এক কাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই
আমি জীবনকে খুঁজি খুব সহজ অনুষঙ্গে। যে জীবনে যত চাওয়া, সে জীবন তত জটিল, তত বেদনার। কিন্তু না বাস্তবতা ভীষণ কঠিন। আপনি নিজেকে যতই নির্ভেজাল আর কলুষতা মুক্ত রাখতে চান না কেন, কেউ না কেউ কিছু না কিছু আগ বাড়িয়ে আপনার সহজ শান্ত নির্লিপ্ত জীবণটাকে ঠিক কাদা পানিতে মাছ মারার মতো ঘোলা করে দেবে।
তাই আমি চেষ্টা করি, যেকোনোভাবেই জীবনকে উপভোগ করতে। এ যে আজকের মেঘলা সকাল। একদমই ইচ্ছা করছিল না আয়েশের ঘুম নষ্ট করে সাত সকালে অফিস যাই। কিন্তু ওই যে বললাম, বাস্তবতা! সেই বাস্তবতা কে স্বীকার করেই বিছানা ছাড়তে হলো।
বাসার নিচে নেমে একটা রিকশা নিলাম। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে ততক্ষণে। বাসার নিচে নামতেই সৌভাগ্যবশত রিকশা পেয়ে গেলাম। রিকশাওয়ালা মামার কাছ থেকে পলিথিন পেপারটা নিয়ে নিজেকে কিছুটা সুরক্ষিত করে বললাম, ‘মামা আমাকে রাপা প্লাজার সামনে নামিয়ে দিন।’
মেঘলা আকাশ এবং শুক্রবারের সকাল হওয়াতে প্রকৃতিও খানিকটা সুনসান। বেশ আরাম লাগছিল চোখে সবকিছু। সকালের ঘুম ভেঙে কাজে যাওয়ার কঠিন বাস্তবতা যেন নিমিষেই ম্লান হয়ে গেল প্রকৃতির এমন শান্ত কমল নিস্তব্ধতার কল্যাণে।
পথে আসতে আসতে রিকশাওয়ালা মামার সঙ্গে দেশ নিয়ে দু–চারটা কথাও হলো। দেশ নিয়ে মামার কোনো আক্ষেপ নেই দেখলাম, যা হচ্ছা তাতে উনার কিছু যায় আসে না টাইপ একটা মতামত জ্ঞাপন করে আমাকে যথাস্থানে নামিয়ে দিলেন।
ততক্ষণে ঘড়িতে ৭টা বেজে ৩০ মিনিট। আমার অফিসের গাড়ি আসতে আরও প্রায় ১৫ মিনিট বাকি।
অন্য সময় হলে কী করতাম, জানি না। কারণ, আজকাল পৃথিবীর কোনো প্রাণীর সঙ্গেই কথোপকথনে জড়াতে আমার ভালো লাগে না। নীরবতাই এখন আমার ঘনিষ্ঠজন। তাই সচরাচর কাউকে আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞাসা করা হয় না তার কুশালাদি।
কিন্তু প্রকৃতির এমন স্নিগ্ধতায় কেন জানি কারও সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছা হলো। তাই আগ বাড়িয়েই জিজ্ঞাসা করলাম,
মামা আপনার নাম কী?
মোহাম্মদ ফরহাদ।
বাড়ি কোথায় আপনার?
আমার নিজের দ্যাশ বলতে কিছু নাই। ৫৩ বছর ধইরা ঢাকায় থাকি।
এখানে কোথায় থাকেন?
কেরানীগঞ্জ। একটা এলাকার নাম বলল আমার ঠিক মনে নেই।
কে কে আছে বাড়িতে?
তেমন কেউ নাই। আপন মা–বাবা, ভাইবোন কেউ নেই। দুইটা মাইয়া আছে তাদের বিয়া দিয়ে দিছি। এখন বাসায় বুড়াবুড়ি দুজন।
এই যে ফুটপাতে দোকান করছেন, রোজ কত টাকা চাঁদা দিতে হয়?
না না আমার কাউকে কখনো কোনো টাকাপয়সা দিতে হয় না। আগেও দেওয়া লাগে নাই, এখনো দিই না।
তাই? চাঁদা ছাড়া রাস্তায় কীভাবে ব্যবসা করছেন?
করছি তো প্রায় ৫০ বছর হইয়া গেল। আমার কাছে কেউ চাঁদা চায় না।
কেমন হয় বেচা বিক্রি?
হয় ভালোই। হালি দশেক কলা, পাউরুটি, বিস্কুট যা আনি, সবই আল্লাহর রহমতে শেষ হয়ে যায়।
কারা আপনার কাস্টমার?
এই আশপাশের মার্কেট-অফিস এরাই আসে চা কলা রুটি খাইতে।
কখন শুরু করেন দোকান আর শেষ হয় কখন বেচাকেনা?
শুরু করি এই তো এমন সময় (সকাল সাতটা-সাড়ে সাতটা) আর দোকান বন্ধ করি বেলা তিনটায়।
তিনটায় বন্ধ করেন কেন, চা তো সবাই খায় সাধারণত বিকেলে?
না মামা আমি থাকি না; কারণ, আমার নামাজ–কালাম পড়তে হয়।
এখানে একটা টুলে বসেও তো নামাজ পড়তে পারেন।
তা হয় না মামা। পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতার একটা ব্যাপার তো থাকে।
আমরা যখন কথা বছিলাম, তার ফাঁকে ফাঁকে বেশ কয়েকজন তরুণ এসেছিল সিগারেট কিনতে কিন্তু মামা তাঁদের জানিয়ে দিলেন তিনি সিগারেট বিক্রি করেন না।
বোঝা গেল চা বিক্রেতা মামা বেশ সচেতন। শুধু মানুষের ক্লান্তিতে চায়ের তৃষ্ণাই মেটান না মানুষের স্বাস্থ্য নিয়েও বেশ সতর্ক।
কথার মধ্যেই আমাকে জিঙ্গাসা করলেন, আমি চা খাব কি না?
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললাম, হ্যাঁ একটা রং চা লেবু দিয়ে দিন।
ফরহাদ মামা নিজেও কলা–রুটি দিয়ে সকালের নাশতাটা সেরে নিলেন।
চায়ে চুমুক দিতে দিতেই জানতে চাইলাম, মামা সরকার পতনে আপনি খুশি হননি?
মামা শোনেন, সরকার পতন হইলেই কী আর নতুন সরকার আসলেই বা আমাদের কী। আমরা যাঁরা গরিব, পরিশ্রম করে খেটে খাওয়া মানুষ, তাগো তো কোনো পরিবর্তন হবে না। তাই কে এল আর কে গেল এসব নিয়ে আমার কোনো মন্তব্য নাই মামা। আমিও খেটে খাই, আপনিও খেটে খান। এই দেহেন পেটের তাগিদে এইখানে দাঁড়ায়ে আছেন। গাড়ি আসবে তারপর সেই কতদূর যাবেন কাজে। আমার আর আপনার পার্থক্য কী, মামা জানেন, আমি দাঁড়ায়ে কাজ করি আর আপনি হয়তো চেয়ারে বসে কাজ করেন। কিন্তু জীবনের মানে কিন্তু একই।
কথাগুলো বলতে বলতে বেশ হতাশার সুর নেমে এল উনার গলায় তা দিব্যি টের পেলাম।
সত্যিই তো কে এল কে গেল এসবে আমাদের ছাপোষা মানুষের কী? সরকার আসবে, সরকার যাবে, এটাই তো একটা দেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া। এসব নিয়ে মাথা নষ্ট করে কী লাভ!
তার চেয়ে ভালো সুন্দর মায়াবি মেঘলা সকালে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে গরম চায়ে চুমুক দিয়ে জীবনের স্বাদ উপভোগ করা।
জীবনের গল্পে এসব ফরহাদ মামারাও বেঁচে থাক সহজ সাবলীলতায়। আমার চায়ের দামটা মিটিয়ে দিয়ে মনে মনে গাইছিলাম...
কবির সুমনের সেই বিখ্যাত গান …
‘এক কাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই
ডাইনে ও বাঁয়ে আমি তোমাকে চাই
দেখা না দেখায় আমি তোমাকে চাই
না-বলা কথায় আমি তোমাকে চাই…’
ততক্ষণে আমার অফিসের গাড়ি চলে এসেছে।
শুরু হলো আমার আরেকটা নতুন দিন নতুন সম্ভাবনা।
নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: ns@prothomalo.com