ক্যারিয়ার প্ল্যানের অনুপস্থিতি বনাম সরকারি চাকরিজীবীদের আন্দোলন
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সাম্প্রতিক আন্দোলন নিয়ে জাতি নানা পক্ষে–বিপক্ষে বিভক্ত। কেউ বলছেন, তাঁরা ১৩ থেকে ১০ম গ্রেড চান কেন? নিয়োগের সময়ই তো তাঁরা জানতেন, তাঁদের বেতন–ভাতাদি কত, তবে আন্দোলন কেন? আন্দোলন আসলে শুধু প্রাইমারির শিক্ষকেরাই করছেন না, নিম্ন গ্রেডে কর্মরত ব্যক্তিদের বেশির ভাগ ডিপার্টমেন্টই আন্দোলনে আছে। তবে শিক্ষকদের সুবিধা হচ্ছে, তাঁরা সংখ্যায় বেশি, আবার ‘শিক্ষক’ শব্দের মধ্যে একটা আবেগ আছে। তাই তাঁরা রাস্তায় নামলে আন্দোলনটা সবার চোখে পড়ে। কিন্তু পত্রিকার পাতা ওলটালে দেখবেন, অনেক ডিপার্টমেন্টের কর্মচারীরা নানা বৈষম্য নিয়ে প্রায়ই আন্দোলন করেন। সম্প্রতি স্বাস্থ্য সহকারীরা আন্দোলন করছেন। ডিসি, ইউএনও এবং এসি ল্যান্ড অফিসের কর্মচারীরা তাঁদের পদ–পদবি ও বেতন স্কেল বৃদ্ধির জন্য দীর্ঘদিন আন্দোলনে আছেন। এ ছাড়া অন্য অনেক ডিপার্টমেন্টের কর্মচারীরা বৈষম্য নিরসনে আন্দোলনে মাঠে আছেন। কথা হচ্ছে এ আন্দোলন কেন?
ডিগ্রি বনাম চাকরি
একটা সময় ছিল এসএসসি পাস করলেই মানুষ দেখতে আসত। এলাকায় যে একটু চিঠি লিখতে পারত, তার অনেক কদর ছিল। সময় বদলেছে। এখন ঘরে ঘরে অর্নাস পাস। তথ্যপ্রযুক্তির যুগে সবাই সচেতন। পড়াশোনার হার বৃদ্ধি পাওয়ায় সবার বোধ ও মননে অনেক পরিবর্তন এসেছে। দেখা যায়, একজন ম্যাজিস্ট্রেট জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ে বিসিএসে টিকেছেন, আবার তাঁরই পিয়ন কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। প্রাইমারির শিক্ষা অফিসার ভেরামারা ডিগ্রি কলেজের ছাত্র, অথচ সহকারী শিক্ষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। এখন আপনি কোন যুক্তিতে বলবেন, এই শিক্ষা অফিসার পড়াশোনা ও মেধায় সহকারী শিক্ষকের চেয়ে ভালো?
মেধা একটা বায়বীয় ধারণা
সম্রাট আকবর যখন সিংহাসনে বসেন, তাঁর বয়স মাত্র ১৪ বছর। বিশাল ভারতবর্ষের দায়িত্ব এক বালকের হাতে। মোহাম্মদ বিন কাশিম যখন ভারত অভিযানের নেতৃত্ব দেন, তখন তাঁর বয়স ১৭ বছর। সম্প্রতি ছাত্র আন্দোলন থেকে তিনজন উপদেষ্টা হয়েছিলেন (পরে একজন পদত্যাগ করেন), যাঁরা ছিলেন ছাত্র, কিন্তু তাঁরা কয়েকটি মন্ত্রণালয় চালাচ্ছেন। তাঁরা কি বিসিএস প্রশাসন একাডেমি থেকে ট্রেনিংপ্রাপ্ত? উত্তর হচ্ছে ‘না’। তবে কোন যোগ্যতা ও শিক্ষার বলে তাঁরা পুরো দেশের কর্মকর্তা–কর্মচারীদের স্যার হয়ে গেলেন? আসলে বড় বড় পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হাওয়াই মেধাবীর মাপকাঠি নয়। চেয়ারই মানুষের মেধা জাগিয়ে তোলে।
সচিবালয় বনাম জেলা প্রশাসন
যাঁরা আমার লেখা পড়ছেন, তাঁরা কষ্ট করে একটু সচিবালয়ের কর্মচারী নিয়োগ বিধিমালা ও জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের কর্মচারী নিয়োগ বিধিমালা নেট থেকে ডাউনলোড করে পড়ুন। দেখবেন, মন্ত্রণালয়ে উচ্চমাধ্যমিক পাস করা একজন অফিস সহকারী পদোন্নতি পেতে পেতে সিনিয়র উপসচিব নন–ক্যাডার হয়ে যাচ্ছেন, অথচ একই যোগ্যতা ও একই ধরনের কাজ করে মাঠ প্রশাসনের ৯৫ শতাংশ কর্মচারী চাকরির শুরুর ধাপেই কোনোরকম পদোন্নতি ছাড়া চাকরিজীবন শেষ করছেন। এখন জেলা প্রশাসনের কর্মচারীরা আন্দোলন করছেন, কিন্তু সরকার তাঁদের কথা শুনছে না। যদি সচিবালয়ের ন্যায় জেলা প্রশাসনে একই ধরনের পদোন্নতি নীতিমালা থাকত, তবে কিন্তু তাঁদের এত ঘন ঘন আন্দোলন করা লাগত না।
নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
ক্যারিয়ার প্ল্যানের অনুপস্থিতি
নিম্ন গ্রেডের চাকরিতে সচিবালয় ছাড়া অন্য ডিপার্টমেন্টে কর্মচারীদের জন্য কোনো ক্যারিয়ার প্ল্যান নেই। একজন প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকের পদোন্নতির সুযোগ বড়জোর প্রধান শিক্ষক পর্যন্ত। তাঁকে পদোন্নতির সুযোগ দিন। বিভাগীয় পরীক্ষার মাধ্যমে তাঁর থেকে শতভাগ এটিও নেন। তাঁরা টিও হবেন, জেলা শিক্ষা অফিসার হবেন, অধিদপ্তরের প্রধান হবেন। তবে তাঁদের মধ্যে প্রেষণা সৃষ্টি হবে। কাজের সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি হবে। তাঁরা যখন দেখেন, একই পদে বিভিন্ন দপ্তর যেমন নির্বাচন অফিস, হিসাবরক্ষণ অফিস, খাদ্য অফিস কিংবা সচিবালয়ে নিম্ন গ্রেডে ঢুকে প্রমোশন পেয়ে বড় অফিসার হচ্ছেন, স্বাভাবিকভাবেই নিজেদের বঞ্চিত মনে করেন। বঞ্চনা থেকে ক্ষোভ। ক্ষোভ থেকে আন্দোলন।
চেয়ার সিটিং খেলা বনাম চাকরিজীবী
চেয়ার সিটিং খেলায় সব সময় একটা চেয়ার কম থাকে। যারা খেলায় অংশগ্রহণ করে, তারা সবাই সমান যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও একটা চেয়ার কম থাকায় কেউ না কেউ ঝরে পড়বে। যে ঝরে পড়েছে, সমাজ তাকে অযোগ্য বলে, মেধাহীন বলে। বিসিএসে আসন থাকে দুই হাজার। পরীক্ষা দেন দু-তিন বা চার লাখ। তাঁরা সবাই বিসিএস ক্যাডারের যোগ্য, নয়তো রাষ্ট্র তাঁদের পরীক্ষায় বসার সুযোগ দিত না। কিন্তু দিনশেষে দুই হাজারই টিকবেন। অন্যদের কেউ প্রাইমারি শিক্ষক হবেন, কেরানি হবেন অথবা বেকার থাকবেন আর দিনশেষে অযোগ্য কিংবা অমেধাবী উপাধি নিয়ে জীবন শেষ করবেন।
খেলার মাঠ সবার জন্য সমান নয়
সবাই জীবনে সমান সুযোগ পান না। যাঁর জন্ম রাজার ঘরে, তিনি জন্ম থেকেই রাজপুত্র। যাঁর জন্ম প্রজার ঘরে, তিনি জন্ম থেকেই প্রজা। এখানে যোগ্যতার প্রশ্ন অবান্তর। আজ নিজেকে যিনি মেধাবী দাবি করছেন, তিনি অবশ্যই তথাকথিত অমেধাবীর চেয়ে কোনো না কোনোভাবে সুযোগ–সুবিধা বেশি পেয়েছেন। এটা আপনার প্রতি খোদার করুণা, আপনার বিশেষ যোগ্যতা নয়। তাই আল্লাহ বলেছেন, ‘অহংকার কোরো না, অহংকার হচ্ছে আমার চাদর। আমার চাদর ধরে টান দিলে সেটা আমি বরদাশত করব না।’ তাই কেউ বড় পদে আছেন মানে অহংকার নয়, বরং বড় দায়িত্ব ভেবে সবার সমানাধিকার নিশ্চিতে কাজ করুন। শত ফুল ফুটতে দিন। সবাইকে বিকশিত হওয়ার সুযোগ দিন।
প্রস্তাব
সব ধরনের চাকরিতে একটা স্থায়ী ক্যারিয়ার প্ল্যান করা উচিত। প্রমোশনের ব্যবস্থা থাকা উচিত। বিভাগীয় পরীক্ষা নিয়ে যোগ্যদের ওপরে ওঠার সুযোগ রাখা উচিত। যথাযথ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মেধাকে শাণিত করার সুযোগ রাখা উচিত। এর ব্যবস্থা না থাকায় কিছুদিন পরপর আমরা বিভিন্ন বিষয়ে সরকারি চাকরিজীবীদের আন্দোলন দেখতে পাই। এর বিজ্ঞানভিত্তিক ও স্থায়ী সুরাহা না করে সাময়িক মলম লাগালে এটা চলতেই থাকবে। ফলে রাষ্ট্র অস্থিরতার মধ্যে থাকবে এবং পরিস্থিতি সামলাতে ভুলভাল সিদ্ধান্ত নেবে।
*কবি ও লেখক