চণ্ডীবরদীর মিলনমেলা
ফরিদপুরের শেষ। গোপালগঞ্জ স্বাগত জানাচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর ছবি সামনে। জাতির পিতার উদ্দেশে শ্রদ্ধা নিবেদন করার সুযোগ আছে। একটু বাঁয়ে চণ্ডীবরদী পূর্বপাড়া। এভাবেই স্বাগতিকেরা আমন্ত্রণ জানাচ্ছিলেন। আর যাঁরা বিকল্প পথের যাত্রী, তাঁরা এসেছিলেন সাঁকো পার হয়ে। একটু হাঁটতেই শ্রীশ্রী শ্যামা মায়ের মন্দির। এক সপ্তাহ ধরে এখানে হয়ে গেল মহানাম যজ্ঞানুষ্ঠান। আমরা ওখানে আতিথ্য গ্রহণ করেছিলাম। বিশাল আয়োজন। বিশ গ্রামের ভক্তরা এসেছেন। তাঁরা উপভোগ করেছেন নাম সংকীর্তন, অষ্টকালীন লীলাকীর্তন আর শ্রীমদ্ভগবত গীতাপাঠ।
শুরুটা ছিল এক পরিবারের শ্যামাপূজার মাধ্যমে। আর পরের অনুষ্ঠানগুলো পরিচালিত হয়েছে বারোয়ারি আয়োজনে। চণ্ডীবরদী সর্বজনীন এ মহানামযজ্ঞের সভাপতিত্ব করেছেন অশোক সাহা। অষ্টকালীন কীর্তনের একটি পর্ব। আগমনী সংগীত গাইছিলেন দলের সদস্যরা। এরই মধ্যে ডানা মেলে নিজের উপস্থিতি ঘোষণা করছেন অনুরাধা মল্লিক। তরুণী কীর্তনিয়া শ্রীকৃষ্ণের রূপ বর্ণনা করলেন।
বিল্বমঙ্গল দেবনাথ দাস হরিকথায় মনোযোগ দেওয়ার আহ্বান জানান। তিনি হরিভক্তির সহায়ক পরিবেশের উল্লেখ করলেন। শুভকাজে গঙ্গার জল ঘরে সংরক্ষণ করা যায়। সরস্বতী বিদ্যা, লক্ষ্মী ধন-ঐশ্বর্য দান করেন। শনিদেবের জন্য গ্রহদোষ খণ্ডন হয়—এসব উল্লেখ করেন এই ভাগবত পাঠক। আরও বলেন, তুলসী বৃক্ষ কৃষ্ণপ্রেয়সী। কাজেই কৃষ্ণভক্তির জন্য আঙিনায় চাই এই গাছ।
শ্রদ্ধায় সন্তুষ্ট হয়ে গুরু তাঁর শিষ্যকে মুক্তহস্তে জ্ঞান দেন। মা যেমন সন্তানকে স্তন দান করে ভালোবাসা ঢেলে দেন।
বিল্বমঙ্গল গীতার বাণীকে তুলে ধরে বলেন, গুণ কর্মের বিবেচনায় মানবজাতির মধ্যেকার বিভক্তি। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র। তবে ক্রোধ থাকলে চলবে না। বশিষ্ঠ হলেন শ্রেষ্ঠ মুনি। বিশ্বামিত্র তপস্যা করে ব্রাহ্মত্ব দাবি করলেন। তবে মুনিবর স্বীকৃতি দিলেন না। রাগে বিশ্বামিত্র বশিষ্ঠ দেবের একশ পুত্রকে হত্যা করলেন। এখানেই শেষ নয়। গুরুকেও শেষ করতে তাঁর ঘর ঘিরে রাখলেন সশস্ত্র বিশ্বামিত্র। বশিষ্ঠ তাঁর স্ত্রী অরুন্ধতীকে বললেন, তাঁর মতো তাপস কেউ নেই। তাঁকে আমি অন্তর থেকে ভালোবাসি। কিন্তু ক্রোধ তাঁর বাধা। শিষ্যের হাত থেকে অস্ত্র পড়ে গেল। ঘোষণা দেওয়া হলো আজ থেকে তুমি ব্রাহ্মণ।
শীতের রাত। এরই মধ্যে শ্রোতারা এসেছেন কৃষ্ণনাম শুনতে। পরীক্ষিত সাহার সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় হয়। আয়োজনের সঙ্গে যুক্ত অখিল সাহা। বললেন, অনুষ্ঠান করতে সহযোগিতা করেন হিন্দু–মুসলমান সবাই। বছরের পর বছর চলছে এভাবে। দেখালেন, ভক্তরা আপ্যায়িত হচ্ছেন অবিরাম। পাশে বসা ছিলেন নির্মল ময়রা। মন্তব্য চাইলেন। মুগ্ধতা আর তৃপ্তির প্রকাশ আমার।
সমাজকল্যাণের জন্য চাই নিজের প্রস্তুতি। মহারাজ আর যুবকের কথোপকথনে চলে আসে সেই সত্য, নিজেকে বদলাও। ভগবানে ব্রতী হও। কল্যাণময়ী মা আছেন এই পৃথিবীতে। সন্তান চান মাকে সন্তুষ্ট করতে। মা সবাইকে। ঈশ্বরচন্দ্র মায়ের জন্য শাল পাঠিয়েছেন। ভগবতী দেবী সে শাল গায়ে চড়ান না। তিনি চান ২৬টি শাল। কেননা তাঁর তো একা পরলে চলে না। মা অলংকারের পরিবর্তে চেয়েছেন একটি স্কুল, একটি দাতব্য চিকিৎসালয়। বিল্বমঙ্গল আরও শোনালেন ভগবান মন্নুর কন্যা দেবাহুতির আত্মোৎসর্গের কাহিনি। সে কথা পরে হবে। তার আগে যাই কীর্তন তরুণী অনুরাধা মল্লিকের আসরে। তিনি বললেন, বিধাতার সৃষ্টিতে এমন কেউ নেই যে আমার গৌরাঙ্গের সঙ্গে তুল্য। বিদ্যুতের ঝলক এত ঝিকমিক করে ওঠে যে তা–ও নবদ্বীপের নিমাইয়ের কাছে হার মানে।
অনুরাধা একটা ব্যতিক্রম তুলে ধরে বললেন, মা লক্ষ্মীকে ভালোবাসলে ধন ঐশ্বর্য হয় কিন্তু গোবিন্দকে ভালোবাসলে সারা জীবন যায় কাঁদতে কাঁদতে। সংসারে থেকেও বৈরাগ্যসাধন করা যায়। স্ত্রী–পুত্র–কন্যা এমন সবাই জানবে আমি তাদের। কিন্তু আমার মন থাকবে গোবিন্দের চরণে।
অনুরাধা বলেন, যথা ধর্ম তথা জয়। নেচে নেচে হাত দুখানা পরিমিত সঞ্চালনে তিনি কণ্ঠে তুলে নিচ্ছেন অমৃত বাণী।
আমরা এক পাশে বসা। লেখক সনোজ কুমার কুণ্ড চলছেন সামনে দিয়ে। একই সময় তাপস কর্মকারের সঙ্গে দেখা। এঁরা দুজনই মুকসুদপুর কলেজে অধ্যাপনা করেন। দুজনের পিতাই আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক। নিবিড় সম্পর্ক। আমার ভালোবাসা জানাই তাঁদের।
গোবিন্দ অর্জুনের রথের সারথী হয়ে বসেন। অর্জুন চলেন সামনে। দৃশ্যপটে আসে কুরুক্ষেত্র। পাণ্ডবরা তখন জয়ের পথে।
নদীয়ার নবদ্বীপে গমন নিমাইয়ের। সূর্যের তাপ আছে, চন্দ্রের কিন্তু স্নিগ্ধতা। গৌরাঙ্গ দীপ্তি ছড়ায়। নাচলেন অনুরাধা। হাতের, চোখের, মুখের তালে তালে শ্রোতারাও গাইলেন। ‘পথ চলতে কথা বলতে যেন শুধু নাম নিতে পারি। হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।’
শুরুর দিকে অনুরাধা দ্বারকা আর হস্তীনাপুরের চিত্রপট তুলে ধরেন। শ্রীকৃষ্ণ, দুর্যোধনের রাজ্য ছেড়ে আতিথ্য নিলেন তারই মন্ত্রী দাসীপুত্র বিদুরের ঘরে। পরাশরী তার কৃষ্ণ প্রাণ। সোনার থালা, বাটি, চামচ সাজানো ৫৬ উপচার আর রাজাসন ত্যাগ করে গঙ্গাতীর বেয়ে চলেন ভক্তের দরজায়। রম্ভার খোসায় আহার করেন। কাঁদেন অনুরাধা, বুকে ভক্তির হাত। নিমীলিত গভীর চোখ শিল্পীর। প্রসারিত দুহাত ওপরে ওঠে। ‘কৃষ্ণ বলে আমি কাঁদিতে পারি।’...
প্রিয় কন্যা দূর্বাকে নিয়ে লাকি হালদার উল্কা এগিয়ে যান কাছের মানুষগুলোকে শুভেচ্ছা জানাতে। গোহালা গার্লস স্কুলের শিক্ষক বাবুল হালদার উৎসাহী মানুষ। আমাকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিয়ে যাওয়া যেন তাঁর একটি কাজ। আমরা এক বহর। একপর্যায়ে ভাগ হয়ে যাই। তাঁদের দুই সন্তান বাণী অর্চনা আর বেদ বেদান্তকে সামলাতে হয়। শিশুরা যদিও ওদের মা লোপা মুদ্রার কাছে। মুখোমুখি আমরা এখন মঞ্চের শিল্পীদের সামনে। বিদ্যুৎ বিশ্বাস কলেজে পড়াতেন। আমার মতোই অবসরে যাওয়া। পুরোনো বন্ধু, আলাপ হয়।
ভাগবত পুরাণ চতুর্থ স্কন্ধ থেকে পড়ছিলেন বিল্বমঙ্গল।
ভজন ছাড়া জীবন নিরর্থক।
ভগবান মনুর কন্যা দেবাহুতি। রাজকন্যা মনে করলেন বিয়ে করতে হলে একজন শুদ্ধাচারীই হোক জীবনসঙ্গী। ঋষি কর্দম মুনির হাতে তুলে দিলেন কন্যাকে। পিতা বিশ্বাস করেন, বিয়ে হচ্ছে একটি যজ্ঞ। অন্যদিকে অন্য বিবেচনায় বিয়ের উদ্দেশ্য দুটি। সন্তান দান, নিজের পরিবার এবং জগতের জন্য উন্নয়ন। দেবাহুতি সন্তান দিলেন। রয়ে গেলেন সংসারে। কর্দম মুনি চলে গেলেন বনে। রাজকন্যা পুনর্মূল্যায়ন করলেন। এমনটি চাওয়া ঠিক হয়নি। জীবনের অসীম চাওয়া পূরণ হওয়া সম্ভব নয়।
কৃষক সংগঠক মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা। শিক্ষক দম্পতি অলোক-উল্কা সরকার দম্পতি নিয়ে গেলেন প্রসাদ নিকুঞ্জে। আমরা খিচুড়ি প্রসাদ নিলাম। নৃপেন্দ্র ভদ্রকে দেখলাম আসরের ঠিক মধ্যখানে। ভক্তি আর আনন্দের কোলাকুলি হচ্ছে।
অনামিকা বর্মণ প্রজ্ঞা গল্প উপস্থাপন করলেন ‘উত্তরা গোষ্ঠ’। আনন্দের খেলায় শামিল কানাই, বলাই, শ্রীদাম, সুদাম। বেলা যায় যায়, মায়ের কাছে ফেরা হয় না। নন্দিতা সরকার নীলা। শক্তিধর তাঁর কণ্ঠ নিয়ে বৃহত্তর একটি জায়গা দখল করে নিলেন। অবশেষে কানাই ফিরে এল মায়ের কোলে। উলুধ্বনি চরাচরে। মায়ের কোলে গোবিন্দ এল। সাধুরা বলেন, ‘হরি হরি বলো’।
এক সপ্তাহের আয়োজন। চলল সনাতন ধর্মীদের আগ্রহ নিয়ে। আনন্দে ভেসেছে সারা সময়। একসময় শেষও হলো। জয়তু সমাবেশ। জয়তু মিলনমেলা।