ফিলিস্তিনের কান্না, বিশ্বের নীরবতা
নাগরিক সংবাদ–২
সেকশন:
ট্যাগ: ,
ছবি: গাজার ফাইল ছবি
ছবি: ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাতের ফাইল ছবি
মেটা ও এক্সসার্প্ট:
ব্লার্ব:
‘আমার ভাই মারা গেছে, আমি এখন খেলব না।’
এই কথাগুলো বলেছিল পাঁচ বছরের এক ফিলিস্তিনি শিশু, যে তার ছোট ভাইকে বোমা হামলায় হারিয়েছে। সে জানে না জাতিসংঘ কী, সে বোঝে না মানবাধিকার কনভেনশন, কিন্তু সে বোঝে—একটা মানুষ আর নেই, একটা সম্পর্ক ছিঁড়ে গেছে।
ফিলিস্তিনের শিশুরা এভাবেই বড় হচ্ছে—যুদ্ধের শব্দে, বারুদের গন্ধে, ক্ষুধার যন্ত্রণায় আর প্রিয়জন হারানোর শোকে। অথচ বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো এসব কান্নার কাছে চুপ। কারণ এখানে মানবতা নয়, এখানে খেলে শুধু কূটনীতি, অস্ত্র, দখলদারত্ব আর ভূরাজনৈতিক স্বার্থ।
ইতিহাসের পেছনে লুকানো রাজনৈতিক চিত্র
ফিলিস্তিন সংকটের শুরু ১৯১৭ সালে বেলফোর ঘোষণার (Balfour Declaration) মাধ্যমে, যেখানে ব্রিটিশ সরকার ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে সমর্থন জানায়। এরপর ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের প্রস্তাবে ফিলিস্তিনের ভূমিকে ভাগ করে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই সময় প্রায় ৭ লাখ ফিলিস্তিনি নিজ ভূমি থেকে বিতাড়িত হন—যা ইতিহাসে ‘Nakba’ (catastrophe) নামে পরিচিত।
১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধে ইসরায়েল আরও অধিক ভূমি দখল করে, যার মধ্যে রয়েছে গাজা, পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেম। এই অঞ্চলগুলো এখনো ‘অধিকৃত’ বলে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত।
সাম্প্রতিক যুদ্ধ ও শিশু হত্যার পরিসংখ্যান—
২০২৩ সালের অক্টোবরে শুরু হওয়া সর্বশেষ সংঘাতে গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত হয়েছে—
-৩০,০০০-এর বেশি ফিলিস্তিনি, যার মধ্যে প্রায় ১২,০০০ শিশু এবং ৮,০০০ নারী (সূত্র: আল-জাজিরা, UNRWA, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ)
-প্রতিদিন গড়ে ১০০–১৫০ জন শিশু নিহত হচ্ছে
-প্রায় ১৭ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত, যা গাজার মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮০%
জাতিসংঘ বলছে—গাজা বর্তমানে ‘Children’s Graveyard’ বা শিশুদের কবরস্থানে পরিণত হয়েছে।
ব্লকেড ও মানবিক সংকট: একনজরে—
২০০৭ সাল থেকে গাজার উপর ইসরায়েল ও মিসরের সমন্বিত অবরোধ চলছে। ফলে:
- ৯০%-এর বেশি পানি পানযোগ্য নয়
- বিদ্যুৎ প্রতিদিন ২-৩ ঘণ্টার বেশি আসে না
- ওষুধ, চিকিৎসা ও খাদ্যের তীব্র সংকট
- স্কুল, হাসপাতাল, মসজিদ—সবই ইসরায়েলি হামলার লক্ষ্যবস্তু
রেডক্রস, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ—এ হামলাগুলোকে যুদ্ধাপরাধ বলে আখ্যা দিয়েছে।
বিশ্বের নীরবতা: দ্বিমুখী আন্তর্জাতিক রাজনীতি—
বিশ্বের বহু রাষ্ট্র মানবতার কথা বললেও বাস্তবে তারা ফিলিস্তিনের পাশে দাঁড়াতে ব্যর্থ। এর কারণ:
১. যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি সমর্থন: ইসরায়েলকে প্রতিবছর প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলার সামরিক সহায়তা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। প্রতিটি সংঘাতে তারা ইসরায়েলের ‘আত্মরক্ষার অধিকার’-এর কথা বলে, অথচ ফিলিস্তিনিদের বেঁচে থাকার অধিকার নিয়ে নীরব থাকে।
২. জাতিসংঘের অসহায়তা: নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিটি প্রস্তাবে মার্কিন ভেটো ইসরায়েলকে দায়মুক্তি দেয়। ফলে যুদ্ধ বন্ধে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হয় না।
৩. ইউরোপের দ্বিচারিতা: ইউক্রেনের যুদ্ধ হলে মানবাধিকার রক্ষায় সোচ্চার হয় যারা, ফিলিস্তিনের শিশু মরলে তারা কৌশলী নীরবতা পালন করে।
গণমাধ্যম ও মিথ্যা বিবরণ: তথ্যযুদ্ধে ফিলিস্তিনের হার—
পশ্চিমা গণমাধ্যমে অধিকাংশ সময় সংঘাতকে দুই পক্ষের যুদ্ধ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। তারা প্রায়ই শিশু হত্যার খবরকে ‘সংঘর্ষে নিহত’ হিসেবে প্রচার করে, যেন উভয় পক্ষ সমান দোষী। বাস্তবতা হলো—
- ইসরায়েল একটি আধুনিক সামরিক শক্তি
- ফিলিস্তিনিরা দখলকৃত ভূমিতে অস্ত্রহীন, অবরুদ্ধ এবং গৃহহীন
বিসিসি, সিএনএন–এর মতো মিডিয়ায় বারবার ফিলিস্তিনের কষ্টকে ‘সন্ত্রাস’-এর ছায়ায় ঢেকে দেওয়া হয়।
মানবতা প্রশ্নে আমাদের করণীয়:
যদি আমরা সত্যিকার অর্থে মানুষ হই, তাহলে ন্যায়ের পক্ষে, নির্যাতিতের পাশে দাঁড়ানো আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। আমরা হয়তো যুদ্ধ থামাতে পারব না, কিন্তু:
- সচেতনতা ছড়িয়ে দিতে পারি
- সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তথ্য প্রচার করতে পারি
- নির্ভরযোগ্য ফান্ডে সাহায্য পাঠাতে পারি
- শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সমাজে আলোচনার মাধ্যমে পরবর্তী প্রজন্মকে সচেতন করতে পারি।
শেষ কথা: নীরবতা নিজেই এক অপরাধ
মানব ইতিহাসে যত ভয়ংকর ঘটনা ঘটেছে, তার পেছনে শুধু দুষ্কৃতকারীরা দায়ী নয়, দায়ী ছিল সেই সব মানুষও—যারা দেখেও কিছু বলেনি। ফিলিস্তিনের এই কান্নার মুহূর্তে আমরা যদি চুপ থাকি, তাহলে ভবিষ্যতে আমাদের চুপ থাকার ব্যাখ্যা কী হবে?
কোনো শিশু যখন বেঁচে থাকার সুযোগ না পায়, তখন শুধু সে মারা যায় না—মরে যায় মানবতার এক টুকরা ইতিহাস।
ফিলিস্তিনের কান্না এখন আর শুধু ওদের কান্না নয়, এটা একটি পরীক্ষা—আমরা এখনো মানুষ কি না, তা প্রমাণ করার।
‘নাগরিক সংবাদ’-এ নানা সমস্যা, জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]