সুন্দরবনকথন

ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে জোয়ার-জলোচ্ছ্বাসের পানিতে প্লাবিত হয় গোটা সুন্দরবন। ধীরে ধীরে সুন্দরবনের ক্ষত স্পষ্ট হচ্ছেছবি: প্রথম আলো

৫ জুন পরিবেশ দিবস পালিত হয়।
এবার রিমালের থাবা থেকে বাঁচিয়ে দিল সুন্দরবন। সুন্দরবন আমাদের গর্ব। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনভূমি এটি। ১৯৯৭ সালে ইউনেসকো এই বনকে ‘বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতের মোট ১০ হাজার বর্গকিলোমিটারজুড়ে এটি বিস্তৃত হলেও বাংলাদেশের সীমানায় এর বিস্তার ৬ হাজার ১৭  বর্গকিলোমিটার। আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে রয়েছে এর এক অনন্য ভূমিকা। প্রাণী, উদ্ভিদ ও মৎস্যসম্পদের অন্যতম উৎস এই বনভূমি।

বিদ্যুৎ ও উন্নয়নের কোপটা যেন বনের ওপর

অন্যদিকে সিডর–আইলার মতো বড় বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রকৃতির ঢাল হিসেবে সংলগ্ন উপকূলে মানুষের জীবন রক্ষা করে চলেছে এ বন। উপকূলীয় অঞ্চলের প্রায় দুই কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে তাদের জীবিকার জন্য এই সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু সাম্প্রতিক জলবায়ু পরিবর্তনসহ মনুষ্যসৃষ্ট কিছু প্রতিবন্ধকতার কারণে স্বরূপ হারাচ্ছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ এই ম্যানগ্রোভ বনটি। তাই সুন্দরবনের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় নিতে হবে কঠোর পদক্ষেপ এবং বাড়াতে হবে জনসচেতনতা।

বনের চ্যানেল দিয়ে চলে বড় বড় কার্গো

সরেজমিনে সুন্দরবনের হরিণটানা খালের মুখে গিয়ে দেখা গেল, তিন-চারটি কার্গো লাইন ধরে মোংলার দিকে যাচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, বর্তমানে প্রতিদিনই এই রুটে ২৫ থেকে ৩০টি তেলবাহী ট্যাংকার ও মালবাহী কার্গো যাতায়াত করছে। বনের বাইরে দিয়ে পূর্ব পাশে ঘাসিয়াখালী খাল দিয়ে ছিল মোংলা-বরিশাল-চট্টগ্রাম রুট। ঘাসিয়াখালী খালে পলি পড়ায় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীন অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ গত বছরের জুন-জুলাইয়ে উত্তর-পূর্ব সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে প্রায় ৬০ কিলোমিটারের একটি নৌরুট চালু করে। এর জন্য বন বিভাগের কোনো অনুমতি নেওয়ারও ধার ধারেনি তারা।

পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের তথ্যে জানা যায়, বর্তমানে ব্যবহৃত রুটটি হরিণ ও বেঙ্গল টাইগারের অন্যতম বিচরণক্ষেত্র। এ এলাকাটি কম সময়ে সবচেয়ে বেশি বেঙ্গল টাইগারের বিচরণের জন্য বিখ্যাত। এ ছাড়া ডলফিনের জন্য বড় বিচরণক্ষেত্র হিসেবে পরিচিত এ রুটের দুধমুখী-রায়েন্দা-সন্ন্যাসী গাঙের এলাকাটি। সুন্দরবনের ভেতরের নদী বা খালে ঢুকতে বন বিভাগের অনুমতি নেওয়ার বিধান রয়েছে বন আইন ও বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইনে। এর ভেতর দিয়ে ভারী নৌযান চলাচলও নিষিদ্ধ। এ অবস্থায় বিআইডব্লিউটিএকে একাধিকবার এই রুট বন্ধের চিঠিও দিয়েছে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়। চিঠিতে তারা নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়কে রায়েন্দা-শাপলা-হরিণটানা-চাঁদপাই হয়ে নৌযান চলাচলের পরামর্শ দিয়েছে। বর্তমানে সুন্দরবনের ভেতরের সন্ন্যাসী-রায়েন্দা-বগী-শরণখোলা-দুধমুখী-হরিণটানা-আন্ধারমানিক-মুগমারী-চাঁদপাই-জয়মনিরগোল হয়েই চলাচল করছে জাহাজগুলো।

গত বছর সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে চলাচলকারী নৌযানগুলোর ওপর একটি সমীক্ষা চালায় ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশন সোসাইটি (ডব্লিউসিএস)। নিউইয়র্কভিত্তিক ওই সংগঠনের সমীক্ষা তেলবাহী ট্যাংকারগুলো ঘণ্টায় ২০ থেকে ৩০ কিলোমিটার বেগে, কার্গো ১৫ থেকে ২৫, বিদেশি জাহাজ ২০ থেকে ৩০ এবং স্পিডবোটগুলো ৩০ থেকে ৪০ কিলোমিটার বেগে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে চলাচল করে। এসব নৌযান থেকে সৃষ্ট ঢেউয়ে সুন্দরবনের সেলা, পশুর ও ঢাংমারী নদীর পার্শ্ববর্তী এলাকার দুই থেকে তিন কিলোমিটার জায়গার পাড় ভেঙে যাচ্ছে। এতে ব্যাহত হচ্ছে বন্য প্রাণীর বিচরণ এবং খাদ্য গ্রহণ। ট্যাংকারগুলো থেকে নিঃসৃত তেল ও বর্জ্য ছড়িয়ে পড়ছে সুন্দরবনের ভেতরের খালগুলোতে। দূষিত হচ্ছে এই অঞ্চলের মাটি ও পানি। শুধু তা–ই নয়, নৌযানগুলো সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে চলাচলের সময়ে হাইড্রোলিক হর্ন বাজাচ্ছে, যার আওয়াজে হরিণসহ দুর্লভ প্রাণী দিগ্‌বিদিক ছোটাছুটি করে নাজেহাল হচ্ছে।

বিরূপ প্রভাব তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের

চলতি বছরের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড এবং ভারতের ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের ভেতর কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সুন্দরবনসংলগ্ন বাগেরহাটের রামপালে এ বিদ্যুৎকেন্দ্র যাতে স্থাপিত না হয়, সে জন্য চুক্তি স্বাক্ষরের আগেই পরিবেশবিদ ও সুশীল সমাজের নেতারা প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। কেননা এই এলাকায় বিদ্যুৎকেন্দ্রটি স্থাপিত হলে সুন্দরবনের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ভীষণ ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। তখন বিশিষ্ট নাগরিকদের স্বাক্ষরিত আবেদনে বলা হয়েছিল, ‘বিদ্যুৎ উৎপাদনের সরকারি উদ্যোগকে স্বাগত জানালেও বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য রামপাল উপজেলাকে নির্বাচন করায় আমরা উদ্বিগ্ন। এতে বিশ্ব ঐতিহ্যের ধারক পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন এবং এর পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য হুমকির সম্মুখীন হবে। সরকার যে প্রাথমিক পরিবেশগত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে এ বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের অনুকূলে ছাড়পত্র দিয়েছে, তাতে প্রকল্প এলাকাটি সুন্দরবনের প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকার চার কিলোমিটারের মধ্যে এবং বনের সীমানা থেকে ১০ কিলোমিটার বাফার জোনের মধ্যে অবস্থিত।’

এদিকে বিশেষজ্ঞদের গবেষণায় জানা গেছে, কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিপুল পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড, বিভিন্ন ক্ষুদ্র কণিকা, কার্বন মনোক্সাইড, মারকারি বা পারদ, আর্সেনিক, সিসা, ক্যাডমিয়ামসহ পরিবেশ ও মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বিভিন্ন উপাদান নির্গত হয়। কয়লা পুড়িয়ে ছাই তৈরি হয় এবং কয়লা ধোয়ার পর পানির সঙ্গে মিশে তৈরি হয় কোল স্লাজ বা স্লারি নামে আরেকটি তরল কয়লা বর্জ্য। ছাই এবং স্লারি উভয় বর্জ্যই বিষাক্ত। কারণ, এতে বিষাক্ত আর্সেনিক, মার্কারি, ক্রোমিয়াম, এমনকি তেজস্ক্রিয় ইউরেনিয়াম ও থোরিয়ামও থাকে। এ কেন্দ্র থেকে সুন্দরবনের দূরত্ব মাত্র ১৪ কিলোমিটারের মতো। তাদের মতে, কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের কঠিন ও তরল বর্জ্য বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে, কয়লা সংরক্ষণ আধার থেকে চুইয়ে ভূগর্ভস্থ ও উপরিভাগের সঙ্গে মিশে পানিকে দূষিত করে। এতে জলজ উদ্ভিদ, মাছসহ পানির জীবচক্রের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এ ছাড়া টারবাইন, কম্প্রেশর, পাম্প, কুলিং টাওয়ার, কনস্ট্রাকশনের যন্ত্রপাতি, পরিবহনের যানবাহনের মাধ্যমে শব্দদূষণও ঘটবে। এসব কারণেই আবাসিক এলাকা, কৃষিজমি এবং বনাঞ্চলের আশপাশে কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হয় না।

নিজ দেশেও ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন দেয়নি ভারত। ভারতের বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে চেয়েছিল নরসিংহপুর জেলার ঝিকলি ও তুমরা গ্রামে। তখন দেশটির পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের এক্সপার্ট অ্যাপ্রাইজাল কমিটির সভায় বলা হয়, বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য নির্ধারিত স্থানটি মূলত কৃষিজমিপ্রধান এবং এ বিষয়ে প্রকল্পের পক্ষের লোকদের দেওয়া তথ্য গ্রহণযোগ্য নয়। এতে এখানকার কৃষিজমির ব্যাপক ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকবে। এমনকি প্রস্তাবিত কেন্দ্রের ১৫ কিলোমিটারের মধ্যে সংরক্ষিত বনও ছিল। এ ছাড়া ভারতীয় পরিবেশ আইনে কোনো সংরক্ষিত বনের ১৫ কিলোমিটারের মধ্যে তাপভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ না করার বিধানও রয়েছে।

পরিবেশ নষ্ট করছেন স্থানীয় পর্যটকেরাও

‘Too much crowd & to much noise’ সুন্দরবনে এসে কেমন লাগছে জানতে চাইলে প্রতিবেদকের কাছে এমন মন্তব্যই করলেন ফ্রান্স থেকে আসা কেরি দম্পতি। স্থানীয় পর্যটকদের অসচেতনতার জন্য বিদেশিদের কাছে সুন্দরবনের সুনাম ক্ষুণ্ন হচ্ছে এভাবেই। সুন্দরবনের কটকা সৈকতে দেখা গেল স্থানীয় পর্যটকেরা লঞ্চ ভাড়া করে এসে পিকনিক করছে। লঞ্চের মাইকে চড়া আওয়াজে বাজানো হচ্ছে গান। কিছুক্ষণ পরে বন বিভাগের নিরাপত্তারক্ষীরা এলে গান বন্ধ করে দেওয়া হয়। দেখা গেল, লঞ্চের অনেকেই চিপসের প্যাকেট, সিগারেটের বাঁট ইত্যাদি পানিতে ফেলছে, যদিও কোনো ধরনের ময়লা-আবর্জনা বনে এবং পানিতে ফেলা নিষিদ্ধ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশি–বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করতে তাদের দর্শনীয় স্থানগুলো নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে রাখে। কারণ, বিদেশি পর্যটকেরা নিজেদের পয়সা খরচ করে নোংরা জিনিস দেখতে যাবে না। অবশ্য দেশের পর্যটনশিল্পের উন্নয়নে বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। সেই সঙ্গে চেষ্টা করা হচ্ছে সচেতনতা বাড়ানোর। সরকারের একার পক্ষে পরিবেশকে রক্ষা করা সম্ভব নয়। এগিয়ে আসতে হবে সবাইকে। সুন্দরবনের পরিবেশ রক্ষায় এরই মধ্যে বন বিভাগ একটি খসড়া নীতিমালা প্রণয়ন করেছে, যা বর্তমানে অনুমোদনের অপেক্ষায়। সুন্দরবন ভ্রমণের ক্ষেত্রে বন বিভাগের দায়িত্ব, ভ্রমণের নির্ধারিত রুট, ভ্রমণকারী পর্যটকদের করণীয়, ট্যুর অপারেটরদের দায়িত্বসহ প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো নীতিমালায় উল্লেখ রয়েছে।

সুন্দরবন এলাকায় জলকেলিতে মেতেছে ডলফিনটি
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় সুন্দরবনের ভূমিকা

সিডর-আইলার মতো বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগে উপকূলের মানুষ রক্ষা পেয়েছে সুন্দরবনের জন্য। এমন দুর্যোগের সময় প্রাকৃতিক ঢালের মতোই উপকূলীয় এলাকাকে আগলে রাখে এ সুন্দরবন। প্রলয়ংকরী এ দুটি ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষতি উপকূলবাসী এখনো কাটিয়ে উঠতে না পারলেও সেই ধাক্কা সামলে সুন্দরবন ঠিকই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে গেছে। ২০০৯-২০১০ সালে সহকারী বন সংরক্ষক ইমরান আহমেদ এবং যুক্তরাষ্ট্রের বনসেবা বিভাগের প্রতিবেশ গবেষক ড্যানিয়েল সি ডোনটো সুন্দরবনে কার্বনের পরিমাণ নির্ধারণের ওপর এক সমীক্ষা পরিচালনা করেন। সেই সমীক্ষার তথ্য থেকে জানা যায়, ২০০৭ সালে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় সিডর এবং ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলার কারণে সুন্দরবনের নদী-সমুদ্রসংলগ্ন এলাকায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল। কিন্তু সুন্দরবনের কারণে ঝড় দুটি মানববসতি এলাকায় আসার আগেই অনেক দুর্বল হয়ে পড়েছিল। সিডর ও আইলার পর আবহাওয়া বিভাগ থেকে জানানো হয়, সুন্দরবন না থাকলে সিডরের ধাক্কাটা আসত খোদ রাজধানী পর্যন্ত। সুন্দরবনের গাছপালায় বাধা পেয়ে সিডরের গতি প্রতি ঘণ্টায় ২৫০ কিলোমিটার থেকে কমে ২০০ কিলোমিটারের নিচে নেমে গিয়েছিল। নিজে ক্ষতবিক্ষত হয়ে সুন্দরবন রক্ষা করেছিল মানুষের জীবন ও সম্পদ। প্রকৃতিবিষয়ক গবেষণা সংস্থা ‘সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসেস’ ঘূর্ণিঝড় আইলার পর তাৎক্ষণিক এক সমীক্ষা চালায়। সমীক্ষা অনুযায়ী, সুন্দরবনের কারণে আইলার বাতাসের গতি ঘণ্টায় ৪০ কিলোমিটার ও জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা চার ফুট কমে গিয়েছিল। সিডর–পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন বিদেশি ও দেশি সংস্থা সুন্দরবনের ক্ষয়ক্ষতির ওপর সমীক্ষা চালায়।

ইউএনডিপির প্রতিবেদন অনুযায়ী, সুন্দরবনের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল মোট এলাকার ২১ শতাংশ। এ ছাড়া ইউনেসকো এবং এসপিএআরআরএসওর প্রতিবেদন অনুযায়ী এর পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৩০ এবং ১৯ শতাংশ। অনেকেই মনে করেছিলেন ক্ষয়ক্ষতির জন্য বনের প্রতিবেশব্যবস্থা হয়তো ভেঙে পড়তে পারে। এরপরও সুন্দরবন তার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পেরেছে। বনের যেসব অংশে মানববসতি রয়েছে সেসব এলাকার বনজ সম্পদের পরিমাণ কমে গেলেও যে অংশে নদী ও বঙ্গোপসাগর সেই অংশে বনজ সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে। এমনকি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ঝড়ের পর সুন্দরবনের চারা গজানো এবং তা থেকে পরিপূর্ণ বৃক্ষে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা আরও বেড়েছে। এর কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন, সিডর ও আইলার আঘাতে অনেক পুরোনো ও বড় গাছ ভেঙে গিয়েছিল। এতে ছোট ও নতুন গাছের বেড়ে ওঠার মতো আলো-বাতাস ও জীবনীশক্তি পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। ভাঙা গাছ না কাটার ফলে পড়ে থাকা গাছের ডাল-পাতা পচে বনের মাটিকে উর্বর করেছে, যার জন্য টিকে থাকা গাছগুলো দ্রুত বেড়ে উঠেছে।

পর্যটনশিল্পের বিকাশে সুন্দরবন

যেকোনো দেশের অর্থনীতিতে পর্যটনশিল্প বিরাট ভূমিকা রাখে। কেননা পর্যটনশিল্পের মাধ্যমে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব হয়। দেশের সুন্দরবন বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের বিশাল একটি খাত। জাতীয় অর্থনীতিতে বিশাল অবদান রয়েছে সুন্দরবনের। সুন্দরবন ঘিরে পর্যটনশিল্প আরও আধুনিক, যাতায়াতব্যবস্থার উন্নয়ন এবং নিরাপত্তাব্যবস্থা নিশ্চিত করা হলে রাজস্ব আদায় কয়েক গুণ বেড়ে যাবে। সুন্দরবনের গহিনে পর্যটকদের চাপ কমানোর জন্য নতুন পর্যটন অঞ্চল তৈরি, পর্যটকদের নিরাপদ ভ্রমণ নিশ্চিত, বনের জীববৈচিত্র্যের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নৌযান এবং যুগোপযোগী নীতিমালা প্রণয়ন করা হলে এ শিল্প থেকে রাজস্ব আদায় প্রতিবছর কয়েক গুণ বাড়বে। এ ছাড়া প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে বিশাল জনগোষ্ঠীর জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থা করে দিচ্ছে এই সুন্দরবন।

*লেখক: রিপন আশরাফ, উন্নয়ন গবেষক ও কলামিস্ট। [email protected]

**নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]