মিলি ও বিড়ালছানা

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

রক্তজবা ফুল গাছে নতুন ফুল ফুটেছে। মিলি প্রতিদিনের মতো আজও বিকেলে অবসর সময় কাটানোর জন্য তার হাতে গড়ে তোলা বাগানটায় সে এসেছে। বাগানে এসে সবার আগে তার চোখ পড়ল রক্তজবা ফুলটির দিকে। এ কী, আনন্দের পরিবর্তে মিলির চোখ বেয়ে জল পড়ছে।

মা-বাবার একমাত্র আদরের মেয়ে মিলি। তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী। সে চুপচাপ থাকতে ভালোবাসে। চুপচাপ থাকলেও সে লেখাপড়ায় বেশ ভালো। সে নিয়মিত পাঠশালায় যায়, মনোযোগ দিয়ে শিক্ষকদের কথা শোনে এবং প্রতিদিনের পাঠ প্রতিদিন সে অনুশীলন করে। দৈনন্দিনের পাঠ চুকিয়ে বাকি সময়টা সে তার ফুলবাগানে ব্যয় করে। পরিচর্যা করে ফুল গাছের। আর তার এই কাজে সহযোগিতা করে মিশু।

মিশু হচ্ছে, দেখতে ধবধবে সাদা এক বিড়ালছানা। মিশুর সঙ্গে মিলির প্রথম দেখা, সেই ফুলবাগানেই হয়েছিল। মিলির ঠিক মনে আছে, গত বছর ছুটির দিন শুক্রবার ভোরে ঘুম থেকে উঠে, সে তার বাগানে চলে আসে। বাগানের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে তার নজর কাড়ে এক বিড়ালছানা। বিড়ালছানাটি একা একা তার বাগানের মধ্যে খেলা করছে। কিন্তু বিড়াল ছানাটি কোথা থেকে এসেছে, মিলি তা জানে না। মিলির বিড়ালছানাটির প্রতি মায়া হয় এবং ভালোবাসা কাজ করে। সে বিড়ালছানাটি কোলে তুলে নেয় এবং বলে আহ! তুমি একা একা খেলা করছ, তোমার কোনো বন্ধু নেই? ঠিক আছে চিন্তা কোরো না, আজ থেকে আমি তোমার বন্ধু। সে বিড়ালছানাটিকে বাড়ি নিয়ে আসে এবং তার মাকে ডেকে বলে, ‘মা, মা! দেখো আমার নতুন বন্ধু পেয়েছি। আজ থেকে ও আমাদের সঙ্গেই থাকবে।’ মা দেখে বলল, ‘ঠিক আছে সোনা।’

সেদিন থেকে মিলি, বিড়ালছানাটির আদর-যত্ন করে, খাবার খাওয়ায়। মিলির ঘরেই তাকে থাকতে দেয় এবং বিড়ালছানাটিকে ঘুম পাড়িয়ে দেয় তার বিছানায়। কিছুদিনের মধ্যে বিড়ালছানাটির সঙ্গে মিলির বেশ খাতির হয়, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে তাদের মধ্যে। মিলি পাঠশালায় যায়, ছুটি হওয়ার পর দ্রুত বাড়ি চলে আসে, বিড়ালছানাটির সঙ্গে খেলা করে এবং সে যখন পড়তে বসে, বিড়ালছানাটিও তার কাছে টেবিলের এক কোনায় বসে থাকে।

তবে একটা বিষয় নিয়ে মিলি খানিকটা চিন্তিত। তাকে চিন্তিত দেখে, তার মা তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার কী হয়েছে সোনা, তোমাকে এত চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন?’ জবাবে মিলি বলল, ‘মা, বিড়াল ছানাটির সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হলো, অথচ এখনো তো ওর নাম রাখা হয়নি।’ মা বলল, তাহলে এ কারণে তোমার মন খারাপ। মিলি—জি মা। মা তাঁর মেয়ের এমন ভাব দেখে মজার ছলে মুচকি হেসে বললেন, ‘আচ্ছা মিলি, বিড়ালছানাটি যেহেতু তোমার সঙ্গে বেশ মিশুক প্রকৃতির, তাহলে ওর নাম মিশু রাখলে কেমন হয়?’ মিলির নামটি পছন্দ হয়। সে বলে, বাহ! নামটা তো সুন্দর। ঠিক আছে মা! তাহলে আজকে থেকে বিড়ালছানাটিকে মিশু বলে ডাকব। ওর নাম রাখা হলো মিশু।

মিলি এখন বিড়াল ছানাটিকে মিশু বলে ডাকে, মিশুর সঙ্গে কথা বলে। মিলির পাঠশালায় ঘটে যাওয়া মজার সব কথা মিশুকে বলে, আর হাসে। সে তার মনের সব কথা বলে মিশুকে। মিশুও তাকে বেশ বুঝে। কখনো মিলির মন খারাপ দেখলে মিশু তার চারপাশে ঘুরে আর মিউ মিউ করতে থাকে। মিলি বুঝতে পেরে তার মন খারাপের কারণ বলে। আর মিশু তা চুপচাপ মনোযোগ দিয়ে শোনে। তখন মিলির মন ভালো হয়ে যায়।

মিলি এখন বিকেলের অবসর সময়ে মিশুকে নিয়ে ফুলের বাগানে যায়। মিশু সেখানে খেলা করে, আর মিলি ফুল গাছগুলোর পরিচর্যা করে। আবার মিলি যখন মিশু বলে ডাক দেয়, মিশু দৌড়ে তার কাছে চলে আসে। আজকে মিলি বাগানে গিয়ে মিশুকে বলছে, ‘শোন মিশু, আগামীকাল শুক্রবার, আমার ছুটির দিন। তোমাকে নিয়ে নার্সারিতে যাব, কিছু ফুল গাছ ক্রয় করব। এ কথা মিলি তার মাকেও বলে। তার মা তাকে বলে, ‘ঠিক আছে সোনা, আমি সঙ্গে করে নিয়ে যাব।’ পরদিন মিশুকে নিয়ে মিলি তার মায়ের সঙ্গে নার্সারিতে যায়। মিলি অনেকগুলো ফুলের গাছ পছন্দ করে এবং মিশুকে বলে, ‘আমি তো অনেকগুলো ফুলগাছ পছন্দ করেছি, এবার তুমি একটা ফুলগাছ পছন্দ করো মিশু। মিশুকে সে একা ছেড়ে দেয়, মিশু ঘুরতে ঘুরতে একটি রক্তজবা ফুল গাছের চারার কাছে বসে পড়ে। মিলি বলে, বুঝতে পেরেছি, তোমার এই গাছটি পছন্দ হয়েছে। তখন মিশু মিউ মিউ করতে থাকে। মিলি বলে, ঠিক আছে বাবা নিচ্ছি, তোমার পছন্দের রক্তজবা ফুল গাছটি না নিয়ে কি পারি? আমার বন্ধু মিশুর পছন্দ বলে কথা।

ফুল গাছগুলো ক্রয় করে একটা গাড়িতে গাছগুলো তুলে বাড়ি ফিরে আসে তারা। বাড়ি ফিরে মিলি আর মিশু গাছগুলো বাগানে রোপণ করে। এরপর নিয়মিত ওরা গাছগুলোর দেখাশোনা করে, গাছে পানি দেয়, পরিচর্যা করে। মিশু এখন বাগানে গেলেই রক্তজবা ফুল গাছটির কাছে বসে পড়ে। আবার যখন মিলি পাঠশালায় যায়, তখন মিশু একা একা বাগানে গিয়ে রক্তজবা ফুল গাছটির কাছে বসে থাকে। এদিকে মিলি পাঠশালা থেকে বাড়ি ফিরে মিশুকে না পেয়ে ভয় পেয়ে যায়, পুরো বাড়ি তন্নতন্ন করে খোঁজে আর মিশু, মিশু বলে ডাকে। মিলি খুঁজতে খুঁজতে তার বাগানে চলে আসে, দেখা পায় মিশুর। মিশু রক্তজবা ফুল গাছটির কাছে বসে আছে। মিলি বলে, বাহ! গাছটি তোমার এত পছন্দ হয়েছে মিশু। সারা দিন এখানেই বসে থাকো, আর আমি তো তোমাকে খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে যাচ্ছি। এবার চলো, আমার অনেক ক্ষুধা পেয়েছে। চলে আসে ওরা দুজন এবং খাবার খায়। এর পর থেকে মিলি পাঠশালায় গেলে মিশু গিয়ে বসে থাকে রক্তজবা গাছটির নিচে। এভাবেই একদিন মিলির পাঠশালায় মজার এক ঘটনা ঘটে। মিলি ছুটির পর দ্রুত বাড়ি ফিরে আসে, মিশুকে এই মজার ঘটনা শোনাতে। কিন্তু সে বাড়ি ফিরে মিশুকে দেখতে পায় না। সে ভাবে মিশু বোধ হয় বাগানে রক্তজবা ফুল গাছটির কাছে আছে। তাই সে ব্যাগ রেখে দ্রুত বাগানে যায় মিশুর খোঁজে। তবে বাগানেও মিশুকে সে দেখতে পায় না। তখন সে চিন্তিত হয়ে পড়ে। মিশুকে না পেয়ে মিলি তার মায়ের কাছে গিয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলে, ‘মা, তুমি কি মিশুকে দেখেছ? আমি ওকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না।’ তার মা তাকে বলল, ‘আমি তো দেখিনি। তবে কান্না কোরো না সোনা, মিশু হয়তো কোথাও গিয়েছে, চলে আসবে।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে এল, তবু বাড়ি ফিরল না মিশু। এদিকে মিলির কান্না যেন থামছেই না, বরং বেড়েই চলেছে। সে খাবারও খাচ্ছে না। শুধু মিশু মিশু বলে ডাকে আর কান্না করে। তার মা তাকে বলে, সোনা এত কান্না করে না, মিশু হয়তো পথ ভুলে কোথাও চলে গিয়েছে, সে আবার ফিরে আসবে। মিলি যেন কোনো কথা বুঝতেই চাইছে না, সে শুধু কান্নাই করছে। কান্না করতে করতে একসময় সে ঘুমিয়ে পড়ে। সকালে ঘুম থেকে উঠেই আবার সে মিশুকে খোঁজে, না পেয়ে আবার কান্না করে। কিন্তু মিশুর কোনো খোঁজ পায় না। এভাবে দেখতে দেখতে কয়েক দিন কেঁটে গেল, কয়েক দিন থেকে সপ্তাহ, সপ্তাহ থেকে মাস কেটে গেল। তবু মিশুর কোনো খোঁজ হলো না। মিলিও আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। স্বাভাবিক হলেও মাঝেমধ্যে তার মিশুর কথা খুব মনে পড়ে, তখন সে কান্না করে। এমনই কোনো এক শুক্রবার সকালে মিলি তার ফুল বাগান দেখতে আসে, সে দেখতে পাই রক্তজবা ফুল গাছে নতুন ফুল ফুটেছে। কিন্তু আনন্দের পরিবর্তে তার দুচোখজুড়ে অশ্রু ঝরছে। ফুটন্ত রক্তজবা ফুলটি দেখে মিলির মিশুকে ভীষণ মনে পড়ছে।

*লেখক: মোফাজ্জল হোসেন শান্ত, উল্লাপাড়া, সিরাজগঞ্জ

**নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]