বাবার সরকারি গাড়ি
১৬ জুন পাঠকের পাঠানো লেখা থেকে বাছাইকৃত লেখা প্রকাশিত হচ্ছে নাগরিক সংবাদে।
আমার বাবা অরুণ চন্দ্র দত্ত ছিলেন একজন সরকারি কর্মকর্তা। বাবার সরকারি চাকরির সুবাদে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় থেকেছি। সেই জীবনের কিছু স্মৃতি আজও মনে দোলা দেয়। সিলেটে দীর্ঘ সময় কাটে। দাদা তখন কুমিল্লা ক্যাডেট কলেজে পড়তেন, আমি ও আমার ছোট ভাই সিলেটের স্কুলে পড়তাম। মা ছিলেন সিলেটের বিমানবন্দরের কাছে একটি স্কুলের শিক্ষিক। আমরা থাকতাম পাঠানটুলা এলাকায়, যেখান থেকে মায়ের স্কুল অনেক দূরে ছিল।
তখন আমার বাবার একটি সরকারি গাড়ি ছিল, কিন্তু তিনি কখনোই এই গাড়ি আমাদের ব্যবহার করতে দিতেন না। বাবা বলতেন, এটি সরকারি কাজে ব্যবহারের জন্য, পারিবারিক কাজের জন্য নয়। তখন খুব রাগ হতো। স্কুলের অনেক বন্ধু তাদের বাবার গাড়িতে চড়ে স্কুলে যেত, আর আমি হেঁটে বা রিকশায়। আমার মাকেও তিনটি বাহন পরিবর্তন করে স্কুলে যেতে হতো।
অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় বাবার কাছে একটি সাইকেল চেয়েছিলাম। বাবা আমাকে একটি লেডিস সাইকেল কিনে দিয়েছিলেন। দাদা যখন ক্যাডেট কলেজ থেকে ছুটিতে বাড়ি আসতেন, তখন বাবা দাদার জন্য শিক্ষক ঠিক করে রাখতেন, যাতে দাদার পড়াশোনার সময় নষ্ট না হয়। একবার দাদার জন্য এম সি কলেজের একজন শিক্ষক ঠিক করা হয়েছিল এবং কলেজটি আমাদের বাসা থেকে অনেক দূরে ছিল। যাতায়াতের সমস্যা সমাধানে সিদ্ধান্ত হলো দাদা সাইকেল চালিয়ে যাবে। আর সেটি আমার লেডিস সাইকেল!
বাবা কিন্তু সন্তানদের অনেক ভালোবাসতেন। আমাদের তিন ভাই-বোনকে অনেক যত্ন করে বড় করেছেন। তাঁর চিন্তায় আমাদের লেখাপড়া ছাড়া আর কিছুই ছিল না। যখন যা চেয়েছি, বাবা চেষ্টা করেছেন, তা দেওয়ার জন্য। কলেজে পড়ার সময় মনে হলো, গিটার শিখব। গিটার কিনে দিয়েছিলেন এবং শিল্পকলা একাডেমিতে ভর্তিও করে দিয়েছিলেন। অনার্সে পড়ার সময় শিক্ষা সফরে বিদেশ যেতে দিয়েছিলেন শিক্ষক ও বান্ধবীদের সঙ্গে। মনে আছে, যেদিন বিমানবন্দরে যাচ্ছি সেদিন শৈত্যপ্রবাহ চলছিল। ট্যাক্সি করে যাওয়ার সময় ঠান্ডায় জমে যাচ্ছিলাম কিন্তু বাবা সরকারি গাড়ি ব্যবহার করেননি।
সরকারি ফোনের ক্ষেত্রেও বাবা তাঁর নিজস্ব নীতি অনুসরণ করতেন। অফিস ও বাসার ফোনের জন্য বাবা দুটি কাঠের বাক্স বানিয়েছিলেন যাতে তালা দেয়া যায়। শুধু ফোন রিসিভ করা যেত, ফোন করা যেত না। ফোন করতে বাবার অনুমতির প্রয়োজন হতো। তাই আমি কাউকে বলতাম না আমাদের বাসায় ফোন আছে। যখন অনার্সে পড়তাম, তখন এই নিয়ম একটু শিথিল হয়। কিন্তু বাসায় বলা ছিল, সরকার একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ বিল দেবে, এর বেশি হলে বাবাকে দিতে হবে। বাসায় আমিই বেশি ফোনে কথা বলতাম, তাই মাস শেষে আমি আতঙ্কের মধ্যে থাকতাম, যদিও কোনো দিন অঘটন ঘটেনি।
বাবার এতো নিয়মের কারণে শৈশবের অনেক নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হলেও, আজ আমি তার জন্য গভীর কৃতজ্ঞতা অনুভব করি। আজকে বাবা আমাদের মধ্যে নেই, কিন্তু বাবার কঠোর শৃঙ্খলা ও দায়িত্বশীলতার পাঠ তিন ভাই-বোনের জীবনে সঠিক পথে চলার প্রেরণা দিয়েছে। বাবার শিক্ষা ও আদর্শ আমাদের জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে দিশারি হয়ে আছে, আর আমরা তাঁর দেখানো পথে চলার চেষ্টা করছি।
*লেখক: লাকী দত্ত, শিক্ষিকা, হলি ক্রস বালিকা উচ্চবিদ্যালয়, ঢাকা
নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]