নর্দামটনে পাকিস্তানবধ!

১৯৯৯ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপের কথা বলছি। প্রিয় লাল–সবুজের পতাকা ইংল্যান্ডের আকাশে পতপত করে উড়ছে। আমি সদ্য স্কুলে যাওয়া কিশোর, প্রতিদিন এ পতাকার দিকে তাকিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করি। স্বপ্নের আকাশ লাল–সবুজের চেতনায় একেবারে টইটম্বুর। বিটিভিতে বাংলাদেশ দলকে শুভেচ্ছা জানিয়ে একটা গান পরিবেশিত হতো খানিকটা সময় পরপর। গানের লাইন ছিল এ রকম (ভুল হতে পারে),
‘গুড লাক বাংলাদেশ, গুড লাক।

বিশ্বকাপে যাত্রা শুভ হোক...
কোটি কোটি প্রাণ আজ উত্তেজিত উদ্বেলিত,
কোটি কোটি চোখ নিষ্পলক
যাত্রা শুভ হোক, যাত্রা শুভ হোক’

গানের সুর কানে আসামাত্রই ক্রিকেটের একা অদ্ভুত মাদকতায় নেশা ধরে যেত। এক অন্য রকম উন্মাদনা মেতেছিল বাংলার গ্রাম, মহল্লা ও শহরের প্রতিটি অলিগলি। বেতারে চৌধুরী জাফরুল্লাহ শরাফত, খোদাবক্স মৃধা ভরাট কণ্ঠে খেলার চিত্রনাট্য শোনাতেন। মনে হতো, তৃতীয় চোখ দিয়ে স্পষ্ট দেখছি। হারজিত ছাপিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বকাপ খেলছে, এটাই সবচেয়ে বড় বিষয় ছিল। বিজয়ের কোনো প্রত্যাশা ছিল না।

কিন্তু স্কটল্যান্ডের সঙ্গে জিতে ইতিমধ্যে ক্রিকেটে এক নতুন অধ্যায় সৃষ্টি করে বাংলাদেশের দামাল ছেলেরা। সে সময় বিশ্বমঞ্চের কোনো স্পোর্টিং ইভেন্টের চেয়ে বড় অর্জন তেমন একটা ছিল না আমাদের। সে জন্য এ রকম একটা জয়ের বহিঃপ্রকাশ ছিল নজিরবিহীন! মানুষের মুখে মুখে আকরাম, বুলবুল, সুজন, রফিকদের অদম্য গল্প। প্রত্যেক ক্রিকেটার যেন একেকটা রূপকথা রাজপুত্র!  

৩১ মে, ১৯৯৯। বাংলাদেশ খেলবে পাকিস্তানের সঙ্গে। সেই বিশ্বকাপের অন্য রকম দাবিদার ছিল পাকিস্তান। আমার দেখা পাকিস্তানের সবচেয়ে শক্তিশালী একাদশ। সেই দলে ছিলেন সাইদ আনোয়ার, ইনজামামের মতো বিশ্বমানের ব্যাটসম্যান। স্পিড স্টার শোয়েব আকতারের আগুনের গোলা! রিভার সুইংয়ের জনক ওয়াসিম আকরাম। বিশ্বসেরা স্পিনার সাকলায়েন মুস্তাকের ঘূর্ণি বোলের মায়াবী জাদুতে একেবারে নাস্তানাবুদ প্রতিপক্ষ ।

তাঁদের সামনে সদ্য ক্রিকেটে আসা একঝাঁক তরুণকে দিয়ে গড়া বাংলাদেশের একাদশ। এ যেন ক্ষুধার্ত সিংহের সামনে সদ্য ভূমিষ্ঠ হরিণশাবক। তাতে কী! বীরেরা কখনো ডরায় না। স্কটিশদের সঙ্গে জিতে ক্রিকেটাররা ভীষণ উজ্জীবিত। আত্মবিশ্বাস তুঙ্গে। তা ছাড়া টিম বাংলাদেশের হারানোর কিছু নেই।

ইংল্যান্ডের নর্দামটনে টসে জিতে ফিল্ডিং করার সিদ্ধান্ত নেয় পাকিস্তানের অধিনায়ক ওয়াসিম আকরাম। সে সময়ের সবচেয়ে শক্তিশালী বোলিং আক্রমণের সামনে সাবধান এবং রক্ষণাত্মক পরিকল্পনা বাংলাদেশের। ব্যাটিংয়ে ওপেন করতে আশে শাহরিয়ার হোসেন ও মেহরাব হোসেন। তাঁদের ইস্পাতসম দৃঢ়তার সামনে ম্লান হয়ে যায় ওয়াসিম ওয়াকার শোয়েবেরা! বেতারে খেলার ধারাবিবরণী চলে, একটা চার হলে বাঁধভাঙা আনন্দ। অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। ১৫ ওভার ৩ বলে সাকলায়েন মুস্তাক যখন প্রথম আঘাত হানেন, ততক্ষণে ৬৯ রানের একটা ভালো ওপেনিং জুটি তৈরি হয়।

এর ওপর ভর করে ৫০ ওভার শেষে ৯ উইকেটে ২২৪ রানের লক্ষ্য ছুড়ে দেয় বাংলাদেশ। সবচেয়ে বেশি ৪৪ রান করেন আকরাম খান। এখনকার সময় একদিনের ক্রিকেটে ২২৪ রান মামুলি মনে হলেও সে সময় এটাকে একটা নির্ভরযোগ্য ফাইটিং স্কোর হিসেবে বিবেচনা করা হতো।

বিরতির পরে ব্যাট করতে নামে পাকিস্তান। এক পাশে মারকুটে বুমবুম আফ্রিদি, অন্য পাশে সে সময়ের সবচেয়ে বেশি শতকের মালিক সাইদ আনোয়ার। বল হাতে খালেদ মাহমুদ সুজন! স্নায়ুর চাপে ধুঁকছে গোটা বাংলাদেশ।

পাকিস্তান, এমনকি ক্রিকেট–বিশ্ব অনুমান করতে পারেনি যে নর্দামটনের বাতাস সেদিন উল্টো বইছে। প্রথম ওভারে আফ্রিদি নেই, দ্বিতীয় ওভারে ইজাজ আহমেদ নেই, তৃতীয় ওভারে সাইদ আনোয়ার রানআউট হয়ে মাথা নিচু করে প্যাভিলিয়নে ফিরে যান। এভাবেই আসা-যাওয়া চলেতে থাকে। একেকটা উইকেট পড়ছিল আর আমার মনে হচ্ছিল, মাউন্ট এভারেস্টকে কিক দিয়ে বঙ্গোপসাগরে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। ৪৪ ওভার ৩ বলে ১৬৯ রানে গুটিয়ে যায় পাকিস্তান। বাংলাদেশ পায় ৬১ রানের এক অবিস্মরণীয় জয়। সে বিজয়ের আনন্দ উত্সবে প্রকম্পিত হয় বাংলার আকাশ–বাতাস। গ্যালারিতে উপস্থিত বাংলাদেশি দর্শকেরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে নিরাপত্তাবেষ্টনী ভেঙে মাঠে প্রবেশ করে।

পরের দিন চলে রঙের খেলা! আবালবৃদ্ধবনিতা সবাই মেতে উঠেছিল বিজয়ের উত্সবে। স্কুল–কলেজে ক্লাস হয় না। রঙের খেলা খেলতে খেলতে বহু রঙে রঙিন হয়ে বাসায় ফিরি।

তারপর শুরু হয়েছে নতুন শতাব্দী, কেটে গেছে দুই দশক। অনেক জল গড়িয়েছে পদ্মা, মেঘনা, যমুনায়। সেদিনের সেই টিনএজাররা আজকে যৌবনের মধ্যে গগনে। এখন বাংলাদেশ টেস্ট ক্রিকেটের মর্যাদা পেয়েছে। অনেক সিরিজ জিতেছে। বিশ্বমানের খেলোয়াড় তৈরি হয়েছে। সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন একটা বিশ্বকাপ ট্রফি ছিনিয়ে নিয়ে দেশবাসীকে উপহার দেবে।

অনেক কিছুই হয়তো হবে, কিন্তু নর্দামটনে পাকিস্তানকে হারানোয় যে আনন্দের বন্যা বয়ে গিয়েছিল, বাংলার মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় হয়তো কোনো কিছুই তাকে ছাপিয়ে যেতে পারবে না।

*লেখক: রুপক রেজা, মিরপুর, ঢাকা।