হযবরল অবস্থা: দায় কার
শিক্ষা সমাজ ও রাষ্ট্রকে এগিয়ে নিয়ে যায়। সমাজ পরিবর্তনে শিক্ষা একটি অপরিহার্য বিষয়। আজ যে সংস্কারের দাবি উঠছে, এটাও সুন্দরভাবে সম্পন্ন করা যায় শিক্ষার যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে। তার জন্য দেশের গতানুগতিক ধারার শিক্ষাব্যবস্থারও সংস্কার চাই। শিক্ষা হওয়া উচিত প্রয়োগিক ও জীবনমুখী। শিক্ষার্থীরা যা কিছুই শিখবে, তা তারা বাস্তব জীবনে কাজে লাগাতে পারছে কি না, তা দেখতে হবে। ‘শিক্ষাগুরুর মর্যাদা’ কবিতাটি কোনো শ্রেণির একজন শিক্ষার্থী পড়ে ফেলল; এখন দেখা উচিত, ওই শিক্ষার্থী কবিতাটিকে কতটুকু ধারণ করতে পারল। সে শিক্ষককে যথাযথ মর্যাদা ও সম্মান দিচ্ছে কি না। মোদ্দাকথা, তাকে কবিতাটি বুঝিয়ে দিতে হবে, যেন কবিতার শিক্ষা সে বাস্তবজীবনেও লালন করতে পারে। আর বুঝিয়ে দেওয়ার দায়িত্বটি যিনি পালন করেন, তিনি হলেন শিক্ষক। শিক্ষা ও শিক্ষক একই মালার পরস্পর সংযুক্ত দুটি পুঁতির মতো। শিক্ষক ছাড়া কে শিক্ষা দেবে শিক্ষার্থীদের। কাজেই শিক্ষার উন্নতির কথা চিন্তা করে শিক্ষককে অবহেলিত রাখা উলুবনে মুক্তা ছড়ানো বৈকি।
আজ দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করতে হয়, আমাদের সমাজে সবচেয়ে অবহেলিত মানুষের একজন হলেন শিক্ষক। বেতন-ভাতা যা পান, তা দিয়ে তাঁর সংসার চালানোই দায়, একটু ভালো করে চলা দূরে থাক। প্রায়ই বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে তাঁদের মাঠে নামতে দেখি। তাঁদের তো মাঠে নেমে আন্দোলন করার কথা ছিল না; তাঁরা তো শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করবেন। ভুলে গেল চলবে না, শিক্ষকের ক্ষত না সারাতে পারলে শিক্ষার ক্ষত মোচনও সম্ভব হবে না।
রাষ্ট্রের উচিত শিক্ষকদের যথাযথ সম্মান প্রদর্শন ও তাঁদের প্রাপ্তি বুঝিয়ে দেওয়া। প্রাথমিক শিক্ষার কথাই ধরুন। শিক্ষার প্রাথমিক স্তরে যাঁরা পাঠদান করেন, তাঁদের রাষ্ট্রের ওপর পাওয়ার পাল্লাটা একটু বেশি হওয়ারই কথা। কেননা, তাঁরা একটি শিশুকে প্রাথমিক স্তরে যত্নসহ শিক্ষাদান করে থাকেন। একটি শিশুর শিক্ষার হাতেখড়ি অনেকটা তাঁদের হাত ধরেই হয়। প্রাথমিক শিক্ষা শেষে আসে মাধ্যমিক। প্রাথমিকের মতো মাধ্যমিকের শিক্ষকদেরও যথাযথ অধিকার ও প্রাপ্তির বিষয়টি দেখার যেন কেউ নেই। অথচ এ দুই স্তরেই একজন শিক্ষার্থী শিক্ষার অতি গুরুত্বপূর্ণ ধাপগুলো পার করে উচ্চমাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষায় পা রাখে।
এখন কথা হলো, গুরুত্বপূর্ণ এ দুই স্তরে আমরা যদি শিক্ষার চালিকা শক্তি অর্থাৎ শিক্ষাগুরুদের বঞ্চিত ও অবহেলিত রাখি, তাহলে কীভাবে জাতি যথার্থ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠবে। দেখা যায়, শিক্ষকদের স্কুলে পাঠদানের পাশাপাশি অন্য কিছু করারও একটা ঝোঁক থাকে। পাছে সংসার চলবে না। আমরা মনে করি, শিক্ষা–বাণিজ্যটা এখান থেকেই শুরু হয়। শিক্ষকতা থেকে প্রাপ্ত বেতনের সঙ্গে আরও কিছু টাকা আয় করার জন্য অনেক শিক্ষককে টিউশনি, এমনকি কোচিংয়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে দেখা যায়। এমনও শুনতে হয়, শিক্ষার্থী যদি তার শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট না পড়ে, সেই শিক্ষক তার (শিক্ষার্থী) পরীক্ষার নম্বর আটকে দিয়েছেন বা কম দিয়েছেন। আমার প্রশ্ন, যদি শিক্ষকদের যথাযথ প্রাপ্য ও অধিকার বুঝিয়ে দেওয়া হতো, তাহলে তাঁদের কি অতিরিক্ত আয়ের চিন্তা করতে হতো?
প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে একজন শিক্ষার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রস্তুতি নিতে হয়। প্রশ্ন হলো, ওপরের এই তিন স্তরে যদি একজন শিক্ষার্থী ভালোভাবে পাঠ লাভ করে থাকে, তাহলে তাকে কেন লাখ লাখ টাকা খরচ করে আলাদা ভর্তি প্রস্তুতির জন্য কোচিংয়ে ভর্তি হতে হবে? ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন কি এ তিন স্তরে অর্জিত শিক্ষার বাইরে থেকে আসে? আসলে মূল কথা হলো, তারা এ স্তরগুলোয় নিজেদের সেভাবে গড়ে তোলার প্রয়াস পায়নি। অনেক শূন্যতা ও গ্যাপ নিয়ে চলে আসে উচ্চশিক্ষার দোরগোড়ায়, যার প্রমাণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অধিকসংখ্যক শিক্ষার্থীর অকৃতকার্য হওয়া। দেখা যায়, ইংরেজি ও অন্যান্য বিষয়ে ভালো না থাকার কারণে শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করতে বেগ পেতে হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষকদের লেকচার বুঝতে সমস্যা হয়। ইংরেজি কিংবা আরবিতে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে, পড়তে হয় বিপাকে। বাধ্য হয়ে শিট মুখস্থ করে যেনতেন পাস করে একটি সার্টিফিকেট নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে যায় তাদের অনেকে।
অনার্স–মাস্টার্স শেষ করে শিক্ষার্থীদের যাত্রা শুরু করতে হয় এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে। আবার শুরু করতে হয় কোচিংয়ের পিছে দৌড়াদৌড়ি। তারপর এক নিদারুণ চাকরির পরীক্ষায় বসতে হয়। প্রতিযোগিতা করতে হয় লাখ লাখ চাকরিপ্রার্থীর সঙ্গে। এই ইঁদুরদৌড় প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে ডিপ্রেশন, অতঃপর ডিপ্রেশন সইতে না পেরে আত্মহনন! এত কষ্ট করে যে মা–বাবা সন্তানকে লেখাপড়া শিখিয়ে উচ্চশিক্ষিত করলেন, শেষমেশ রাষ্ট্রের কাছ থেকে সন্তানের লাশটি পাওয়ার জন্য কি তাঁরা এত স্বপ্ন দেখেছিলেন? শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষককে প্রাথমিক স্তর থেকে যথাযথ মূল্যয়ন করা হলে এমন হযবরল অবস্থা হতো কি?
লেখক: মারুফ হোসেন, শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়