আর কোনো স্বপ্ন যেন কফিনে বন্দী না হয়
আবিরনকে হত্যার দায়ে সৌদি গৃহকর্ত্রীর মৃত্যুদণ্ড। ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোতে এ শিরোনামের খবরে বলা হয়েছে, আবিরন বেগম হত্যা মামলায় সৌদি আরবের গৃহকর্ত্রী আয়েশা আল জিজানিকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত। একই সঙ্গে বাসার কর্তা বাসেম সালেমকে ৩ বছর ২ মাস কারাদণ্ড এবং ৫০ হাজার সৌদি রিয়াল জরিমানা করা হয়েছে। এ ছাড়া ওই দম্পতির ছেলে ওয়ালিদ বাসেম সালেমকে সাত মাস কিশোর সংশোধন কেন্দ্রে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
খবরটিতে আরও বলা হয়েছে, খুলনার আবিরন বেগমের সন্তান না হওয়ায় ২০ বছর আগে স্বামী তাড়িয়ে দিলে তিনি বাবার বাড়িতে ফিরে আসতে বাধ্য হন। আবিরন বোনদের লেখাপড়া ও পিতার পরিবারে সচ্ছলতা এনে দেওয়ার উদ্দেশ্যে ২০১৭ সালে গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে সরকারিভাবে সৌদি আরবে যান। ২ বছর ৩ মাস পর ২০১৯ সালের ২৪ অক্টোবর ভোরে কফিনে মুড়ে আবিরনের লাশ দেশে আসে। সৌদি আরবের যে বাসায় আবিরন গৃহকর্মী হিসাবে কাজ করতেন, সেই বাসার গৃহকর্ত্রীসহ অন্যদের চরম নির্যাতনের শিকার হন আবিরন। তাঁকে পিটিয়ে, গায়ে গরম পানি ঢেলে, খাবার না দিয়ে নির্যাতন করা হতো। আবিরনের পরিবারের দাবি, তাঁকে যৌন নির্যাতনও করা হতো এবং ২ বছর ৩ মাসে তাঁর পরিবার আবিরনের বেতন বাবদ মাত্র ১৬ হাজার টাকা পেয়েছে। বেতনের বাকি অর্থ দালাল চক্র হাতিয়ে নিয়েছে।
সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত, জর্ডান, ওমান তথা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে গৃহকর্মীদের ওপর নির্যাতন, হত্যার শিকার হওয়া, নির্যাতনের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করার ঘটনা নতুন কিছু নয় অথবা আবিরনই প্রথম বা শেষ ঘটনা নয়। আবিরনের তো রীতিমতো সৌভাগ্য বলতে হয়, কারণ, তাঁর পরিবার অন্তত একটা বিচার পেয়েছে এবং তাঁর প্রতি অন্যায়কারীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে। বেশির ভাগ ‘আবিরনদের’ ক্ষেত্রে বিচারের বাণী নীরবে-নিভৃতে গুমরে কেঁদে মরে। নাজমা, কুলসুম, পারভিন আক্তারসহ আরও কত অসংখ্য নাম, যাঁদের স্বপ্ন কফিনবন্দী হয়েছে। তাদের অপরাধ তাঁরা গরিবের ঘরে জন্মেছেন; তাঁদের অপরাধ তাঁরা উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখেছেন এবং তাঁদের সবচেয়ে বড় অপরাধ তাঁরা মেয়ে হয়ে জন্মেছেন।
ডেইলি স্টার অনলাইনে ২০২০ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত খবর ‘প্রবাসে ৪ বছরে ৪১০ নারীর মৃত্যু’! এ খবর রীতিমতো ভয়ংকর। যে পরিবারের মেয়ে, বোন বা মা বিদেশ বিভুঁইতে গিয়ে নারকীয় ঘটনার শিকার হয়ে ‘কফিনবন্দী’ হয়ে দেশে ফেরে, তাদের পরিবারের মর্মবিদারী কান্না একদিকে যেমন সৌদি আরবের ধনকুবেরদের মর্মর পাথরের দেয়াল ভেদ করে ভেতরে প্রবেশ করতে পারে না, তেমনি যেসব হতভাগা নারী একটু সচ্ছল জীবনের স্বপ্ন নিয়ে ওই সব ধনকুবেরদের প্রাসাদসম ‘খাঁচায়’ প্রবেশ করেন, তাদের জীবনের করুণ কাহিনি এবং আর্তচিৎকার ওই পাথরের কঠিন দেয়াল ভেদ করে বাইরে আসতে পারে না। ওই সব হতভাগিনীর অনেকের জীবনই পাষাণ, পাথরের দেয়ালের অভ্যন্তরে অত্যাচার, নিপীড়নেই শেষ হয়, নয়তো ‘খাঁচার’ বন্দী জীবন থেকে পালাতে গিয়ে তাঁরা আত্মাহুতি দিতে বাধ্য হন!
ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইন নারী গৃহকর্মীদের ওপর নির্যাতনের কারণে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে নারী গৃহকর্মী পাঠানো বন্ধ রেখেছে, অথচ দুঃখজনকভাবে গৃহকর্মীদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতনের ঘটনাকে উপেক্ষা করে বাংলাদেশ তা অব্যাহত রেখেছে। আবিরন সরকারি ব্যবস্থাপনাতেই সৌদি আরবে গিয়েছিলেন। সরকারি ব্যবস্থাপনাতে গিয়েও আবিরনকে লাশ হয়েই দেশে ফিরতে হয়েছিল। সরকারি ব্যবস্থাপনাতেও যদি একজন নারীকে কফিনবন্দী হয়ে দেশে ফিরতে হয়, তবে বেসরকারি এজেন্সির মাধ্যমে যাঁরা গৃহকর্মী হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে যান, তাঁদের করুণ অবস্থা তো সহজেই অনুমেয়। সরকারি ব্যবস্থাপনায় যাওয়ার কারণেই হয়তো আবিরনের লাশে মৃত্যুর ধরনে ‘হত্যা’ বা ‘মার্ডার’ শব্দটি লেখা ছিল এবং বাংলাদেশ দূতাবাসের আন্তরিকতা এবং ব্যাপক তৎপরতায় হত্যা মামলাটি সৌদি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। কিন্তু অনেক মৃতদেহে মৃত্যুর ধরনে ‘আত্মহত্যা’ লেখা থাকে এবং ‘আত্মহত্যা’ লেখা থাকার কারণে হয়তো তাঁদের পক্ষ হয়ে কেউ আদালত পর্যন্ত যেতে পারেন না।
একজন হতদরিদ্র, নিরক্ষর মানুষ, যিনি ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় সম্পূর্ণ অজানা, অচেনা জগতে পাড়ি জমানোর মতো ঝুঁকি নেন, তিনি কেন স্বেচ্ছায় আত্মহননের পথ বেছে নেবেন? অত্যাচার, নির্যাতনের মাত্রা কতটা ভয়ংকর হলে একজন মানুষ উপায়ন্তরহীন হয়ে ‘আত্মহত্যার’ মাধ্যমে মুক্তির উপায় খোঁজেন, তা সহজেই অনুমেয়। নৃশংস নির্যাতনের মাধ্যমে ‘হত্যার’ কারণে এবং সৌদি আরবের বাংলাদেশ দূতাবাস, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, প্রথম আলো, ব্র্যাকের আন্তরিক প্রচেষ্টার ফলে সৌদি গৃহকর্ত্রী, তাঁর স্বামী ও তাঁদের ছেলেকে বিচারের আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে এবং আবিরনের পরিবার বিচার পেয়েছে। কিন্তু আরও অসংখ্য আবিরন ও তাঁদের পরিবার বিচার না পেয়ে কেঁদে ফিরছে। কারা তাঁদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছেন, তা খুঁজে বের করা এবং এসব মানবরূপী হৃদয়হীন পাষণ্ডদের আইনের আওতায় এনে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো এবং কঠোর, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।
বেসরকারি রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে ভাগ্য বিড়ম্বনার শিকার নারীরা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোত গিয়ে সংঘবদ্ধ দালাল চক্রের শিকার হয়ে পাশবিক, শারীরিক, মানসিক ও আর্থিক শোষণ-নির্যাতনের শিকার হন এবং শেষ পর্যন্ত তাঁরা লাশ হয়ে দেশে ফেরেন। ওই সব রিক্রুটিং এজেন্সির লাইসেন্স বাতিলসহ তাদের বিরুদ্ধেও জোরালো ব্যবস্থা নেওয়া এবং তাদের আইনের আওতায় আনার পদক্ষেপ নেওয়া একান্ত প্রয়োজন।
সৌদিতে নারী গৃহকর্মী পাঠানোর পর খোঁজ নেয় না কেউ। (সূত্র: প্রথম আলো, ১৭ নভেম্বর, ২০১৯) প্রথম আলোর খবরটিতে বলা হয়েছে, ২০১৫ সাল থেকে অক্টোবর ২০১৯ পর্যন্ত শুধু সৌদি আরব থেকেই লাশ হয়ে দেশে ফিরেছেন ১৩১ জন নারী গৃহকর্মী। সাধারণত হতদরিদ্র পরিবারের নারীরাই গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ দেশগুলোতে যান এবং তাঁদের মানবেতর জীবনের বিনিময়ে এবং শ্রম, ঘাম আর কষ্টে অর্জন করে পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রা দেশের অগ্রগতিতে অনেক বড় অবদান রাখে। দেশের অগ্রযাত্রায় বিশাল ভূমিকা রাখা এসব নারীর সুরক্ষা নিশ্চিত করা একান্ত প্রয়োজন।
বাংলাদেশের নারী গৃহকর্মীদের ‘কফিনবন্দী’ হয়ে দেশে ফেরত আসা একদিকে যেমন হৃদয়বিদারক, নিষ্ঠুর, অমানবিক ও অগ্রহণযোগ্য; অন্যদিকে এ ধরনের ঘটনা বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের ভাবমূর্তিও মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করে। নারী গৃহকর্মীদের ওপর অত্যাচার, নির্যাতন, হত্যা, আত্মহত্যা সারা দুনিয়াকে এই বার্তাই দেয়, মানুষের জীবন নয় বরং তাঁদের জীবনের বিনিময়ে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনই মুখ্য—এ অবস্থা চলা উচিত নয়। এ বিষয়ে যত দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় ততই মঙ্গল।
তাহমিনা খাতুন, আইনজীবী