জীবনানন্দ দাশের মানসী: সুরঞ্জনা, বোলোনাকো কথা ওই যুবকের সাথে

জীবনানন্দ দাশ (১৭ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৯-২২ অক্টোবর ১৯৫৪)প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল

‘আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,/ আমারে দু–দণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন’, ‘সুরঞ্জনা, ওইখানে যেওনাকো তুমি,/ বোলোনাকো কথা ওই যুবকের সাথে;/ ফিরে এসো সুরঞ্জনা/ নক্ষত্রের রুপালি আগুন ভরা রাতে; (আকাশলীনা/সাতটি তারার তিমির)’—জীবনানন্দ দাশের (বরিশাল, ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৯—কলকাতা, ২২ অক্টোবর ১৯৫৪) অন্যতম পাঠকপ্রিয় কবিতা।

‘বনলতা সেন’ তো বাংলা সাহিত্যের সর্বোচ্চ পঠিত/জনপ্রিয় কবিতা। বনলতা সেন যেন শুধু জীবনানন্দ দাশের মানস নয়, যেন আমারই প্রেমিকা। বনলতা সেন, সুরঞ্জনা অতি পরিচিত নাম। আর এই পরিচিতির প্রধান অবদান জীবনানন্দ দাশ। এ ছাড়া শেফালিকা বোস, শ্যামলী, সবিতা, অরুণিমা স্যানাল, সরোজিনী, সুচেতনা, মৃণালিনী ঘোষাল, শঙ্খমালা, চন্দ্রমালা, মানিকমালা প্রমুখ নারী–নাম রয়েছে তাঁর কবিতায়। এসব নাম নিয়ে, নারীসংকেত নিয়ে রয়েছে বিভিন্ন প্রসঙ্গ।

জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেন মাস্টারপিস চরিত্র। বাংলায় সবচেয়ে পঠিত একটি চরিত্র বনলতা সেন। জীবনানন্দ দাশের কল্যাণেই ক্লাসিক মর্যাদা ও তুমুল জনপ্রিয় হয়েছে বনলতা সেন চরিত্র। ভিঞ্চির মোনালিসার মতো জীবনানন্দের মানসকন্যা হচ্ছে বনলতা। বনলতা সেন যেন আমাদের মোনালিসা। ভিঞ্চির মোনালিসার সুন্দর দৃশ্য আমাদের মুগ্ধ করে; তেমনি জীবনানন্দের বনলতা সেন বাঙালির মানসপটে এক অপূর্ব নায়িকার চিত্রকল্প সৃষ্টি করে। পার্থক্য, মোনালিসা চিত্রকর্ম—শরীরী আর বনলতা সেন অশরীরী। কিন্তু দুজনের প্রতিই পাঠক-শ্রোতার প্রবল আগ্রহ, দুর্নিবার আকর্ষণ। জীবনানন্দের মতো আমরাও আশ্রয় ও প্রশ্রয় খুঁজি বনলতা সেনের মধ্যেই—‘দু–দণ্ড শান্তি’ খুঁজি তার মধ্যেই। ‘আকাশলীনা’ চরিত্রও বাঙালির মনের আরেকটি আগ্রহের বিষয়। বাঙালির মানসপটে ও বাহ্যিক প্রভাব বনলতা সেনের কাছাকাছি না হলেও বেশি দূরের নয়। আকাশলীনার হৃদয় যেন ঘাস। শঙ্খমালা কিশোরী—কবির অকালপ্রয়াত নায়িকা। শঙ্খমালার প্রসঙ্গ এসেছে একাধিক কবিতায়। ‘করুণ শঙ্খের মতো স্তন’ বা ‘কড়ির মতো শাদা মুখ’ তার। কান্তারের পথ ছেড়ে এসে কবি শঙ্খমালাকে বলেন ‘তোমারে চাই’। জীবনানন্দের বোধে প্রেম, প্রকৃতি ও মানুষ মিলেমিশে একাকার হয়েছে। হয়তো প্লেটনিক প্রেমে নয়; বরং দেহজ প্রেমে বিশ্বাসী ছিলেন তিনি। বনলতা সেন ও শঙ্খমালার পাশাপাশি ‘সুদর্শনা’ নায়িকার উপস্থাপনাও এমনই বলে। সুদর্শনার প্রসঙ্গও একাধিকবার এসেছে। প্রাকৃতিক প্রেমের আশ্রয়েও আধুনিক নাগরিকজীবনের অনুষঙ্গ সুদর্শনা। সুরঞ্জনা প্রেম ও অপ্রেমের দ্বন্দ্ব নিয়ে হাজির হয়েছে জীবনানন্দের কবিতায়। সুরঞ্জনা যেন ‘মানুষের তরে এক মানুষীর গভীর হৃদয়’।

জীবনানন্দ দাশের কবিতায় ব্যবহৃত নারী চরিত্রসমূহ বিচিত্র চরিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ‘মনে পড়ে কবেকার পাড়াগাঁর অরুণিমা সান্যালের মুখ’ (বুনো হাঁস/বনলতা সেন), ‘এইখানে মৃণালিনী ঘোষালের শব/ ভাসিতেছে চিরদিন: নীল লাল রুপালি নীরব (শব/মহাপৃথিবী)’ পঙ্‌ক্তির মতো কিছু স্থানে প্রেমিকার নামের সঙ্গে পদবি যোগ (সেন, স্যানাল, ঘোষাল) করে আরও বাস্তব ও জীবন্ত করেছেন। আবার ক্ষেত্রমতে, ভৌগোলিক স্থান (নাটরের বনলতা সেন) যুক্ত করেছেন। জীবনানন্দের কাছে মুক্তির আশ্রয় তিনটি—প্রকৃতি, প্রেম এবং অতীতের রহস্যময় সৌন্দর্যের জগৎ। উল্লিখিত নায়িকাদের প্রসঙ্গ নিয়ে কিছু পঙ্‌ক্তি তুলে ধরা যাক—

(১) চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,

মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের ’পর

হাল ভেঙে যে–নাবিক হারায়েছে দিশা

...সব পাখি ঘরে আসে—সব নদী—ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন;

থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।

[বনলতা সেন]

(২) শ্যামলী, তোমার মুখ সেকালের শক্তির মতন;

যখন জাহাজে চড়ে যুবকের দল

...তোমার মুখের দিকে তাকালে এখনও

আমি সেই পৃথিবীর সমুদ্রের নীল,

দুপুরের শূন্য সব বন্দরের ব্যথা,

বিকেলের উপকণ্ঠে সাগরের চিল,

নক্ষত্র, রাত্রির জল, যুবাদের ক্রন্দন সব—

শ্যামলী, করেছি অনুভব।

[শ্যামলী/বনলতা সেন]

(৩) সুচেতনা, তুমি এক দূরতর দ্বীপ

বিকেলের নক্ষত্রের কাছে;

সেইখানে দারুচিনি-বনানীর ফাঁকে

নির্জনতা আছে।

[সুচেতনা/বনলতা সেন]

(৪) ‘বেতের ফলের মতো নীলাভ ব্যথিত তোমার দুই চোখ

খুঁজেছি নক্ষত্রে আমি—কুয়াশার পাখনায়—

…জোনাকির দেহ হতে—খুঁজেছি তোমারে সেইখানে

…চিতা জ্বলে: দখিন শিয়রে মাথা শঙ্খমালা যেন পুড়ে যায়

…স্তন তার

করুণ শঙ্খের মতো—দুধে আর্দ্র—কবেকার শঙ্খিনীমালার!

এ–পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় নাকো আর’

[শঙ্খমালা/বনলতা সেন]

বনলতা সেন থেকে আকাশলীনা, সুরঞ্জনা হয়ে শঙ্খমালা মনের মাধুরী দিয়ে নায়িকাদের উপস্থাপন করেছেন জীবনানন্দ দাশ। সময়ের অস্থিরতা, প্রেম-অপ্রেমের জটিলতার মধ্যেই বিকশিত হয়েছে জীবনানন্দ দাশের কবিতার নায়িকারা, নারীরা। কখনো সুরঞ্জনা, কখনো সবিতা বা সুদর্শনা, কখনো নাম উল্লেখ না করেই জীবনানন্দের নায়িকারা বিকশিত হয়েছে। কবির মানসীরা আক্ষেপ বাড়িয়েছে, অধরা রয়ে গেছে—

‘সরোজিনী চ’লে গেলো অতদূর? সিঁড়ি ছাড়া—পাখিদের মতো পাখা বিনা?

…জাফরান আলোকের বিশুষ্কতা সন্ধ্যার আকাশে আছে লেগে;

লুপ্ত বেড়ালের মতো; শূন্য চাতুরীর মূঢ় হাসি নিয়ে জেগে’

[সপ্তক/সাতটি তারার তিমির]

লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক