দেশের মেধাবীরা কী করবে
সুমন গ্রামের এক কৃষক পরিবারের ছেলে। মা–বাবার ইচ্ছা, ছেলেকে উচ্চশিক্ষিত হয়ে গ্রাম তথা দেশের সেবা করবে। সেই লক্ষ্যে ছোট থেকেই তিলে তিলে পড়াশোনায় রেখে বড় করা। স্কুলজীবনে সব ক্লাস এ রোল ১, মানে প্রথম। এসএসসি–এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম সারির বিজ্ঞান ভিত্তিক বিষয়ে ৫০০০০ শিক্ষার্থীর মধ্য মেধা তালিকায় ১০০ তম স্থান। মা–বাবার স্বপ্ন পূরণের প্রায় শেষ ধাপে।
হলে সিট নেই, পলিটিক্যাল সিট পেয়ে দিন শুরু হলো সুমনের। গ্রামের ছেলেটা যেখানে আড্ডা দেওয়ার ভয়ে বাবার সঙ্গে মাঠে কাজ করে ব্যস্ততা দেখাত, সে আজ সিট রক্ষার লড়াইয়ে মিছিলের সারিতে। পাছে সিট হারিয়ে গেলে থাকবে কি করে, মা–বাবার স্বপ্ন পূরণ কীভাবে হবে। জুতা ছেড়ার অভিনয়, হঠাৎ পেটব্যথা ইত্যাদি ইত্যাদি অভিনয় করে মিছিলের থেকে সরিয়ে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা। ক্লাসে যেতে হবেই। তারপরেও নিজেকে কিছুটা সরিয়ে রাখতে টিউশন করে সময় কাটত, সঙ্গে সঙ্গে বাবার কিছুটা অর্থ সাশ্রয় করতে লাগল। এভাবে চলতে লাগলো কয়েক বছর। অনার্স–মাস্টার্স ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষের পথে। হল ছেড়ে দিতে হবে, চাকরি খুবই দরকার! চিন্তার ভাঁজ পড়ে গেল।
কী ধরনের চাকরি করবে, কার কাছে শুনবে আর কে–ই বা সঠিক তথ্য দেবে! সরকারি চাকরি প্রস্তুতি সময়ের ব্যাপার, এতো সময় তো নেই। সরকারি চাকরির ইচ্ছা থাকলেও দ্রুত চাকরি করে মা–বাবার পাশে দাঁড়াতে হবে। কারণ, তারা বয়স আর বিভিন্ন অসুস্থতার কারণে আর কোনো কাজ করতে পারে না। বিদেশে গিয়ে লেখাপড়া, সেটাও সময়সাপেক্ষ আর বৃদ্ধ মা–বাবাকে রেখে এভাবে ফেলে যাওয়ার ইচ্ছে এ মুহূর্তে সুমনের ছিলো না। তাহলে উপায় কী? আপাতত উপায়, দেশে থেকে একটা বেসরকারি চাকরি করে মা–বাবার সঙ্গে থেকে জীবন চালিয়ে যাওয়া। কিন্তু কোনো লিংক তো পাচ্ছে না, কে দেবে চাকরি, যা–ও দু-একটা পাচ্ছে, সেগুলো তাঁর সঙ্গে একদমই যাচ্ছে না। হতাশার ছাপ পড়ে গেল, যে ছেলে ছোটবেলায় সবার কাছে থেকে শুনে আসছে যে এই সুমন একদিন অনেক বড় হবে, আর সে চাকরির সুযোগের অপেক্ষায় হন্যে হয়ে ঘুরছে। বিজ্ঞানভিত্তিক এত বড় বিষয় পড়েও আজ শুনতে হচ্ছে, এসব বিষয় কেন পড়ছ, দেশের তো এর চাহিদা নেই। তুমি ভুল করছো! এর দায় কি শুধুই সুমন আহমেদের? সমাজ, রাষ্ট্র, বিশ্ববিদ্যালয় কি নেবে না? পরবর্তীতে জানার চেষ্টা করব শেষমেষ সুমনের ভাগ্য কী হয়েছিল।
হাজারো সুমন আহমেদ দেশে রয়েছে, যারা আজ হতাশায় ভুগে আজ দেশত্যাগের পথে। আর যাদের সুমনের মতো সুযোগ নেই, তারা গ্রামে ফিরে যাচ্ছে, চাকরি পেয়ে চলে যাচ্ছে, নেশাগ্রস্ত হচ্ছে, সমাজে অপমানিত হচ্ছে কিংবা নিজেকে শেষ করে দিচ্ছে। বিজ্ঞানভিত্তিক বিষয়ের ওপর দেশে অনেক সুযোগ থাকলেও প্রপার চ্যানেল না থাকাতে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী সঠিক মূল্যায়ন পাচ্ছে না।
আবার চাকরি করেও অনেকে দেশ থেকে চলে যাওয়ার পথ খুঁজছে, এতে দেশ থেকে দিনের পর দিন মেধাশূন্যই হয়ে যাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে সেই মেধার শূন্যস্থান পূরণ করতে বিভিন্ন দেশ থেকে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। দেশে অনেকেই মূল্যায়ন না পেয়ে বিদেশে গিয়ে ব্যাপক মূল্যায়িত হচ্ছে।
সদ্য গ্র্যাজুয়েটদের চাকরির সন্ধান, চাকরির নিশ্চয়তা, মূল্যায়ন, বেতন কাঠামো ইত্যাদি কারণে বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষার্থীদের দিনের পর দিন দেশে থাকার প্রবণতা কমে যাচ্ছে। এতে আগামীতে সঠিক নেতা তৈরি করা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের মেধাবীদের জন্য দেশের বৃহৎ ক্ষেত্র রয়েছে, সবাই চেষ্টা করছে। এখনই সময় উঠে–পড়ে লেগে থেকে দেশের মেধাবীদের কাজে লাগিয়ে আগামীর নেতা তৈরি করা। সব প্রতিষ্ঠান এখন অনেক উদ্যোগ নিয়েছে, বাড়ছে চাকরির অনুকূল পরিবেশ।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে কী করা যেতে পারে—
১. চাকরিভিত্তিক কারিকুলাম তৈরি করা। হাতে–কলমে কাজের ওপর জোর দেওয়া;
২. ইন প্ল্যান্ট ট্রেইনিং বাড়ানো, সেখান থেকেই চাকরির ব্যবস্থা করা;
৩. চাকরিমেলা করে সিভি সংগ্রহ এবং চাকরির ব্যবস্থা করা;
৪. শিক্ষার্থীদের মনস্তাত্তিক বিষয়ে কাউন্সেলিং করা। হতাশা নয়, চাই মেধাবীদের জয়
৫. ডিপার্টমেন্ট আর সব অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন এদের অবশ্যই চাকরির ব্যাপারে সঠিক দিক্নির্দেশনা প্রদান, চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি এবং কাজ সম্পর্কে আগেভাগেই অবহিতকরণ। অ্যালামনাইয়ের মাধ্যমে চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানে যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরির সুযোগ তৈরি করা।
কাজেই এখনি সময় সরকারি ও বেসরকারিভাবে এসব বিষয় নিয়ে ভাবার। আমাদের দক্ষ ফার্মা লিডার দ্বারা সুনিবিড়ভাবে গড়ে ওঠা সব শিল্পের মান অক্ষুণ্ন রাখতেই হবে, এ জন্য দরকার সম্মিলিত প্রচেষ্টা।
পরিশেষে, সরকারি-বেসরকারিভাবে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় নিজ নিজ অবস্থান থেকে দেশের মেধাবীদের ভুমিকা আরও বৃদ্ধি করতে হবে। এ জন্য দরকার অনুপ্রেরণা, উৎসাহ আর মনোবল।
লেখা: মনোজিৎ কুমার রায়, মাইক্রোবায়োলোজিস্ট
নাগরিক সংবাদ–এ ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]