উন্মুক্ত শ্রমবাজার: আমাদের প্রত্যাশা কি
করোনা ক্রান্তিকালে বাংলাদেশে প্রবাসী আয়ের প্রবাহ বাড়লেও কয়েক মাস ধরে প্রবাসী আয়ের প্রবাহ হ্রাস পেয়েছে। তাই এ মুহূর্তে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খোলা আমাদের জন্য একটি সুসংবাদই বটে। গত ১৯ ডিসেম্বর রোববার কুয়ালালামপুরে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে খুলেছে এ বাজার। চুক্তিটি স্বাক্ষর করেন মালয়েশিয়ার মানবসম্পদমন্ত্রী এম সারাভানান এবং বাংলাদেশের প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমদ। এ চুক্তির ফলে দীর্ঘ তিন বছর পর আবার মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশিদের জন্য শ্রমবাজার উন্মুক্ত হচ্ছে। দেশটির সব সেক্টরে কর্মী নেওয়ার অনুমোদন দেয় মালয়েশিয়ার মন্ত্রিপরিষদ। তবে আগের চেয়ে এবারের সমঝোতা স্বাক্ষরে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। তার মধ্যে জিটুজি প্লাস পদ্ধতির উল্লেখ থাকছে না। বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে ১৮ থেকে ৪৫ বছর পর্যন্ত। থাকছে কর্মীদের বাধ্যতামূলক বিমা, কর্মীদের দেশে ফেরার ব্যবস্থা ও খরচ বহন করবে নিয়োগদাতা।
চুক্তির মেয়াদ শেষে দায়িত্ব নিতে হবে মালয়েশিয়ার রিক্রুটিং এজেন্সিকেও।
মালয়েশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশে কর্মী নিয়োগের বিষয়ে প্রথম আনুষ্ঠানিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ১৯৯২ সালে। কয়েক বছর চলার পর সেটি বন্ধ হয়ে যায়। আবার ২০০৬ সাল থেকে কর্মী প্রেরণ শুরু করে বাংলাদেশ। তবে বিপুলসংখ্যক অবৈধ ধরা পড়ায় ২০০৯ সালে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে বাংলাদেশকে নিষিদ্ধ করা হয়। এরপর ২০১২ সালে আবারও দুই দেশের মধ্যে নতুন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ২০১৮ সালে ১ সেপ্টেম্বর থেকে শ্রমিক নিয়োগ বন্ধ হয়ে যায়। ‘জিটুজি-প্লাস’ নামে যে এসপিপিএ সিস্টেমের আওতায় মালয়েশিয়া বাংলাদেশি শ্রমিকদের নিয়োগ দিত সে পদ্ধতি স্থগিত হওয়ার কারণেই ওই নিয়োগ স্থগিত হয়ে যায়। তবে বর্তমান সময় থেকে সব কর্মীর ডেটা ব্যাংকের মাধ্যমে যাবে, যা মালয়েশিয়া দিয়ে শুরু হবে।
বিশ্বব্যাংকের মতে, ২০২১ সালের প্রথম ৯ মাসে বাংলাদেশে প্রবাসী আয়ের গতি ধীর হয়ে আসার কারণে ২০২২ সালের জন্য ঝুঁকির আভাস। এর সবচেয়ে বড় কারণ জনশক্তি রপ্তানি কমে যাওয়া এবং মহামারির সময়কালীন সময়ে দেশে আসা প্রবাসীদের আটকে পড়া। বিশ্বব্যাংকের এমন পূর্বাভাসের মধ্যেই মালয়েশিয়ায় স্থগিত হয়ে থাকা শ্রমবাজারের দরজা খুলে যায়। এ সমঝোতা স্মারকের মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় বিভিন্ন খাতে বাংলাদেশের বিভিন্ন কর্মীর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হওয়ার পাশাপাশি জীবনযাত্রার মান, ভালো উপার্জন—সবকিছু মিলিয়ে মালয়েশিয়ায় যেতে অনেকেই আগ্রহী। বিগত বছরগুলোতে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক কর্মী গেছেন সৌদি আরবে, তারপরই মালয়েশিয়া।
ফেডারেশন অব মালয়েশিয়ান ম্যানুফ্যাকচারার্সের মতে, শিল্প খাতে আগামী বছর নাগাদ তাদের ছয় লাখের বেশি শ্রমিক লাগবে। তবে রপ্তানি ভিত্তিক এই শ্রমিকের প্রয়োজনীয়তা বেশি। তাই সে মুহূর্তে শ্রমবাজার খুলে যাওয়া আমাদের জনশক্তি রপ্তানি খাতের জন্য ইতিবাচক বলা চলে। ভবিষ্যতে মালয়েশিয়াসহ অন্যান্য শ্রমবাজার ধরে রাখতে পারলে অনেক লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। বর্তমানে আমাদের দেশে প্রচুর তরুণ জনগোষ্ঠী আছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মতে, বর্তমানে বাংলাদেশ জনসংখ্যার বোনাসকাল বা ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট ভোগ করছে। দেশে ১৫ থেকে ৫৯ বছর বয়সী মানুষের সংখ্যা প্রায় ৭০ শতাংশ। বিশাল এই জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা খুবই কঠিন। তাই অন্য দেশের শ্রমবাজারকে কাজে লাগাতে পারলে সুফল বয়ে আনবে। তাই প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ কর্মী তৈরির বিকল্প নেই।
বর্তমানে মালয়েশিয়ায় কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে ‘বিএমইটি’র ডেটাবেইস নিবন্ধন ব্যতীত কোনো কর্মী মালয়েশিয়ায় যেতে পারবেন না। তাই মালয়েশিয়ায় কর্মী প্রেরণের বিষয়ে সরকারি ঘোষণার পূর্বে কোনো ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান বা রিক্রুটমেন্ট এজেন্টের সঙ্গে কোনো প্রকার আর্থিক লেনদেন থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। তবে বিদেশগামী অধিকসংখ্যক মানুষ এমন ধারণাই পোষণ করে যে বিদেশে যেতে হলে অতিরিক্ত টাকা দিয়েই যেতে হবে। সেটা যাতে না ঘটে, তার পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। কারণ, ২০১৮ সালে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বন্ধ হওয়ার পেছনে এটি ছিল একটি বড় কারণ। তবে অবৈধভাবে কেউ যাতে মালয়েশিয়ায় প্রবেশ করার কোনো সুযোগ না পান, সে জন্য একটি অ্যাপ চালু করতে যাচ্ছে মালয়েশিয়া সরকার। ‘ই-লকার’ নামের এই অ্যাপটির মাধ্যমে প্রবাসী শ্রমিকদের বিস্তারিত তথ্য সংরক্ষণ করা হবে। মালয়েশিয়ায় যাঁরা যাবেন, তাঁদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায় বন্ধ করতে এ অ্যাপ সহায়তা করবে।
সেই সঙ্গে মালয়েশিয়ায় শ্রমিকেরা কোথায় অবস্থান করছেন, শ্রমিকেরা কোনো দেশ থেকে এসেছেন, পরিবারের বিস্তারিত তথ্য, নিয়োগদাতার তথ্য, কাজের এলাকা, বেতন বা মালয়েশিয়ায় প্রবেশে কত টাকা খরচ হয়েছে, তাতে বিস্তারিত তথ্য থাকবে। যে দেশ থেকে শ্রমিক এসেছেন, সে দেশের কর্তৃপক্ষও এ অ্যাপ থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে পারবে।
মালয়েশিয়ার পর আলবেনিয়া, মাল্টা ও বসনিয়ার সঙ্গেও কর্মী পাঠানোর চুক্তি স্বাক্ষরের কথা রয়েছে। নতুন শ্রমবাজার হিসেবে কম্বোডিয়া, উজবেকিস্তান, পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, রোমানিয়া, ক্রোয়েশিয়াসহ আফ্রিকা মহাদেশের কয়েকটি দেশ এবং জাপান, সেনেগাল, বুরুন্ডিতে কর্মী পাঠানো শুরু করেছে। এসব শ্রমবাজার আমাদের নতুন করে আশার আলো দেখাচ্ছে। মালদ্বীপের সঙ্গে স্বাস্থ্যসেবা সহযোগিতা এবং চিকিৎসক পাঠানোর বিষয়ে যে সমঝোতা স্মারক ছিল, সম্প্রতি তারও মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপসহ অন্যান্য দেশে স্বাস্থ্যকর্মী, নার্স, মেডিকেল টেকনোলজিস্টের চাহিদা বেড়েই চলেছে। কিন্তু বিএমইটির অধীনে কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোতে স্বাস্থ্যকর্মী প্রশিক্ষণের কোনো ব্যবস্থা নেই।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসী আয়ে বাংলাদেশ পৃথিবীর শীর্ষ ১০টি দেশের একটি। প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় মতে, ১৯৭৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ১ কোটির বেশি বাংলাদেশি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কাজ করতে গেছেন। তাঁদের বেশির ভাগই স্বল্প শিক্ষিত। যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘সেন্টার ফর ইকোনমিকস আ বিজনেস রিসার্চের তথ্যমতে, ২০৩২ সালের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বের বড় ২৫টি অর্থনীতির একটি হবে। শহুরে অর্থনীতির পাশাপাশি গ্রামীণ অর্থনীতির গতিশীলতা সৃষ্টিতে প্রবাসী আয় বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছে। তাই দেশে অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের পাশাপাশি বৈদেশিক কর্মসংস্থানের মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক সেক্টরের সমস্যা দূর করতে নতুনভাবে মূল্যায়ন ও উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। সে ক্ষেত্রে প্রবাসী আয় ধরে রাখতে হলে জনশক্তি খাতে করোনা–পরবর্তী কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। সে ক্ষেত্রে দক্ষ কর্মী তৈরি করা আবশ্যক। কারণ, শ্রমবাজারে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সঙ্গে আমাদের বড় ধরনের প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে হবে। সে প্রতিযোগিতার মুখ্য জায়গা হলো দক্ষ কর্মী তৈরি করা। ২০২৫ সালের পর সৌদি আরব আর কোনো অদক্ষ শ্রমিক নেবে না। অন্যদিকে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রভাবে ইউরোপে দিন দিন দক্ষ কর্মীর চাহিদা তৈরি হচ্ছে। তাই দক্ষ কর্মীর তৈরির ওপর জোর দিতে হবে। সে চাহিদা পূরণকল্পে প্রয়োজনে কারিকুলামে পরিবর্তন এনে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
*লেখক: কলামিস্ট, ব্যাংকার