অধ্যাপক আবদুল কাদির ভূঁইয়া: একজন আদর্শ শিক্ষক-অভিভাবক

অধ্যাপক মোহাম্মাদ আবদুল কাদির ভূঁইয়াছবি: সংগৃহীত

গত ৩০ মে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য মোহাম্মাদ আবদুল কাদির ভূঁইয়ার চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী। কর্মযোগী, আদর্শ ও শিক্ষার্থীবান্ধব শিক্ষক হিসেবে পরিচিত অধ্যাপক ভূঁইয়া ২০২০ সালের গত ৩০ মে ঢাকার মেরুল বাড্ডার নিজ বাসায় শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন।

মোহাম্মাদ আবদুল কাদির ভূঁইয়া ছিলেন বাংলাদেশের একজন প্রথিতযশা শিক্ষক ও সমাজবিজ্ঞানী। তিনি ১৯৪৫ সালের ২০ অক্টোবর নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার পাঁচরুখী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি গভর্নমেন্ট মুসলিম হাইস্কুল (ঢাকা) থেকে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। এরপর ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে মাস্টার ডিগ্রি অর্জন করে ১৯৬৮ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। পরের বছর একটি স্বতন্ত্র বিভাগ হিসেবে সমাজবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি সেখানে যোগ দেন। ১৯৭৯ সালে দিল্লি স্কুল অব ইকোনমিকস (ভারত) থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি দীর্ঘ প্রায় ৪৪ বছর সমাজবিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষকতা করেন। শুরু থেকেই বিভাগটির নানামুখী উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন। ১৯৮০ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত তিনি বিভাগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। পাশাপাশি বিভিন্ন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট, সিনেট, একাডেমিক কাউন্সিল এবং ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের বোর্ড অব গভর্ন্যান্সের সদস্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তিনি ১৯৮৪ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত শেরেবাংলা হলের প্রাধ্যক্ষ ও ১৯৯৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ২০০১-০৫ সাল পর্যন্ত খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ২০১২ সালে কর্মজীবন থেকে অবসর গ্রহণের পর তিনি ২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত খাজা ইউনুস আলী ইউনিভার্সিটি, সিরাজগঞ্জে উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ইন্ডিয়ান সোসিওলজিক্যাল সোসাইটি, এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ ও বাংলা একাডেমির জীবন সদস্য এবং আমেরিকান সোসিওলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য ছিলেন।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালে আমি অধ্যাপক মোহাম্মাদ আবদুল কাদিরকে শিক্ষক হিসেবে পাই। প্রথমে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র এবং পরে ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের ফেলো হিসেবে তাঁর তত্ত্বাবধানে পিএইচডি করি। সেই সুবাদে স্যারের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল দীর্ঘ প্রায় ২৭ বছরের। তাঁর বেশ কিছু গবেষণাকাজে সহযোগী হিসেবে কাজ করা ও সহযাত্রী হিসেবে দেশের নানা স্থানে ভ্রমণের কারণে তাঁর কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ ঘটে। তাঁর সান্নিধ্যে এসে তাঁকে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে জানার সুযোগ পাই। তাঁর ব্যক্তিত্ব, মহত্ত্ব ও জ্ঞানের গভীরতায় বিমোহিত হই। মূলত তাঁর জীবনযাপন ও সামাজিক যোগাযোগ রক্ষার ধরন, তাঁর চিন্তাজগতের ব্যাপ্তি এবং সততা, সময়ানুবর্তিতা ও পরোপকারী স্বভাবের কারণে তিনি আমার কাছে একজন অনুকরণীয় আদর্শ শিক্ষক ও অভিভাবক।

স্যার লেখালেখির চেয়ে বলতে বেশি পছন্দ করতেন। তাঁর লিখিত গ্রন্থ সংখ্যা ২। এগুলো হলো ‘স্যার সৈয়দ আহমদের রাজনৈতিক ও সামাজিক চিন্তা’ ও ‘সমাজবিজ্ঞানের তত্ত্ব: নির্বাচিত সমাজবিজ্ঞানীদের অবদান’ (সহলেখক আমি)। এ ছাড়া তিনি সামাজিক বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে ১৫টি গবেষণা প্রবন্ধ রচনা করেছেন, যেগুলো দেশ-বিদেশের মানসম্মত জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। একাডেমিক জীবনে তিনি সরকারি অনুদানে অনেক গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা প্রকল্প সম্পাদন করেছেন। এ ছাড়া তিনি দেশ-বিদেশের বহু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সেমিনার ও কনফারেন্সেও যোগ দেন।

শুধু সমাজবিজ্ঞান বিভাগ নয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন প্রশাসনিক পদে নিয়োজিত থেকে ভূঁইয়া স্যার সামগ্রিকভাবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃহত্তর কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি সৎ, দক্ষতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন।  

ভূঁইয়া স্যারের সৌজন্য ও ভদ্রতাজ্ঞান ছিল শিক্ষণীয়। আমাকে তিনি শুরু থেকেই তুমি সম্বোধন করতেন। মাস্টার্স শেষ করেই তাঁর পরামর্শে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএসে এমফিল কোর্সে ভর্তি হই। ভর্তির পরপরই তিনি একদিন তাঁর অফিস সহকারীর মাধ্যমে আমাকে একটা চিঠি পাঠান। খামের ওপরে ও চিঠির শুরুতে তিনি আমাকে ‘জনাব রেজাউল করিম’ সম্বোধন করেন। তিনি ওই অফিস সহকারীকে বলেছিলেন, ‘আইবিএসে গিয়ে রেজাউল করিম স্যারকে চিঠিটা দেবে’। অফিস সহকারী আইবিএসে এসে রেজাউল করিম নামে কোনো স্যারকে খুঁজে না পেয়ে, আমাকে এসে জিজ্ঞাসা করেন যে “রেজা ভাই ভূঁইয়া স্যার রেজাউল করিম স্যারকে দেবার জন্য একটা চিঠি পাঠিয়েছেন, কিন্তু আমি এখানে এই নামে কোনো স্যারকে খুঁজে পাচ্ছি না। আপনি কি ওনাকে চেনেন?” আমি চিঠিটি হাতে নিয়ে দেখি আমার চিঠি। আমি তাঁকে বলি এটা তো আমার চিঠি। তখন সে আমাকে বলে “আপনি আবার স্যার হলেন কবে?” এভাবেই স্যার অন্যকে সম্মানিত করতেন।’

গুরুভক্তিতে ভূঁইয়া স্যার ছিলেন অতুলনীয়। তিনি তাঁর বন্ধুবান্ধব, সহকর্মী, শিক্ষকেরা ও কিছু শিক্ষার্থীর সঙ্গে নিয়মিত টেলিফোনে যোগাযোগ রাখতেন। কাজটি তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে করতেন। তাঁর শিক্ষকদের কেউ রাজশাহীতে একাডেমিক কাজে বা বেড়াতে এলে তিনি তাঁদের কোথায় রাখবেন, কী খাওয়াবেন, কীভাবে যাবেন ইত্যাদি বিষয় নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়তেন। তাঁরা যেখানেই অবস্থান করুক না কেন, স্যারের বাসায় এক বেলা খেতে হতো। আবার বিদায়বেলায় নানা প্রকার উপঢৌকন প্রদান করতে ভুলবেন না।

কাউকে উপহার প্রদান ছিল ভূঁইয়া স্যারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তাঁর বাসায় কেউ গেলে তিনি তাঁকে কোনো না কোনো উপহার দিতেন। এ ছাড়া বিভিন্ন উৎসব-পার্বণে তাঁর প্রিয়জনদের নিয়মিত উপহার পাঠাতেন। রাজশাহীতে থাকার কারণে তিনি আম ও লিচুর মৌসুমে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা তাঁর সুহৃদদের ওই সব ফল পাঠাতে ভুলতেন না। আমি নিজে যে তাঁর কাছ থেকে যে কত বই, কলম, ডায়েরি, ক্যালেন্ডার, শার্ট, টাই পেয়েছি, তার হিসাব আমার জানা নেই। আমার মতো অনেকেই তাঁর কাছ থেকে এসব উপহার নিয়মিত পেত। এমনকি তাঁর নিজের সন্তানদের কাছ থেকে পাওয়া উপহারও তিনি অন্যদের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন।

জীবন চলার পথে তাঁর কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি। যেমন পোশাকে সব সময় পরিপাটি থাকতে হবে। পোশাকের মূল্য যা-ই হোক না কেন, তা সুন্দর করে পরিধান করতে হবে। দিনের কাজগুলো সকালে ঘুম থেকে উঠে কাগজে লিখে ফেলতে হবে। যেকোনো অনুষ্ঠানে নির্ধারিত সময়ের ১৫ মিনিট আগে উপস্থিত হতে হবে। কারও ব্যক্তিগত গাড়িতে চড়লে, যদি গাড়ির মালিক চালকের সিটে বসেন, তবে অবশ্যই তাঁর পাশের সিটে বসতে হবে। যেকোনো অফিসে গিয়ে প্রথমে নিজের পুরো পরিচয় দিয়ে কথা বলতে হবে ইত্যাদি।

আসলে তাঁকে হারিয়ে আমরা হারিয়েছি একজন আদর্শ শিক্ষক, একজন অভিভাবক। সবার কাছে তিনি ছিলেন একজন আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব। সত্যি বলতে কি, আজকে আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, তার ভিত্তি হলো অধ্যাপক ভূঁইয়া। স্যারের চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর আত্মার মাগফিরাত কামনা করি।

  • নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]