আলিম পাস করেছে সেই স্মৃতি, পড়তে চান বিশ্ববিদ্যালয়ে
এ জীবন যেন হাজারো স্মৃতিতে ঘেরা। জীবনের পরতে পরতে লুকিয়ে থাকে হাজারো স্মৃতিকাতরতা। তবে সব স্মৃতি জীবনের অতল গহ্বরে লুকিয়ে থাকে না, একটু আলো–মেদুরতা পেলে তারাও পাখা মেলে প্রজাপতি হয়ে দিগন্ত ছুঁয়ে দিতে। তাই তো জীবনপথের শত অন্ধকার মুহূর্ত পেরোনোর পর এবার যেন এসেছে সেই আলোর সন্ধান।
বলছিলাম প্রথম আলো অনলাইনের নাগরিক সংবাদে গত বছরের ৪ নভেম্বরে প্রকাশিত হয় ‘স্মৃতির হৃদয়ে হাজারো স্বপ্ন গাঁথা, চায় কৃত্রিম পায়ে দাঁড়াতে’ শিরোনামে জন্ম থেকেই শারীরিক প্রতিবন্ধী কলেজপড়ুয়া মেয়ের জীবনের গল্প। সংবাদটি প্রকাশের পর স্মৃতিকে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে নগদ অর্থ সহায়তা ছাড়াও বেশ কয়েকটি সংগঠন এগিয়ে আসে সাহায্য করতে। এবার স্বপ্নটা আরেক ধাপ এগিয়ে নেওয়ার সময় এসেছে স্মৃতির।
এবারের ২০২১ সালের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় আলিম পাস করেছেন আবিদা আনজুম স্মৃতি। পরীক্ষায় পাস করার পর এবার জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে চান এই শিক্ষার্থী। সেই স্বপ্নের কথাই জানালেন স্মৃতি। আলিম পরীক্ষায় তাঁর প্রাপ্ত জিপিএ ৩.৭৯।
ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার ভবানীপুর ইউনিয়নে ভবানীপুর টানপাড়া গ্রামের মৃত আবদুল আউয়ালের পাঁচ সন্তানের মধ্যে সবার ছোট স্মৃতি। তিনি ভবানীপুর সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার আলিম বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। স্মৃতির এ ফলে পরিবারের সদস্য, তাঁর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, সহপাঠীসহ পুরো গ্রামের সবাই আনন্দিত।
পরীক্ষার ফলাফলের খবর জানাতে গিয়ে অশ্রুসিক্ত হয়ে স্মৃতি জানান, ‘যদি অর্থনৈতিক সহায়তা আগে থেকে পেতাম, তবে আমি আরও ভালো ফল করতে পারতাম বলে মনে হয়। এই ফল করে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে পারব কি না, জানি না। তবে আমার খুব ইচ্ছা জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হওয়ার। সেখান থেকে পড়াশোনা শেষ করে কোনো ব্যাংকে চাকরি করতে চাই কিংবা শিক্ষকতা করতে চাই। এখন মুশকিল হলো আমার পরবর্তী পড়াশোনার খরচ আমি কীভাবে জোগাব? তাই আমার আকুল আবেদন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কিংবা দেশের সরকারি-বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠান কিংবা কোনো সহৃদয়বান ব্যক্তি যদি আমার পড়াশোনার খরচ চালিয়ে নিতে সহায়তা করতেন, তবে পড়াশোনা শেষ করে ভালো চাকরি করতে পারতাম, মায়ের ইচ্ছাটা পূরণ করতে পারতাম। আমি প্রতিবন্ধী হয়ে সংসারের সবার বোঝা হয়ে থাকতে চাই না। শিক্ষায় আলোকিত হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই। আমার মতো আরও যাঁরা প্রতিবন্ধী রয়েছেন, তাঁদের জন্য কাজ করে যেতে চাই আমৃত্যু।’
পরিবারের অন্য ভাইবোনেরা স্বাভাবিক জীবন যাপন করলেও সবার থেকে ব্যতিক্রম স্মৃতি। কারণ, জন্ম থেকেই শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী তিনি। স্মৃতির জন্মের পর মা সুফিয়া খাতুনের জ্ঞান ফিরলে দেখেন, তাঁর মেয়ে স্মৃতির কোমর থেকে দুটি পা নেই। তখন এ নিয়ে পরিবার ও সমাজের মানুষের কাছে নানা কটু কথাও শুনতে হয়েছে মা সুফিয়া খাতুনকে।
পৃথিবীর বুকে সুস্থ–স্বাভাবিক মানুষের মতো দুই পায়ে ভর করে দাঁড়িয়ে পৃথিবীটাকে হয়তো তিনি দেখতে পারেন না, তবে তাঁর দুটি হাত আছে। এই হাত, মেধা-মননশীলতাকে কাজে লাগিয়ে শারীরিক প্রতিবন্ধকতার কাছে দমে না গিয়ে বরং নিজে স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন স্মৃতি প্রতিনিয়ত। তবু স্মৃতির মতো অজস্র মানুষ আছেন, যাঁরা খোঁজেন ভাতের ঠিকানা, দিন শেষে অভাব-অনটন আর দারিদ্র্যের কাছে হার মানেন। কেননা, জীবনের চাকা চালাতে গিয়ে কখনোসখনো তাঁদের ভাগ্যের চাকা থেমে যায় শুধু অভাব-অনটনের তাড়নায়। স্মৃতির চাকাও থেকে যাওয়ার মতো অবস্থা। মেয়েটির এখন পড়াশোনা বন্ধ হওয়ার উপক্রম। মৃত্যুর আগে স্মৃতির বাবা আবদুল আওয়াল যৎসামান্য অল্প একটু জমি রেখে গিয়েছিলেন, তা চাষবাস করে কোনো রকমে দুবেলা অন্ন জোটে এই ১০ সদস্যের পরিবারটির। সরকার থেকে একটি প্রতিবন্ধী ভাতার কার্ড পেয়েছেন স্মৃতি।
পরিবারের সবার ছোট মেয়ে স্মৃতির বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে অশ্রুসিক্ত মা সুফিরা খাতুন বলেন, ‘পাঁচ সন্তানের মধ্যে একমাত্র ছোট মেয়ে স্মৃতি প্রতিবন্ধী হইয়া জন্ম নিছে। এক বছর বয়স রাইখা ওর বাপ মারা গেছে। আমার স্মৃতি মেলা লেহাপড়া করতে চায়, পড়ালেহা কইরা ব্যাংকে চাকরি করতে চায়, অর লেহাপড়া করার খুব ইচ্ছা। আমগোর জমিজমা নাই, সংসার চালাতে কষ্ট হয়, সেহানে লেখাপড়া করামু কী দিয়া। স্মৃতি এইবার আলিম পরীক্ষায় পাস করছে। আমি চাই ও লেখাপড়া করে বড় চাকরি পাক।’
সুফিয়া খাতুন আরও জানান, ‘যে যা-ই বলুক, মেয়ে আমার। আমি জানি, আমার মেয়ের যন্ত্রণার কথা। চিন্তায় আমার ঘুম আসে না বাবা, আমার মেয়েটা বড় হয়েছে, তার দুইটা পাও (পা) নাই। প্রতিবন্ধী আমার মেয়েটারে বিয়া দেওন লাগব। কিন্তু কেডায় বিয়া করব আমার মেয়ারে। একজন মা হয়ে এটা একটা বড় চিন্তা আমার, বেঁচে থাকতে তার যদি একটা গতি হইতো, অর মনের ইচ্ছাগুলো যদি পূরণ হইতো, আর চাওয়া ছিল না আল্লার কাছে।’
স্মৃতির বড় ভাই ফকরুল ইসলাম বলেন, ‘আমার বোনটা খুব ধৈর্যশীল। সে খুব কষ্ট করে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে। সাংসারিক অসচ্ছলতার কারণে বোনটাকে সব সময় সহযোগিতা করতে পারি না। একটা ল্যাপটপ কেনার খুব শখ ওর, কিন্তু আমাদের তো নুন আনতে পান্তা ফুরায়। সরকার প্রতিবন্ধীদের চাকরির জন্য সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে। আমার বোনটার যদি একটা সরকারি চাকরি হয় এবং আমার বোনের পড়াশোনার খরচটা যদি সরকার কিংবা বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি বহন করত, আমার বোনের স্বপ্নটা পূরণ হতো।’
স্মৃতির মতো এমন শারীরিক প্রতিবন্ধী মানুষেরা পরিবারের বা সমাজের বোঝা নন। প্রান্তিক পর্যায়ে এমন অনেক স্মৃতি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন এ দেশে, যাঁরা একটু সহযোগিতা বা মানবিকতার অভাবে পিছিয়ে পড়ে থাকে আজন্মই। তাঁদের প্রতি মানবিক আচরণ আর সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলেই তাঁরা হতে পারেন দক্ষ জনশক্তি তথা দেশের সম্পদ।