কিসের নেশায় আমরা এত শহরকেন্দ্রিক

ফাইল ছবি

বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকেও গ্রামগুলো ঠিক ততটা উন্নত ছিল না। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতিতে পুরোপুরি শহরের ওপর নির্ভরশীল ছিলাম। একটা ভালো পোশাক কিনতে, শিক্ষা, সুচিকিৎসা এমনকি ব্যবসায়িক কাজেও শহরের বিকল্প ছিল না বললেই চলে। কিন্তু এই একবিংশ শতাব্দীর দুই যুগ পেরিয়েও কি এর পরিবর্তন হয়নি? একটা সময় ছিল, দৈনন্দিন বাজার করতে হেঁটে যেতে হতো মাইলের পর মাইল! সারা দেশের যোগাযোগব্যবস্থা অর্থাৎ যানবাহন আর রাস্তাঘাট যা–ই বলুন, কোনোটাই সন্তোষজনক ছিল না।

কালক্রমে দুম করেই যেন আমূল পরিবর্তন হয়ে গেল সবকিছুর! বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকেও গ্রামবাংলা বলতে যে ছবি চোখে ভাসত, তা হলো—গ্রামজুড়ে অন্তত প্রতিটি বাড়িতে একটি বাইসাইকেল, জমি চাষাবাদের জন্য নিদেনপক্ষে একজোড়া হালের গরু বা মহিষ, এ ছাড়া জনগণসহ পণ্যসামগ্রী স্থানান্তরিত করতে গরু বা মহিষের গাড়ির প্রতি নির্ভরশীলতার সংখ্যা একেবারেই কম নয়। কমসংখ্যক মানুষেরই মোটর বাইক ছিল। পুরো গ্রামে একটি বা দুটি রাখাল দল বেঁধে বাঁশিতে সুর তুলে, গবাদিপশুর সঙ্গে নিখাদ সখ্যও যেন চোখে পড়ার মতো ছিল! তখনও প্রতিটি গ্রামে বিদ্যুৎ নিশ্চিত করতে পারেনি সরকার। কালেভদ্রে দু-একটি রঙিন টেলিভিশন চোখে পড়ত। আকাশ সংস্কৃতির বিষয়টি ছিল কেবল শহুরে সভ্যতার অংশবিশেষ। অর্থনৈতিক অভাবের মধ্যেও গ্রামের ছেলেমেয়েদের হইচই করে বেড়ান ছিল নিত্যঘটনা! দল বেঁধে ধুলো উড়িয়ে স্কুলে যাওয়া, গাঁয়ের মেঠোপথ ধরে শস্যখেতের মধ্যে প্রকৃতির সঙ্গে মিশে যেতে পারা কিংবা বিকেলে স্কুলের মাঠে হরেকরকম আনন্দ—এসবই যেন গ্রামীণ চিত্র! অনেকে আবার চানাচুর মাখানো ঝালমুড়ি, নাড়ু, ঘিয়ে ভাজা সনপাঁপড়ি, পাঁপড় ভাজা ইত্যাদি খাবার আনন্দে বাবার সঙ্গে বাইসাইকেলের লোহার রডে চেপে গাঁয়ের ভাঙা রাস্তা পেরিয়ে হাটে যেত!

রাতের রাজধানী
ছবি: মোহাম্মদ রায়হান

কত সহজেই কেরোসিনের উটকো গন্ধ আর হারিকেনের আলোয় নিজেকে মানিয়ে নিত তখনকার শিশুরা! সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গেই টিউবওয়েল কিংবা কুয়োর পানিতে হাত-মুখ ধুয়ে নিয়মিত পড়াশোনায় মনোনিবেশ করাটা বাধ্যতামূলক ছিল প্রতিটা ছাত্রের জন্য। ১০টা বাজার আগেই রাতের খাবার খেয়ে প্রায় ঘুমিয়ে পড়ত সবাই। মশা-মাছির উপদ্রব আর ৪০ ডিগ্রির ওপরের তাপমাত্রাকে তোয়াক্কা না করেই কী প্রশান্তির ঘুম হতো তাদের। রোজকার মতো সুবেহ সাদিকেই আবারও ঘুম ভেঙে আপন আপন পাঠে মনোনিবেশ চলত। তখনো প্রায় অন্ধকারাচ্ছন্ন ভোর! উদীয়মান সূর্যের সাক্ষী সেই কৃষক সমাজ তখন লাঙল জোয়াল কাঁধে নিয়ে ছুটে যেত দূর দিগন্তে। ফসল ফলিয়ে দেশকে বাঁচানোই ছিল তাঁদের দৃঢ় প্রত্যয়! সীমিত সম্পদ আর সীমাহীন অভাবকে সঙ্গে নিয়েও প্রায় প্রতিটা পরিবারেই জনসংখ্যার আধিক্যের কথা মনে পড়লে বর্তমানে অবাক লাগে! মজার ব্যাপার, কোনো না কোনোভাবে পুরো পরিবারের ভরণপোষণের ব্যবস্থাটা ঠিক হয়েই যেত!

বড় ভাই বা বোনের কাপড় পরে ছোট ভাই বা বোনেরা বেড়ে উঠবে—যেন এটিই ছিল একটি অলিখিত নিয়ম। তখনকার পরিবারের সদস্যরা একটি ছোট ডিমকে দুই ভাগ করে খেত! পুরো সপ্তাহে প্রায় নিরামিষনির্ভর মানুষের আত্মাগুলো একটি স্বাদযুক্ত খাবারের অপেক্ষায় থাকত। কালেভদ্রে তাঁরা আমিষের সন্ধান পেত। গ্রাম্য সমাজে রেফ্রিজারেটরের প্রচলন ছিল না বললেই চলে। তাই মাছ, মাংস জমিয়ে রাখার কোনো উপায়ও ছিল না। গ্রামপর্যায়ে নিয়মিত বাজারের প্রচলন না থাকায় অতিথি এলে বাপ-বেটা মিলে শুরু হতো বাড়ির পোষা মুরগি ধরার চেষ্টা! কেউ কেউ নেমে পড়ত পুকুরে, খালে-বিলে, নদীতে! লটারি ভাগ্যের মতো যেসব মাছ পেত, তা নিয়েই খুশি থাকতে হতো। উপস্থিত অতিথিকে লটারির মাছ অথবা মুরগি যেকোনো একপ্রকার আমিষ দিয়েই আপ্যায়ন করা হতো! অতিথি আপ্যায়ন শেষে অবশিষ্ট যা থাকত, সেদিকে প্রায় আমিষ বুভুক্ষু মানুষের চোখ চকচক করে উঠত! অনেক বেশি প্রকৃতিনির্ভর হওয়ার কারণেই হয়তো গ্রামবাসীর রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাও ছিল বেশি! রোগের বর্ণনা শুনেই গাঁয়ের চিকিৎসক অনেকাংশেই রোগনির্ণয় করতে পারতেন। বড় কোনো ডিগ্রি ছাড়া চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী রোগ নিরাময় হয়ে যাওয়াটা ছিল যেন সময়ের ব্যাপারমাত্র! তখনো গাঁয়ের ছেলেমেয়েরা সেকেন্ড ডিভিশনে (কমপক্ষে ৪৫% নম্বরপ্রাপ্ত) কিংবা সংখ্যায় কম হলেও ফার্স্ট ডিভিশনে (কমপক্ষে ৬০% নম্বরপ্রাপ্ত) স্কুল-কলেজ পাস করত! অবলীলায় তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখার সুযোগ পেত। আজ যারা পুরো দেশের প্রায় সিংহভাগ সেক্টরের বা বিভাগের ১ম শ্রেণির কর্মকর্তা। সময়ের প্রয়োজনে আজ অনেকে শহরে পাড়ি জমিয়েছে। কালের বিবর্তনে নতুন কিছু উদ্ভাবনের নেশায় তারা স্বপ্নবাজ সেজেছে! স্বার্থের টানেই গাঁয়ের মাটির সোঁদা গন্ধও হয়তো তারা ভুলে গেছে!

তাদের শৈশবের আজ অকালমৃত্যু ঘটেছে এই অসুস্থ প্রতিযোগিতার কঠিন সময়ে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি এমনকি সামাজিক মূল্যবোধের উন্নয়ন ঘটাতেই কিনা স্বপ্নদ্রষ্টা মানুষেরা আজ বয়সের ভাঁড়ে নুয়ে পড়া অসহায় মা-বাবাকে সেই গাঁয়ে একা ফেলে বিলাসবহুল শহুরে জীবন যাপন করছে। একবিংশ শতাব্দীর এ ডিজিটাল যুগে প্রবীণ মা-বাবা যেন এক মধুর সমস্যায় পড়েছেন! সেই আমলের তথাকথিত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার গুরুত্ব যেন এ যুগের নবীনদের কাছে অনেকটা ফিকে হয়ে গেছে! ডিজিটালব্যবস্থা এমনকি ইন্টারনেটনির্ভর নতুন প্রজন্মের কাছে ২৫-৩০ বছর আগের এ বাংলার রীতিনীতি, সংস্কৃতি যেন আদিকালের আদিখ্যেতা ছাড়া আর কিছুই নয়। প্রবীণ দাদুদের আশপাশে আর রাখাল বাঁশিতে সুর তোলে না। আষাঢ়-শ্রাবণের থই থই জলে ব্যাঙের এখন ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ শব্দও আর কানে লাগে না। টোপর সাজিয়ে গরুর গাড়িতে কুটুমবাড়িতে যাওয়ার রীতি তো সেই কবে উবে গেছে। ৩০ বছর আগে বাড়িভর্তি লোকজন আর নেই। উপস্থিত অতিথিদের তথাকথিত লটারির ভিত্তিতে এখন আর আপ্যায়ন করারও প্রয়োজন পড়ে না। উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় রেফ্রিজারেটরে সুসজ্জিত থাকে প্রচুর পরিমাণে মাছ-মাংস, ফলমূল। গাঁয়ের ধুলো উড়িয়ে দামাল ছেলেমেয়েদের গাঁয়ের স্কুলে খুব কমই চোখে পড়ে আজকাল। এখনকার শিশুরা গাঁয়ের হাটে যাওয়ার জন্য বায়নাও ধরে না। আত্মকেন্দ্রিক ও সুপ্রতিষ্ঠিত জাতির কর্ণধারেরা ক্যারিয়ার গঠনের নেশায় আর সর্বোচ্চ নাগরিক সুবিধা পেতেই আজ তাঁরা গাঁয়ের মানুষের কাছে অনেক অচেনা কেউ। নিদেনপক্ষে গাঁয়ের সম্পত্তি রক্ষা করার জন্য প্রবীণ মা-বাবাকেও অর্থসম্পদে ভরপুর করে দিয়ে তারা যেন আজকাল স্ত্রী-সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। অর্থনৈতিক অভাব মেটালেই বুঝি তৃপ্তির ঢেকুর গেলা যায়? এটাই বুঝি শহুরে সভ্যতা?

ক্রমে বাঙালি ঐতিহ্যের পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে। বাস্তবতার করাল গ্রাসে নিমজ্জিত আবেগের মূর্ছনা। নাতি-নাতনিদের ঘুম পাড়ানোর জন্য দাদা-দাদিদের রূপকথার গল্প শোনানোর কোনো প্রয়োজন পড়ে না। ইন্টারনেটনির্ভর শিশুরা রোবটিক লাইফেই যেন বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে! আধুনিক মায়েদের প্রত্যাশাও অনেকাংশে তাই! শৈশব থেকেই প্রিয় সন্তানদের প্রতিযোগিতার এই যুগে টিকে থাকতে স্কুল, কোচিং, হোম টিউটর এমনকি ইন্টারনেটভিত্তিক অধ্যয়নে বাধ্য করে তোলে স্বয়ং মা-বাবা। গ্রামের সরকারি স্কুলে যেখানে একটি ক্লাসে ২০-২৫ জন ছাত্রছাত্রী, শহরের যেকোনো স্কুলে সেখানে ৩০০-৪০০। হামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো কোনো এক মোহিনী বাঁশির সুরে মোহিত হয়ে গ্রাম ছেড়ে পাড়ি জমাচ্ছে সিংহভাগ শিশুসহ তাদের মা-বাবা। আজকাল তথাকথিত গাঁয়ের চিকিৎসকের পরামর্শ যেন বড্ড বেমানান। বাহারি পরিবেশনায় আহারের বাড়াবাড়ি, নিদেনপক্ষে খাদ্যতালিকায় আইটেম প্রদর্শনের অলিখিত নিয়মের প্রতিযোগিতা আজ শুরু হয়েছে খুব সচেতনভাবেই।

ফাইল ছবি

দৈনন্দিন প্রয়োজনীয়তার বাইরেও মন খুলে বাজার করতে, পেট পুরো খেতে ও খাওয়াতে, ভালো স্কুল-কোচিং পেতে, উন্নত চিকিৎসা পেতে, অত্যাধুনিক নাগরিক সুবিধায় জীবনকে উপভোগ করতে শহরের যেন কোনো বিকল্পই নেই আজ। অথচ, ডিজিটাল সভ্যতার গ্রামগুলোতেও বলতে গেলে নাগরিক সুবিধার কোনো কমতি নেই। ইন্টারনেটের উন্মত্ততায় ছেয়ে গেছে গ্রামীণ চারপাশ। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতির সার্বিক উন্নয়ন ঘটাতে পশ্চাৎপদ গ্রামগুলোতেও অনেক বাজেট বরাদ্দ করেই চলেছে বছরের পর বছর। তবু কেন ছুটছে মানুষ ইটপাথরের নির্মমতায় গড়ে ওঠা ব্যস্ততম শহরে? কিসের টানে চারদেয়ালে বন্দি করে রাখা হচ্ছে কোমলমতি শিশুদের? কোন অপরাধে নিষ্পাপ শিশুর সুন্দর শৈশবকে গলা টিপে হত্যা করা হচ্ছে? আজকের জাতির কর্ণধারেরা কি চুপ করে থাকবেন? নাকি লজ্জায়-অপরাধে নিজেকে গুটিয়ে রাখবেন, চোরের মতো? এ যুগের অনেক জ্ঞানী মানুষ তাঁদের শ্রদ্ধাভাজন মা-বাবাকে কেবল স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ পাহারা দিতে আর একবারে সেকেলে মানুষ ভেবে সেই গ্রামে একপ্রকার ফেলে রেখে পুরোদস্তুর শহুরে ভদ্রলোক সেজেছেন। কোনো একদিন এমনি করেই তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মও হয়তো পাড়ি জমাবে অন্য কোনো শহরে, দেশ হতে দেশান্তরে! তবু কি আমরা মা-বাবাকে একা ফেলে শহরের দিকেই ছুটে চলব?

লেখক: মো. তানজিমুল ইসলাম, সামাজিক উন্নয়নকর্মী