাম্রাজ্যের ইতিহাস জীবন্ত হয়ে উঠেছে তাঁর সৃষ্টিতে। বিলুপ্ত বিজয়নগর সাম্রাজ্যের ইতিহাসকে আশ্রয় করে লেখা তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘তুঙ্গভদ্রার তীরে’ পড়তে গেলে আপনি নিজেকে সেই সমসাময়িক সময়ে আবিষ্কার করবেন এবং এতটাই সম্মোহিত হবেন যে শেষ না করে উঠতে পারবেন না। নিজের ঐতিহাসিক সাহিত্য নিয়ে বলতে গিয়ে শরদিন্দু বলেছেন, ‘আমার লেখা Fictional History নয় বরং Historical Fiction.’ সত্যিকারের ইতিহাস ও স্থানকে অবলম্বন করেই ডানা মেলেছে তাঁর ঐতিহাসিক গল্পগুলো।
কেবল ‘তুঙ্গভদ্রার তীরে’ নয়, ‘কালের মন্দিরা’, ‘গৌড়মল্লার’, ‘বিষকন্যা’, ‘মৃৎপ্রদীপ’, ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘ’, ‘কুমারসম্ভবের কবি’, ‘শিবাজী’ আর ‘সদাশিব’—প্রতিটি ঐতিহাসিক উপন্যাস শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়কে দিয়েছে অমরত্ব। ১৯৫০ সালের জন্মদিনে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের মনে প্রশ্ন জেগেছিল আরও ৫০ বছর পরে পাঠক তাঁকে মনে রাখবে কি না। লিখেছিলেন, ‘আমার চিন্তা ও স্বপ্নের বীজ যদি বাঙালীর সারবান মনের ক্ষেত্রে পড়িয়া থাকে, তবে আমার নাম সকলে ভুলিয়া গেলেও আমার বাঁচিয়া থাকা নিরর্থক নয়।’
১৯৫০ সালের পর (১৯৫০ সালের ২২ সেপ্টেম্বর মৃত্যু) কেবল ৫০ নয়, আজ ৭১ বছর পর ৩০ মার্চে তাঁর জন্মদিনেও আমরা তাঁকে শ্রদ্ধাভরে মনে রেখেছি। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় বাঙালি পাঠকের মনে বিনম্র শ্রদ্ধায় বেঁচে রইবেন অনন্তকাল।
লেখক: জুনায়েদ শুভ্র, গবেষক ও পর্যটক