১৩টি লাল গোলাপ

লাল গোলাপ
ছবি: পেক্সেলস

সকাল ৬টা বেজে ২০ মিনিট। জহির সাহেব কাকরাইল মসজিদে ফজরের নামাজ পড়ে হাঁটতে বের হলেন। হাঁটতে হাঁটতে ঢুকে পড়লেন রমনা পার্কে। অনেকক্ষণ হেঁটে ক্লান্ত হয়ে গেছেন। পা আর চলছে না। বসে পড়লেন পার্কের এক কাঠের বেঞ্চে। অলসভাবে হেলান দিয়ে একমনে তাকিয়ে রইলেন একটি মেয়ের দিকে। মেয়েটি ছোট্ট একটা কালো বালতিতে গোলাপ ফুল সাজাচ্ছে। মেয়েটির বয়স কত হবে, এই ধরুন সাত থেকে আট। চুলগুলো গোলাপ ফুল দিয়ে দুইটা ঝুঁটি বেঁধে রেখেছে।

সামনের চুল পড়ে আছে কপালে। চোখ দুটি দেখলেই মায়া লাগে। নাকটা কী সুন্দর বাঁশের কঞ্চির মতো চিকন। ঠোঁট দুটি গোলাপের পাপড়ির মতো পাতলা। গলায় দুটি ভাঁজ পড়েছে। কালো একটা ফিতায় লম্বা একটা তাবিজ ঝুলে আছে গলায়। এই তাবিজের জন্য তার সৌন্দর্য আরও বেশি ফুটে উঠেছে।

এই মেয়ে, এই?
জহির সাহেব ডাক দিতে গিয়েও থেমে গেলেন। মেয়েটি ফুল সাজানোর ফাঁকে একনজর দেখে চোখ ফিরিয়ে নিল।

জহির সাহেব দেখতে লাগলেন মেয়েটিকে। মনে মনে বললেন, এক ফুল আরেক ফুলকে কী যত্ন করে সাজাচ্ছে।

জহির সাহেব মেয়েটিকে কাছে ডাকলেন। মেয়েটি ফুল নিয়ে এল।

তোমার ফুল কত করে?
স্যার, কয়টা লাগব কন?
১৩টা ফুল দাও।
স্যার, দুইটে বাড়ায়ে দিই? কম রাখব নি?
দাও।
কী নাম তোমার?
ফুল।
বাহ, বেশ তো। ‘ফুল’ দেখি ফুল বিক্রি করছে।
এই যে স্যার লন, এত্তগুলা ফুল দিয়ে কী করবেন?
আমার মেয়েটাকে দেব।

আপনের মাইয়্যার কি আজ জন্মদিন?
জহির সাহেব মুচকি হাসি দেওয়ার চেষ্টা করলেন। হাসি এল না। গলা ধরে এল। চোখে পানি টলমল করতে লাগল। অন্যদিকে ফিরে বললেন, না, ফুল। আজ আমার মেয়ের মৃত্যুর দিন।

ফুল ফুলগুলোকে পলিথিনে তুলতে তুলতে বলল, স্যার, মন খারাপ কইরেন না। গেল শনিবারে আমার আম্মার পেটে ব্যথা উঠছিল। হাসপাতালে নিতে নিতেই আম্মার চোখ বন্ধ হয়ে গেল। আম্মারে কত যে ডাকলাম! আম্মা একটাবার চোখ মেলে তাকালই না? আচ্ছা স্যার, কন তো, আম্মা কি মইরে গেছে? বড় বড় স্যারেরা কইল, আম্মা নাকি অনেক ভালো আছে। হাসপাতালে ভর্তি হয়ে আছে। এখন দেখা করা যাইব না।

দেখলেই নাকি আম্মার অসুখ বাইড়ে যাইব। আমি এ জন্য প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা হাসপাতালের সামনে ফুল নিয়ে দাঁড়ায়ে থাকি। আম্মার জন্য অপেক্ষা করি!
জহির সাহেব নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলেন না। ফুলগুলো বেঞ্চে ফেলে রেখে চলে গেলেন।
ফুল পেছন থেকে বলল, স্যার, ফুলগুলো নিবেন না?
জহির সাহেব কোনো কথা বলতে পারলেন না। শুধু মাথা নাড়লেন।

বিকেলে ফুলকে সঙ্গে নিয়ে আজিমপুর কবরস্থানে গেলেন। পেছনে ফুল দাঁড়িয়ে রইল। জহির সাহেব ১৩টা ফুল তার মেয়ের কবরের ওপর রাখলেন। রেখে বললেন, মা, তুই কি আর বড় হবি না? সেই ১৩ বছর বয়সে আমাকে ছেড়ে চলে গেলি আর তো ফিরে এলি না! আমার বয়স বেড়ে গেল, পৃথিবীর বয়স বেড়ে গেল। সবকিছুর বয়স বেড়ে যাচ্ছে দিনকে দিন, কিন্তু তোর বয়স একটা দিনও বাড়ল না। জহির সাহেব হাউমাউ করে কেঁদে উঠল।

কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়ল কবরের পাশে।

একটু পর আসমান অন্ধকার হয়ে এল। চারদিকে দমকা হাওয়া বইতে লাগল। যেন সবকিছু আজ উড়িয়ে নিয়ে যাবে। পুরো শহর কাঁপিয়ে ঝুম বৃষ্টি নেমে এল শহরে।
ফুল ও জহির সাহেব বৃষ্টি মাথায় নিয়ে হাঁটতে লাগলেন রাস্তায়। সবাই অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে দেখছে দুটি মানুষকে। ফুল জহির সাহেবের আঙুল ধরে হাঁটছে আর হাঁ করে বৃষ্টি খাচ্ছে।

জহির সাহেব ফুলের মুখে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে গেলেন। তাঁর বুকের সব ব্যথা দূর হয়ে গেল। তিনি দেখতে পেলেন, অবিকল তাঁর মেয়ে তাঁর আঙুল চেপে আকাশে মুখ করে বৃষ্টি খাচ্ছে। মনের অজান্তেই তাঁর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা গান—
এসো নীপবনে ছায়াবীথি তলে
এসো করো স্নান নবধারাজলে।