বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষ: কিছু মিশ্র অভিজ্ঞতা ও বাস্তবতা
বিশ্ববিদ্যালয়। এটা শুধু একটা নামই নয়, এটা ছুঁয়ে দেখা একটি স্বপ্ন। একটা ইতিহাস। মিশ্র অনুভূতিঘেরা চরম বাস্তবতার একটি উত্তপ্ত রণক্ষেত্র।
বিশ্ববিদ্যালয়ের যথার্থ সংজ্ঞা নিয়ে নানা মত–অভিমত আছে দুনিয়াজুড়ে। এর মধ্যে মোটামুটি গ্রহণযোগ্য একটা সংজ্ঞা হলো, মনটাকে বিশ্বের মতো বড় করে চিন্তা করতে পারা যায় যে ধাপে গিয়ে; সেটার নামই বিশ্ববিদ্যালয়।
এর মানে হলো, মনটাকে বড় করে করতে হয় বিশ্ববিদ্যালয় থাকাকালীন অন্তত চার-পাঁচ কিংবা অবস্থাভেদে তার চেয়েও বেশি বছর ধরে। সেটা একাডেমিক জ্ঞানের দিক থেকে হোক, মেধাচর্চার দিক থেকে হোক কিংবা হোক সামাজিক চিন্তার দিক থেকে।
এই দীর্ঘমেয়াদি যাত্রাপথের শুরুটা যদি সুন্দর, সাবলীল ও মসৃণভাবে কাটানো যায়, তাহলে বাকি সময়টাও খুব উপকারে আসে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির পর অনেকেরই প্রথম বর্ষটা খুব বেখেয়ালিভাবে কেটে যায়। আবার অনেকে চায় শুরু থেকেই নিজেকে গুছিয়ে, পরিকল্পনামাফিক দীর্ঘ যাত্রাপথ পাড়ি দিতে। আমাদের আজকের কথামালা তাদের জন্য সাজানো, যারা একেবারে গোড়া থেকেই নিজেদের দায়িত্বজ্ঞান সম্পর্কে জ্ঞাত।
বিশ্ববিদ্যালয় যেহেতু বড় আর ব্যাপক অর্থের একটি বিশাল শব্দ, তাই স্বভাবতই এখানে ব্যক্তির চিন্তাভাবনা ও মানসিকতাগুলোকে প্রসারিত করতে হয়।
ভর্তির পর প্রথম বর্ষে কিছু বিষয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে খুব ভালোভাবেই জেঁকে বসে, তার একটি হলো নিজের ডিপার্টমেন্ট ছাড়া অন্য ডিপার্টমেন্টকে বা অন্য বিশ্ববিদ্যালয়কে ছোট করা। এটা খুবই অপ্রয়োজনীয় কাজ। যা প্রয়োজনীয়, তা হলো সেই বিষয়গুলোর অবদান সম্পর্কে কিছুটা ধারণা রাখা। তাতে জ্ঞানের পরিধি বাড়বে। পাশাপাশি অন্যদের ছোট না করে সম্মান করার জায়গাটাও বাড়বে।
ধরা যাক, তুমি কোনো এক ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের শিক্ষার্থী। তোমার ধারণা, দর্শন, ইতিহাস বা মনোবিদ্যা তেমন কোনো বিষয়ই না, কারণ এগুলো অতি সহজ! এগুলোতে আবার পড়ার কী আছে!
এখন তুমি Google বা ChatGTP করো, ‘Why reading philosophy is necessary?’
গুগলের রেজাল্টে যা যা জানবে, তাতে তোমার চোখ কপালে ওঠার জোগাড় হবে। একই সঙ্গে এটাও বুঝতে পারবে যে পৃথিবীতে যে কত কিছু জানার আছে। আর আমরা কত স্বল্প ও সামান্য বিষয় জেনেই মনে করি, ‘অমুক ডিপার্টমেন্টে জব কম, তাই এই ডিপার্টমেন্টের স্টুডেন্ট সবাই খারাপ!’ কিন্তু আদতে সেটা নয়।
এবার আসি একটু ভিন্ন কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ আলাপে—
প্রাইড
প্রথম বর্ষে ভার্সিটি, হল ও ডিপার্টমেন্ট নিয়ে আগ্রহ-উদ্দীপনা থাকে তুঙ্গে। ফ্রেন্ড সার্কেল, সিনিয়র-জুনিয়র ইত্যাদি বিষয় নিয়েও প্রথম দিকে খুব মাতামাতি হয়। কিন্তু সেগুলো নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করলে চলবে না। সবই লিমিটের মধ্যে রেখে নিজের মতো করে বিষয়টা মানিয়ে নিয়ে থাকা উচিত। মনে রাখতে হবে, ভার্সিটি পড়ুয়া অনেক শিক্ষার্থী প্রথম বছরে এগুলোর পেছনে ছুটতে গিয়ে ঝড়ে যায়। পরে আর ব্যালেন্স করা সম্ভব হয় না। এভাবে উন্নত মেধার অপমৃত্যু ঘটে।
রোডম্যাপ
বিশ্ববিদ্যালয়জীবন কিন্তু খুব বড় না! দেখতে দেখতে সময়গুলো নিমিষেই পার হয়ে যাবে। শেষ সময়ে অনেকেই আফসোস করে, ‘ইশশ! কত কিছু করা যেত প্রথম বর্ষে! আরও কত সুন্দর করে সময়গুলো কাটানো যেত! পড়াশোনা আরও পরিকল্পনামাফিক করা যেত! সিজিপিএ–টা শুরুতে আরও ভালো তোলা যেত!’ শেষ সময়ে যেন এমন আফসোস না করতে হয়, সে জন্য শুরু থেকেই নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে স্বপ্ন, চিন্তা ও পরিকল্পনার একটা রোডম্যাপ বানিয়ে সে অনুযায়ী যতটা পারা যায়, পালন করার চেষ্টা করা যেতে পারে।
বন্ধুত্ব
এটা নিয়ে বললে শেষ হবে না। তবু একটু বলি নতুন জায়গা, নতুন পরিবেশ। মানিয়ে নেওয়ার একটা চ্যালেঞ্জ সব সময় থাকবেই। এখানে নানামুখী মানুষের সঙ্গে আলাপ হবে। কিন্তু নিজের স্ট্যাটাস, অর্থনৈতিক কিংবা পারিবারিক অবস্থা নিয়ে হীনম্মন্যতায় ভোগা যাবে না। দিনশেষে যুদ্ধটা নিজের। আত্মবিশ্বাস রেখে, সবার সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলে নিজের যুদ্ধটা নিজেকেই করতে হবে। এখানে সবাইকে বন্ধু বানানোর প্রয়োজন নেই। কিন্তু সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখা উচিত। এতে অনেক উপকৃত হওয়া যায়। পাঁচ বছর কিংবা তার কিছু বেশি সময়ের জন্য কারও সঙ্গে খারাপ সম্পর্ক করার যেমন দরকার নেই, তেমনই কারও সঙ্গে বাঁচা-মরার বন্ধুত্ব করারও কোনো প্রয়োজন নেই। তবে সুসম্পর্ক রাখলে নানাবিধ লাভ আছে।
ক্লাবিং করা
প্রথম বর্ষে এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের প্রতিভাগুলো বিকশিত করার একটা অন্যতম সুযোগ হলো সংশ্লিষ্ট ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত থাকা। এতে করে নিজের দক্ষতাগুলো শাণিত করার পাশাপাশি প্রচুর মানুষের সঙ্গে পরিচিত হওয়া যায়। সবার সঙ্গে দেখা হলে আলাপ হয়। সুন্দর সময় কাটে।
তা ছাড়া ক্লাব করা মানুষগুলো সুন্দর রুচিবোধসম্পন্ন হয়ে থাকে বিধায় তাদের সংস্পর্শে থাকলে জীবন নিয়ে হতাশ হওয়ার পসিবিলিটি কমে যায় শতগুণ। গড়িমসি করে প্রথম বর্ষে নিজের বা ক্যারিয়ারের সঙ্গে যায়, এমন ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত না হলে পরে আর ক্লাবিং করার ইচ্ছাটা থাকে না। তত দিনে মন উড়নচণ্ডী হয়ে যায়, ক্লাবিংও করা হয় না। এ জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষ হলো ক্লাবিং করার অন্যতম সময়।
পড়াশোনা
পড়াশোনার আসল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত ‘শেখা’। শুধু সিজিপিএর জন্য নয়। ‘ঠিকমতো ক্লাস না করে বা ক্লাসে মনোযোগী না হয়ে পরীক্ষার আগে নোট জোগাড় করে কোনো রকমে পরীক্ষা দিয়ে দেব’—এমন চিন্তা করাটা হলো বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে নিজেকে শেষ করার একটা অন্যতম পন্থা। পাস ঠিকই করা যায় এসব পরীক্ষায়। কিন্তু মাস্টার্স শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে নিজেকে প্রশ্ন করলেই বোঝা যায়, আসলে আমি কতটা শিখতে পেরেছি! একজন শিক্ষকের লেকচার শুধু একাডেমিক পড়াশোনার জন্যই নয়। তার ব্যক্তিত্ব, বাচনভঙ্গি, উপস্থাপনা, পাঠনশৈলী, অভিজ্ঞতা—সবকিছু থেকেই শেখা যায়। লেকচারের ফাঁকে শিক্ষকেরা অনেক সময় নিজ জীবনের কিছু টুকরা গল্প শেয়ার করেন। এগুলো নোট খাতায় ঠাঁই না পেলেও কিংবা বিসিএসে কাজে না এলেও একটা সময় এগুলোই জীবনচলার পাথেয়তুল্য কাজে দেবে। ১০০ শতাংশ অ্যাটেনডেন্সের চিন্তা না করে, ক্লাসের ১০০ শতাংশ সময়টা মনোযোগী হলে, জীবনে অনেক লাভবান হওয়া যায়; যেগুলো টাকা দিয়েও অর্জন করা যায় না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষ যেমন আনন্দের, তেমন ক্যালকুলেশন করে চলার মতো। প্রথম বর্ষ হলো ফুল ফোটার মৌসুম। এই ফুল ফোটার মৌসুমে যারা নিজেদের যত্ন নিতে পারে, আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে পারে, তারাই এগিয়ে থাকে। নয়তো স্বাধীনচেতা নীল চশমা দেখে আবেগের জোয়ারে গা ভাসিয়ে অনেকেই খেই হারিয়ে ঝরে পড়ে।
সবশেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষটাকে নিজের করে নিতে পারলে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাকি সময়টা এমনিতেই সহজ ও সাবলীল হয়ে যাবে।
*লেখক: মুহাম্মাদ মাহাদী, শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, সাভার, ঢাকা
‘নাগরিক সংবাদ’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]