সিনাকি হৈ ভাল লাগিল: শেষ পর্ব

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

সকাল থেকেই মর্তুজা ব্যাগপত্র গোছাতে ব্যস্ত। আজ সন্ধ্যার ফ্লাইটে সে কলকাতা ফিরে যাবে। এদিকে আজই বিকেলে শ্রাবণীদের বাসায় তার চায়ের নেমন্তন্ন। শ্রাবণী খুব করে বলেছে। না গেলে খারাপ দেখাবে। এখানেই আসামে একটা ভাড়াবাড়িতে উঠেছে ওরা। এখন থেকে এখানেই পাকাপাকিভাবে থাকবে বলে ঠিক করেছে। কলকাতায় ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা নেই ওদের। দুপুরে ডাকবাংলোয় খাওয়া সেরে একটু জিরিয়ে নিল মর্তুজা। খানিক বাদে রঘুকে ডেকে কিছু বকশিশ দিয়ে বিকেল হতেই বেরিয়ে পড়ল সে।

শ্রাবণীদের বাড়ির সামনে বিশাল এক টেরেস। চারপাশে নানা জাতের ফুলের গাছ লাগানো সারি সারি। বেশ সাজানো গোছানো ছিমছাম বাড়ি। কোনো এক মাদ্রাজি নাকি একসময় বাড়িটি বানিয়েছিলেন শখ করে নিজে থাকবেন বলে। থেকেও ছিলেন ক’দিন। পরে বাড়িটি ভাড়া দিয়ে ব্যবসার কাজে এখন তিনি নাকি সেই মাদ্রাজেই থাকছেন। আস্ত দোতলা বাড়ির ওপরে থাকছে শ্রাবণীরা। আর নিচতলা ভাড়া নিয়েছে এক অসমীয়া দম্পতি। তাদের আবার বাচ্চা-কাচ্চা নেই, নিঃসন্তান।

কলিংবেল চাপতেই প্রশান্ত বাবু দরজা খুললেন। যেন তিনি মর্তুজার আসার অপেক্ষাতেই ছিলেন। ‘হ্যালো, ইয়্যাং ম্যান। কি খবর, এসে পড়েছ বুঝি। তোমার টাইম সেন্স তো বেশ ভালো দেখছি। বুঝলে, মর্নিং শোজ দ্য ডে। তুমি যেভাবে আমার কেসটা লড়লে, আই অ্যাম জাস্ট ইম্প্রেসড।’

‘না কাকু, অমনভাবে বলবেন না। আমি আমার সাধ্যমতো কেবল চেষ্টা করেছি। ওই যে কথায় আছে না-“বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী”।’ মর্তুজা বেশ একটা আত্মবিশ্বাসের সাথেই বলল।

‘দ্যাটস দ্য স্পিরিট। আরে এই তো চাই। তা দাঁড়িয়ে কেন, বসো আর বলো, কী ভাবছ এখন। লাইফে সেটেল হতে হবে তো, বিয়েথা করতে হবে তো নাকি।’ প্রশান্ত বাবুকে আজ দারুণ ফ্রেশ লাগছে। ম্যারুন রঙের পাঞ্জাবি, গায়ে সিল্কের বাদামি শাল জড়ানো। মুখে নির্ভার হাসি। হবেই তো। বুকের ওপর চেপে থাকা জগদ্দল পাথর নেমে গেছে তাঁর। মাথার ওপর থাকা মিথ্যে খুনের দায় এখন আর নেই।

‘না মানে কাকু, এখনো সেভাবে কিছু ভাবিনি।’ মর্তুজা কিছুটা লজ্জা পেল।

‘এই হলো তোমাদের জেনারেশনের এক দোষ। কিছুই তোমরা ঠিক করে উঠতে পারনা। আমার মেয়েটাও হয়েছে তাই। বিয়ের নাম শুনলে নাকি ওনার জ্বর আসে। আরে, বিয়েটা কি জানো তো বাছা! বিয়ে হলো “দিল্লিকা লাড্ডু, জো খায়া ও পস্তায়ে জো নেহি খায়া ও ভি পস্তায়া”। তাহলে শেষমেশ কি দাঁড়াল ব্যাপারটা, খেয়ে পস্তানোই ভালো, তা–ই না।’ এই বলেই প্রশান্ত বাবু অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন।

তখনই শ্রাবণী চা নিয়ে এল। ‘বাবা, তুমি আবার শুরু করেছ। বাবার কথায় আপনি কিছু মনে করবেন না উকিলবাবু। বাবার খালি ওই এক কথা, বিয়ে আর বিয়ে। যেন বিয়ে ছাড়া জীবনে আর করবার কিছুই নেই।’

বাবা মেয়ের খুনসুটি আরও কিছুক্ষণ চলল। আড্ডায় আড্ডায় সময়টা বেশ কেটে গেল। প্রশান্ত বাবু চা খাওয়া শেষ করে কাজের দোহাই দিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলেন। তিনি বোধহয় চাইছিলেন যেন মর্তুজা আর শ্রাবণী নিজেদের মধ্যে কিছুটা সময় কাটায়। দুজনের মধ্যে ‘কাবাব মে হাড্ডি’- হতে চাননি!

অনেকক্ষণ বাদে একসময় মর্তুজা যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াল। ‘এবার আমাকে যেতে হবে।’

‘এখনই চলে যাবেন, এই তো এলেন। তা আরও কদিন থেকে গেলেই পারতেন।’ শ্রাবণী কেন জানি মর্তুজাকে আটকাতে চাইছে। ওর কণ্ঠে কিসের যেন আহ্বান!

‘না, আজই ফিরতে হবে। আসলে কলকাতার বাইরে এলে বেশি দিন থাকি না। বাবা চলে যাওয়ার পর, মা আমাকে ছাড়া থাকতে পারেন না।’ মর্তুজার হৃদয় শ্রাবণীর অব্যক্ত আহ্বানে সাড়া দিল না।

‘সিনাকি হৈ ভাল লাগিল!’ শ্রাবণী, মর্তুজার চোখে চোখ রেখে আচমকা বেশ একটা আকুলতায় বলে ফেলল কথাটা। কিন্তু এর মানে কি!

মর্তুজা কথাটা আগে কোনোদিন শোনেনি। একপ্রকার অবাক হয়েই, বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো শ্রাবণীর মুখের দিকে। ‘ঠিক বুঝলাম না।’

শ্রাবণী এক গাল হেসে বলল, ‘বুঝলেন না তো। আগে শোনেননি কখনো, তা–ই না। এটা অসমীয়া ভাষা। এর মানে হলো, আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে ভালো লাগল। কথাটা আমিও আগে জানতাম না, এখানে এসে শুনেছি।’

‘ও আচ্ছা।’ কথাটা শুনে মর্তুজার ঠোঁটেও এক চিলতে হাসির রেখা ফুটে উঠল। মনে মনে ভাবল, ঠিক কি চাইছে ও। খানিক পরে অবশ্য নিজেই আবার নিজেকে সামলে নিল। এটাকে খুব একটা পাত্তা দিল না সে।

শ্রাবণীর কাছ থেকে শেষ বারের মতো বিদায় নিয়ে মর্তুজা বেরিয়ে পড়ল। একটা ট্যাক্সি ডেকে তাতে উঠে বসল। এয়ারপোর্ট যাবে। বাড়ির জন্য মন কেমন করছে তাঁর।

শ্রাবণী আর মর্তুজার গল্পটা বেশিদূর এগোয়নি। এ যাত্রায় পুরুষের বাহুবন্ধনে আটকা পড়েনি নারী। শ্রাবণীর জীবনে মর্তুজা এক পরিযায়ী পাখির মতোই এসেছিল। যে কি না আবার তার নীড়ে ফিরে গেছে। মর্তুজার সঙ্গে শ্রাবণীর আবার কোনো দিন দেখা হয়েছিল কি না, তা অবশ্য জানা যায়নি। আচ্ছা, ওরা কি একে অপরকে ভালোবেসে ফেলেছিল। হতে পারে, আবার না–ও হতে পারে। শেষ...

লেখক: আসিফ আল মাহমুদ, স্নাতকোত্তর, শিক্ষার্থী

*নাগরিক সংবাদ-এ ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]