যাপিত জীবনে ‘আড্ডা–সমাচার’

সূর্য তখনো পুরোপুরি জাগেনি, কিন্তু ৩২ একর ক্যাম্পাস যেন অলস ভোরের ঝাঁপি খুলে অপেক্ষা করছে প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর দিনের। কুয়াশার পর্দা সরিয়ে আস্তে আস্তে উঁকি দিচ্ছে প্রথম আলো। গাছের পাতায় জমে থাকা শিশিরবিন্দু রূপকথার মতো ঝিলমিল করছে, আর বাতাসে ভেসে আসছে নানির টং কিংবা সিদ্দিক মামার দোকান থেকে চায়ের মৃদু গন্ধ।

বেসরকারি গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের (গবি) এই শীতের সকাল যেন এক জাদুর কাঠি। এখানে ক্লাস বা গবেষণার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে চায়ের আড্ডা, যেখানে মিশে থাকে বন্ধুদের খুনসুটি, জীবনের গল্প আর কথার ঝরনাধারা। এই আড্ডাগুলোই একসময় হয়ে ওঠে ক্যাম্পাস–জীবনের আত্মা।

ছিমছাম টিনের চালা কিংবা কড়ইগাছের তলায়, পুরোনো কাঠের ভাঙাচোরা বেঞ্চ আর প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে জমে ওঠে গল্পের ঝড়। শীতের সকালে এখানে বসে চায়ের ধোঁয়ার সঙ্গে গল্পের তরঙ্গ মিশে যায় কুয়াশায়। শিক্ষার্থীদের জমাট আড্ডা যেন শীতের সকালে এক অদ্ভুত উষ্ণতার আঁচ নিয়ে আসে।

চায়ের কাপ হাতে আড্ডার সূচনা। কেউ বলে, ‘রং চা ছাড়া সকালে ঘুম কাটে না।’ কেউবা আদা চায়ের স্বাদে মগ্ন। এক পাশে বসে থাকা কেউ আবার লেবু চায়ের ভক্ত। বলে, ‘এটাই তো শীতের আসল সঙ্গী!’ চায়ের প্রতিটি চুমুকে যেন জীবনের নতুন অর্থ খুঁজে পাওয়া যায়।

গল্পের বিষয়বস্তু? এককথায় বলতে গেলে সবকিছু। রাজনীতি থেকে সিনেমা, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বইয়ের আলোচনা—সবকিছু নিয়েই কথার জাল বোনা হয়। আইন বিভাগের শিক্ষার্থীদের আড্ডা তাই কখনো কখনো আইনের ধারায় ঢুকে যায়। ‘তোমরা জানো, ধারা ২৯৪ অনুযায়ী অশ্লীলতার সংজ্ঞা কী?’ কেউ মুচকি হেসে বলে, ‘তোমার মুখ দেখেই তো সংজ্ঞা পেয়ে গেলাম।’ মুহূর্তেই হাসির রোল। সঙ্গে সঙ্গে আরেকজন জবাব দেয়, ‘চায়ের দোকানের এই হট্টগোল কি ২৯০ ধারায় অপরাধের আওতায় পড়বে?’ সবাই হো হো করে হেসে ওঠে। এই হাসি যেন শীতের সকালকে আরও উষ্ণ করে তোলে।

তবে আড্ডা শুধু হাসিঠাট্টার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; এখানে গড়ে ওঠে গভীর সম্পর্ক। কারও হাত ধরে প্রথম প্রেমের শুরু, কেউবা জীবনের দুঃখগাথা শেয়ার করে নিজের মনের বোঝা হালকা করে। শীতের সকালের এই আড্ডাগুলো যেন ক্যাম্পাস–জীবনের অনন্য স্মৃতি হয়ে থাকে।

রোদেলা শীতের সকালগুলো আড্ডার মেজাজ আরও প্রাণবন্ত করে তোলে। চায়ের দোকানের সামনে বসে সকালের মৃদু রোদ পোহানোর মধ্যে একধরনের স্নিগ্ধতা রয়েছে। কেউ বই খুলে পড়ে, কেউ গানের সুর তোলে, কেউবা কৌতুকের রেশ টেনে হাসির ঝড় তোলে। এই মুহূর্তগুলোয় সময় যেন থমকে থাকে।

তবে শুধু শিক্ষার্থীরাই নয়, এই আড্ডায় মাঝেমধ্যে যোগ দেন শিক্ষকেরাও। তাঁদের গভীর জ্ঞান আর মৃদু হাস্যরস আড্ডার রং আরও গাঢ় করে তোলে। ছাত্র-শিক্ষকের এই অনানুষ্ঠানিক মেলবন্ধন জীবনের পাঠে নতুন অধ্যায় যোগ করে।

শীতের সকালে চায়ের আড্ডার আরেকটি বিশেষ আকর্ষণ হলো তার আন্তরিকতা। প্রতিদিন একই জায়গায় বসে একই মানুষের সঙ্গে চা খেতে খেতে একসময় তারা হয়ে ওঠে পরিবারের মতো। কোনো এক নতুন বন্ধু হয়তো হঠাৎ আড্ডায় যোগ দেয় এবং কয়েক দিনের মধ্যেই সে হয়ে ওঠে অবিচ্ছেদ্য অংশ।

আড্ডার মাঝেও কখনো কখনো কেউ গম্ভীর হয়ে বলে, ‘জীবনের এই দিনগুলো খুব দ্রুত চলে যায়, কিন্তু স্মৃতিগুলো থেকে যায়,’ তখন সবাই চুপ হয়ে যায়, যেন মুহূর্তটিকে আরও গভীরভাবে অনুভব করতে চায়। এমনকি চায়ের দোকানের বৃদ্ধ মালিকও আড্ডার হাসি আর স্মৃতির সঙ্গে মিশে যান, তাঁর নিজের জীবনের গল্প শোনান।

তবে সময় থেমে থাকে না। আড্ডা শেষ হলে সবাই উঠে দাঁড়ায় ক্লাস বা কাজের উদ্দেশ্যে। কিন্তু সেই গল্পের রেশ রয়ে যায় চায়ের কাপে, ধোঁয়ার গন্ধে আর শীতের হিমেল হাওয়ায়। চায়ের দোকানের বেঞ্চগুলো যেন সেই হাসি আর কথার স্মৃতি ধরে রাখে।

শীতের সকাল আর চায়ের আড্ডা শুধু এক ঘণ্টার গল্প নয়; এটি জীবনের প্রতিচ্ছবি। এখানে রয়েছে উষ্ণতা, সম্পর্কের গভীরতা এবং জীবনের ছোটখাটো সুখের মেলবন্ধন। আড্ডার শেষে যখন সবাই বিদায় নেয়, তখনো মন ভরে থাকে উষ্ণতায়। কারণ, তারা জানে, আগামীকাল আবার এই আড্ডায় ফিরে আসা হবে; নতুন গল্প নিয়ে, নতুন আবেগ নিয়ে।

এই আড্ডাগুলোই একদিন ক্যাম্পাস জীবনের সবচেয়ে সুন্দর স্মৃতি হয়ে রয়ে যাবে। চায়ের কাপে ধোঁয়া ওঠা, রোদ পোহানোর সেই মুহূর্তগুলোই একদিন মনে করিয়ে দেবে—জীবনকে অনুভব করার আসল মানে কী।

লেখা: শিক্ষার্থী, গণ বিশ্ববিদ্যালয়।