অচেনা–অজানা ঈদ
ঈদের আগের রাতই বেশি মজার। কথাটা আমরা সবাই বলে থাকি। অবশ্যই এই কথার সঙ্গে কোনো দ্বিমত নেই। ঈদের আগের রাতে ঈদকে পাওয়ার যে ব্যাকুলতা, যে আবেগ, তা ফুটে ওঠে। ছোটবেলার স্মৃতিগুলো ভেসে ওঠে চোখের সামনে। ঈদের দিন সকালটাও কিন্তু কম নয়। তবে এবার একটু ব্যতিক্রম হয়েই গেল। ঈদের দিনের সকালটা মধুমাখা হওয়ার কথা ছিল, তা না হয়ে একদম সকাল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই চোখ ভিজে উঠল জলে।
এ এক অজানা ঈদ, এমন ঈদ তো চাইনি। যে ঈদ মায়ের হাতের রান্না করা সেমাই খেতে দেয় না, যে ঈদ বাবা-ভাইয়ের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নামাজ পড়তে যেতে দেয় না, এমন ঈদ কি চেয়েছি! ভয়াল করোনা কেড়ে নিয়েছ ঈদের আনন্দ। আমাদের অনেককেই বেঁধে দিয়েছে যার যার জায়গায়। এবার আর স্বপ্ন বাড়ি যায়নি। স্বপ্নরা বাড়ি যেতে পারেনি। স্বপ্ন বাড়ি যেতে হলে তো সঙ্গে করে ভাইরাসও নিয়ে যেতে পারত। তাই এবারের স্বপ্নকে জলাঞ্জলি দিতে হয়েছে।
ঈদ মানেই আনন্দ, ঈদ মানেই খুশি। ছোটবেলায় ঈদের আগের রাতের পটকা ফুটানো, দল বেঁধে হইহল্লা করা কিংবা মিছিল দেওয়া অথবা ঈদের নামাজের ঘোষণা দেওয়া! এসবের কিছুরই বয়স নেই এখন। কিন্তু বয়স না থাকলেও স্মৃতিচারণার তো বয়স লাগে না। স্মৃতিকে যেকোনো সময় স্মরণ করা যায়। স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে বাঁচা যায়। বাড়িতে যেতে পারলে হয়তো শৈশবের সেই দিনগুলো ফিরে পেতাম না। চিরচেনা সেই জায়গাগুলো দেখতে পেতাম। স্মৃতিগুলোকে ঝালিয়ে নিতে পারতাম। স্মৃতিকে রোমন্থন করতে পারতাম। হয়তো আমারই সামনে কোনো এক কিশোর পটকা ফুটাচ্ছে, তারাবাজি ওড়াচ্ছে। এগুলো দেখেও নিজেকে সান্ত্বনা দিতে পারতাম। কিন্তু আটকে রইলাম এক অসহায় শহরে। পড়ে রইলাম এক নিষ্প্রাণ নগরীতে। এখানে ভোরের পাখি গান গায় না, এখানে সূর্য হাসে না। চারদিকে শুধুই ইটপাথরের জঙ্গল।
এবার হয়তো কেউ সালামি চাইল না, আমিও চাইতে পারলাম না। আবদার করে বলতে পারলা না যে অমুক নোটটা দিতেই হবে! কেউ আমার পেছনে ঘুরঘুর করছে না। বাচ্চাদের একটু ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সেলামি দিতে পারলে মজা লাগে। প্রথম কম দিয়ে শুরু করা, আস্তে আস্তে বেশি। ছোট বাচ্চাদের মুখে ফুটে ওঠা সেই হাসি এবার দেখা গেল না।
শৈশব–কৈশোরের সেই প্রিয় জায়গায় ঈদের নামাজ পড়া হলো না। এবার নামাজ পড়তে হলো দালানকোটার মধ্যে। কারও সঙ্গে কোলাকুলি, করমর্দন করার ফুসরত নেই। কী ভয়ানক ভাইরাস রে করোনা! ঈদের দিন তো অচেনা মানুষের সঙ্গেও কোলাকুলি করতে মজা। তবে এই শহরে তো চিনিই না কাউকে।
চারদিক থেকে রান্নার ঘ্রাণ ভেসে আসছে। অনেক সুস্বাদু খাবার রান্না হচ্ছে হয়তো। কিন্তু একটা ঘ্রাণ আমার নাকে খেতে যাওয়ার আকুলতা আনছে না। কারণ, এর কোনোটাই আমার মায়ের রান্না নয়। একটা রান্নায়ও মায়ের গন্ধ মিশে নেই।
এবারের ঈদে জমিয়ে আড্ডা দেওয়ার সুযোগ নেই। বন্ধুরা মিলে একসঙ্গে পাড়া দাপিয়ে বেড়ানোর অবস্থা নেই। সবাই মিলে একসঙ্গে দূরের কোনো পথে পাড়ি জমানোর সুযোগ নেই এবার। সবাই মিলে কোনো বন্ধুর বাসায় হানা দেওয়ার সুযোগটাও এবার নেই। এবার তো কিছুই নেই। এবারের ঈদে আমরা নিজেরাই নিজেদের কাছে নেই।
ভয়াল করোনা কেড়ে নিয়েছে ঈদের আনন্দ। সবাইকে করে দিয়েছে ঘরকুনো। মহান আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ জানাই। করোনা চলে গেলে সামনের ঈদটা আবার জমিয়ে পালন করব। মায়ের হাতের রান্না খাব, শৈশবের স্মৃতিগুলোকে খুঁজে বেড়াব, সবাই মিলে একসঙ্গে আবার অনেক আনন্দ করব, সবাই মিলে ভালো থাকব।