রাজশাহীতে মিলছে মানবতার রুটি

‘রুটি ভান্ডার’- দেখলে মনে হবে এটা আবার কী! দাঁড়িয়ে পড়তে ইচ্ছা করবে। রাজশাহী শহরে এর আগে এ ধরনের দৃশ্য চোখে পড়েনি।

নানা বৈশ্বয়িক বিপর্যয়ে মানুষ ক্রমেই কোণঠাসা হয়ে পড়ছে। মানুষ তার ন্যূনতম চাহিদা মিটাতে হিমশিম খাচ্ছে। অনবরত বিপর্যয় বিশ্ব পরিবেশকে দিন দিন চরম দুর্বল পরিস্থিতির দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। খাদ্যদ্রব্য থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটাতে গিয়েও ঝুঁকির আশঙ্কায় মানুষের মনোবল কমে গিয়ে ঘটছে একধরনের মিথস্ক্রিয়ার পরিবর্তন। চরম ভোগান্তি আর খাদ্যাভাবের মতো সংকট মোকাবিলায় নিম্ন আয়ের মানুষের নাভিশ্বাস অবস্থা। ব্যবসা- বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও সামগ্রিক অর্থনীতির মারাত্মক সংকটের মুখে মানুষের ছুটাছুটি যেমন বেড়েছে, ইদানীংকালে তেমনি বেশির ভাগ মানুষের মধ্যেই অন্যের কোনো সমস্যা দেখলে তা এড়িয়ে যাওয়ার মানসিকতাও বেড়েছে। ছুটন্ত মানুষগুলো যে যার মতো ব্যস্ত নিজ নিজ লাভের আশায়। ছোটার ধরন, প্রকৃতি ও গতি ভিন্ন হলেও আমাদের চারপাশের যেকোনো সমস্যা যে কাউকেই যে আক্রান্ত করতে পারে, সেটা ভাবার মতো ফুরসত যেন কারও নেই।  যার যার নিজের কাজ নিজ ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ। অন্যের কোনো বিষয়ে নজর দেওয়ার সময় নেই কারও। ব্যাপারটা এমন, আরেকজনের সমস্যা তো আমার নিজের সমস্যা নয়!  আর এই ছুটন্ত ব্যস্ত মানুষগুলোই আমি, আপনি, আমরা সবাই।

তবে ব্যাতিক্রমও আছে।  কিছু মুক্তমনা মানুষ রয়েছেন, যাঁরা এই বৈরী সময়ে মানুষের জন্য কিছু করতে চাইছে। রাজশাহীতে এ ধরনের একটি ছোট উদ্যোগের কথাই আপনাদের জানাব।

শত ব্যস্ততার মধ্যেও চাইলেই যে সবাই পাশ কাটিয়ে যেতে পারে না তার নজির মিলল রাজশাহীর সাহেব বাজারসংলগ্ন জিরো পয়েন্টের একটি বেকারির (জান্নাত বেকারি) দোকানে। হঠাৎ ‘রুটি নিই রুটি দিই’ সাইনবোর্ডটি চোখে পড়তেই থমকে দাঁড়ালাম! কাছে যেতেই লক্ষ্য করলাম বেকারির ঠিক সামনে একটি লম্বা টুলের ওপর একটি বড়সড় মুখবন্ধ স্বচ্ছ কনটেইনার বাক্স রাখা। তাতে রঙিন লেবেল লাগানো বড় বড় হরফে যার একপাশে লেখা ‘আপনি ক্ষুধার্ত ও সামর্থ্যহীন হলে এখান থেকে রুটি নিন’, আর অপর পাশে লেখা রয়েছে ‘আপনি সচ্ছল ও আগ্রহী হলে রুটি দান করুন’। আর বাক্সের ওপরের প্রান্তে সব থেকে মোটা অক্ষরে লেখা আছে ‘রুটি ভান্ডার’।

‘রুটি ভান্ডার’ নামে এমন স্বেচ্ছাসেবী মানবতার ফেরিওয়ালাকে জানার কৌতূহল থেকেই আগ্রহভরে দেখলাম দুস্থ, অনাহারি ও সামর্থ্যহীনদের হাতে রুটি পৌঁছে দেওয়ার কি চমৎকার সূক্ষ্ম আয়োজন। বেকারির দোকানে ঢুকে ১০০ টাকার একটি নোট ধরিয়ে দিয়ে বললাম কটা রুটি বাক্সে দিয়ে দিতে। দেখলাম, ১০ পিস রুটি জমল তাতে। জান্নাত বেকারির একজন কর্মচারীর কাছে বিস্তারিত খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, এই মহতী উদ্যোগটির পুরো ব্যবস্থাপনায় রাজশাহী কলেজের এইচএসসি ১৯৯২–এর  ব্যাচ।

‘রুটি নিই, রুটি দিই’ স্লোগানকে সামনে রেখে তাঁরা তাঁদের রুটি ভান্ডারের কর্মসূচি শুরু করেছেন। আর এভাবেই তাঁরা ২ মাস ধরে এক পক্ষের দান করা রুটি আরেক পক্ষের ক্ষুধা মেটানোর মধ্যে মধ্যস্থতা করে চলেছে।

অভাবী দুঃসহ মানুষের পাশে দাঁড়াতে সম্প্রতি ‘রাজশাহী কলেজের এইচএসসি ১৯৯২ ব্যাচ’ ‘রুটি ভান্ডার’ নামে স্বেচ্ছাসেবামূলক এমনি এক মানবতাবাদের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে মহতি উদ্যোগ হাতে নিয়েছে।

কথা বললাম রাজশাহী কলেজের এইচএসসি-৯২ ব্যাচের একজন সমন্বয়কের (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) সঙ্গে। জানতে পারলাম, এইচএসসি-৯২ ব্যাচটি প্রতিদিন জান্নাত বেকারির নির্দিষ্ট বাক্সে ২০টি বনরুটি দান করবেন। আর জান্নাত বেকারি ক্ষুধার্ত ও অসামর্থ্যদের মধ্যে ১টি করে রুটি বিনা মূল্যে বিতরণ করবে এ মর্মে যে তারা কোনো মেয়াদোত্তীর্ণ রুটি রাখবে না, সেই সঙ্গে সব সময় রুটির সর্বোচ্চ মান ও রুটির সংখ্যা বহাল রাখবে। একই শর্তে অন্যেরাও বাক্সে রুটি দান করতে পারবে।

‘রুটি ভান্ডার’- এর এমন স্বেচ্ছাসেবী উদ্যোগের বিষয়টি খুবই আশান্বিত। উদ্যোক্তার দেওয়া তথ্য মতে, ক্ষুধার্ত শ্রেণির আরও একধাপ চাহিদা মেটাতে কর্মসূচি আরও দীর্ঘ করে রাজশাহী রেলওয়ে স্টেশনে বর্ধিত করার পরিকল্পনাও করা হচ্ছে। উদ্যোগটি আরও ছড়িয়ে দিতে পারলে এবং এ কাজে সচ্ছলরা সাধ্যমতো অংশ নিলে ক্ষুধার্ত ও সামর্থ্যহীনরা উপকৃত হবে।

দেশে হাজারো সমস্যা রয়েছে। শুধু রাষ্ট্র বা সরকার একা সেসব মীমাংসা করবে—এমনটা চিন্তা করা মানে নিজেদের দায়িত্ববোধের প্রশ্নে হেরে যাওয়া। যেকোনো জাতীয় সমস্যা মোকাবিলায় ব্যাক্তির অংশগ্রহণ ও সম্পৃক্ততা জরুরি। সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন এলাকায় সুবিধাবঞ্চিতদের স্বার্থে গড়ে তোলা ‘মানবতার দেয়াল’ নামে স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রমের মতো ‘রুটি ভান্ডার’ নামের মানবতাবাদী উদ্যোগটিও ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। সেই সঙ্গে সমাজের বিত্তবানরা যদি এ ধরনের উদ্যোগে এগিয়ে আসে তাহলে দুস্থ ও অসহায়দের বড় একটি অংশ উপকৃত হবে। এই ধরনের উদ্যোগ দেশময় ছড়িয়ে পড়লে দেশের অসহায় গরিব দুঃখীদের কষ্টের কিছুটা লাঘব হবে।
লেখা: শিউলী আকতার জেমি