করোনায় নতুন বিশ্ব বাস্তবতা
বছর বারো–চৌদ্দ আগে যখন কম্পিউটারে ডিএক্স বল নামের এক গেম খেলায় হাত মকস করছিলাম, লক্ষ করতাম কিছুক্ষণ খেলার পর ধীরগতির বল, শুধু তীব্র বললে কম বলা হয়, মারাত্মক গতিপ্রাপ্ত হয়ে উঠত। ওকে তখন ট্যাকল করা শক্ত। বুনো ষাঁড়ের মতো একটার পর একটা গোলাকার বলের দেয়াল মদ-মত্ততায় ভেঙে চলত। উল্লেখ্য, অধিকাংশ সময় এতেই তার মৃত্যু নিহিত থাকত। বিশাল যজ্ঞে তার ধ্বংসের প্রায়শ্চিত্ত হতো! অর্থাৎ হাই স্কোরে মরত সে।
প্রচলিত বিশ্বব্যবস্থা গতিপ্রাপ্ত ডিএক্স বলের মতো কয়েক দশক ধরে ছুটছিল দিগ্বিদিক। এই গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে গরিষ্ঠের চলা ছিল এক কথায় অসম্ভব। সাময়িক পেরে উঠলেও দীর্ঘ মেয়াদে সম্ভব ছিল না; এমনকি পারাদের পক্ষেও সম্ভব হতো না। মানুষ যখন নিজে সে কাজ করছিল না বা পারছিল না অথবা করার পদক্ষেপ নিচ্ছিল না, প্রকৃতি সে কাজ করতে উদ্ধত হয়ে এক ধ্বংসযজ্ঞ দুনিয়ার ওপর চালিয়ে দিল। কয়েক প্রজন্মের ভাবনার অতীত ঘটনায় দৃশ্যত পৃথিবী থমকে গেছে। পরাশক্তির যে দুর্জ্ঞেয় ক্ষমতা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে এবং তা নাস্তানাবুদ হতে পারে, এ ভাবনা হিসাবের বাইরে ছিল। গোটা বিশ্বব্যবস্থা তছনছ হয়ে গেছে। নতুন সমীকরণ সামনে, নতুন এক বিশ্বব্যবস্থা মাথাচাড়া দিতে উদ্ধত। যত স্তিমিত হয়ে আসবে করোনার প্রভাব, ততই পরিষ্কার হয়ে উঠবে তেজি সে ঘোড়া। নতুন বিশ্বব্যবস্থার পথ করে দিতে করোনা বুঝি বিশ্বকে স্থবির করে নতুন চালককে স্টিয়ারিং বসিয়ে নিজে বিদায় নেবে। চালক চালাবে নতুন করে।
আইরিশ কবি ডব্লিউ বি ইয়েটস এক দার্শনিক ভিত্তি দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন তাঁর কবিতায় পাঠকদের ইতিহাসে ফিরিয়ে নিয়ে। বাইজানটিয়াম নিয়ে তাঁর একাধিক চমৎকার কবিতা আছে ইতিহাসে দৃষ্টি ফেরাতে। ইয়েটস বিশ্বাস করতেন, সভ্যতা ঘূর্ণমান। যেকোনো সভ্যতার একটা আয়ু থাকে; সেটা দুই হাজার বছর; এই সময়ের মধ্যে একটা সভ্যতার জন্ম, বিকাশ আবার ক্ষয়ও নিহিত। ইয়েটস উদাহরণ টেনেছেন ইতিহাস থেকেই—মায়া, ইনকা, বাইজানটিয়াম হয়ে বর্তমান ইউরোপীয় সভ্যতা। যার শেষ দেখেন ইয়েটস, যার আয়ু ফুরিয়ে আসছে, বয়সের ভারে নুয়ে পড়ছে। সে তো দুই হাজারের কোটায়; তার লয় অনিবার্য। আবার কোথায়ও কোন সভ্যতা জেগে উঠবে; কেড়ে নেবে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আর গন্তব্য হবে স্থির—সভ্যতামুখী।
আজ থেকে বছর খানেক আগেও কি মানুষ ভাবতে পারত পৃথিবী এমন স্থবির হয়ে পড়তে পারে। পরাশক্তিগুলো এভাবে কাবু হবে। অসহায়ভাবে আত্মসমর্থন করবে! হলিউডের কোনো কল্পকাহিনিতে তারা চোখ বুলাচ্ছে—ভাবতে পারে। কিন্তু যা ঘটার ঘটল, জীবনযাত্রা থমকে দাঁড়াল, শকটের দম ফুরাল। এদিকে শোনা যাচ্ছে, জোর পদধনি পাওয়া যাচ্ছে পৃথিবীর পূর্ব প্রান্তে সভ্যতার ভরকেন্দ্র আছড়ে পড়ার! ২০২৮ সালের মধ্যেই চীন সবচেয়ে বড় অর্থনীতির খাতায় নাম লেখাচ্ছে; ভারত ২০৩০ সালের মধ্যে তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হচ্ছে। ধারেকাছের দেশগুলোতেও অর্থনীতি ফুলেফেঁপে উঠবে; খালি কাইজা-ফ্যাসাদ আর কুস্তাকুস্তিতে কালক্ষেপণ না করলে!
করোনার করুণ ও ভয়াল দিকটি দেখল বোধ করি উন্নত বিশ্বই; আর এর ধাক্কা তাদের ধরণিতে ফিরিয়ে আনল। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ভয়াবহ ফ্যাসাদ সৃষ্টি করে যে চরম মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে এত দিন, নিজেদের গায়ে তার যদি কিছুটা উত্তাপ সঞ্চারিত হয়ে সংশোধনের পথ করে দেয়, মানবসভ্যতার বড় উপকারই হয়; তা কি হওয়ার?
দ্রুত ধাবমান বিশ্ব কি পাগলা শেয়ারবাজারের মূল্য সংশোধনের অলিখিত নীতির মতো নিজেকে পরিবর্তনের সঙ্গে অভিযোজিত করে নেবে! পারবে কি!
লেখক: জিল্লুর রহমান, সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ইংরেজি বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব ডেভলপমেন্ট অলটারনেটিভ