আমি বাংলাদেশ বলছি
আমি বাংলাদেশ বলছি,
যাকে তোমরা মা বলো, যাকে তোমরা জননী বলো।
আমি তোমাদের সেই প্রিয় জন্মভূমি
সেই প্রিয় মাতৃভূমি
যার হৃদয়জুড়ে কেবলই ভাঙনের শব্দ।
শুনছ কেউ?
আমি সেই বাংলাদেশ, যাকে তোমরা তোমাদের প্রয়োজনে
বারবার ভেঙে টুকরো টুকরো করেছ।
যে মাতৃভূমিকে তোমরা
তোমাদের ব্যক্তিস্বার্থে ব্যবহার করেছ ইচ্ছেমতো।
আমি বাংলাদেশ, এক জীর্ণশীর্ণ মা
এক নিপীড়িত–নির্যাতিত দেশমাতৃকা।
তোমরা কি শুনতে পাও আমার বেদনার্ত আর্তনাদ?
ভাঙলে আমায় সাতচল্লিশে—
আমার বুকের ওপর পেরেক ঠুকে বসালে কাঁটাতার।
ছিন্নভিন্ন রক্তাক্ত হৃদয়জুড়ে
আমার শুধু ভাগ হওয়ার যন্ত্রণা।
তোমরা তোমাদের প্রিয় জননীকে আলাদা করে দিলে
তার আপন আঙিনা থেকে।
নিয়েছিলে কি জননীর অনুমতি? নাওনি তো।
তারপর...
তারপর যে কত শত শাসন আর শোষণের ভারে আমি ক্লান্ত
সে কথা কি একবারও চেয়েছ জানতে?
আমি এখন আঠারো কোটি সন্তানের জননী।
অথচ
ভোগ–দখল আর জুলুমের আবরণে আমায়
আচ্ছাদিত করে রাখলে যুগের পর যুগ।
নিশ্চয়ই মনে আছে তোমাদের
একাত্তরের সেই ভয়ার্ত দিনগুলোর কথা।
কী নির্মমভাবে লাঞ্ছিত হতে দেখেছ তোমাদের বাংলা মাকে।
পাকিস্তানের বাহিনী আর আমার
নিজেরই বুকে বড় হওয়া
আলবদর–রাজাকারদের
পৈশাচিক উল্লাসের কথা মনে পড়ে?
আমি সেই হতভাগা দেশ
যাকে তোমরা মা বলো,
যাকে তোমরা জননী বলে স্বীকৃতি দিয়েছ।
উল্লাসে মাতোয়ারা রাজাকার বাহিনী
তাদের জননীকে আবরণহীন করতে কুণ্ঠাবোধ করেনি যেমন,
তেমনি আমার সুযোগ্য সন্তানেরা জীবন দিয়ে
মায়ের সম্মান বাঁচিয়েছিল।
তাই তো তোমরা বলো,
‘আমরা তোমার শান্তি প্রিয় শান্ত ছেলে
তবু শত্রু এলে অস্ত্র হাতে ধরতে জানি
তোমার ভয় নেই মা আমরা
প্রতিবাদ করতে জানি’
আহ কী পরম শান্তি
আমার সন্তানেরা মায়ের সম্ভ্রমের জন্য
রুখে দাঁড়াতে পারে!
তবে আমি ভুলিনি সে ইতিহাস।
প্রিয় সন্তানদের কাছে প্রশ্ন আমার,
আচ্ছা, তোমাদের মায়ের কি
অনেক চড়া মূল্য বিদেশি পুঁজিবাজারে?
তোমরা যে বলো তোমাদের মা
সুজলা–সুফলা শস্য-শ্যামলা
সত্যিই কি তা–ই?
তোমরাই তো বলো,
ওমা ‘তোমার পরে ঠেকাই মাথা।’
কিংবা
‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি’
তা–ই কি?
এই দেশ, এই মাটি, সবই তোমাদের
আমার প্রিয় সন্তানদের...
তাহলে কেন এত দাঙ্গা, এত হানাহানি, এত অরাজকতা?
আমি বাংলাদেশ বলছি,
আঠারো কোটি সন্তানের এক নিরুপায় নির্বিকার মা!
ভালোবাসি বলে তোমরা জন্মভূমির সাথে প্রহসন করছ।
কখনো কি তোমরা জানতে চেয়েছ
কীভাবে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে প্রিয় মাতৃভূমি?
তোমরা ভালোবাসার নামে চেয়েছ এই দেশটার দখল।
আমি তোমাদের কাছে প্রশ্ন রাখতে চাই,
তোমাদের ভোগ–বিলাস আর চাওয়া–পাওয়ার অবসান কবে হবে?
মায়ের দরিদ্রতাকে বিক্রি বন্ধ হবে কবে বিশ্ববাজারে?
রক্তের বিনিময়ে আমার যে সূর্যসন্তানেরা
তাদের মায়ের নাম দিল
লাল–সবুজের বাংলাদেশ
আমি সেই রক্তিম লাল–সবুজের পতাকা বলছি,
আর কত জীবনের বিনিময়ে বিক্রি করবে আমায়?
কতটা রক্তের বিনিময়ে ক্ষমতার দখল নেবে তোমরা?
তোমরা মাকে চাও, না তোমরা প্রভুত্ব চাও।
কবি অন্নদাশঙ্করের কবিতার মতো বলি,
‘তেলের শিশি ভাঙল বলে খুকুর পরে রাগ করো
তোমরা যে সব বুড়ো খোকা
বাংলা ভেঙে ভাগ করো
তার বেলা?’
*রোজিনা রাখী, ফিচার লেখক
নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]