ব্যথার দান

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

এমন খোলা আকাশের নিচে আমার বসে থাকতে ইচ্ছা করছে না। অন্ধকার রাত। সময় কত হবে, জানি না। কিন্তু এটা জানি, আমি আমার দুঃখ আকাশকেও দেখাতে চাই না। অন্যদের তো মোটেই না। হালকা বাতাস বইছে। প্রায়ই আমি এটাকে লু হাওয়া বলে চালিয়ে দিই, কিন্তু আজ হাওয়ায় ভিন্নতার স্বাদ।

আম্মু ডেকে চলছে খাবার খেতে। আমি আসছি আসছি করে ঠিক কতটা সময় কাটিয়ে দিয়েছি, হিসাব নেই। আম্মু বারবার বলত, ব্যথা পাওয়া মানুষদের একা থাকতে নেই। নিঃসঙ্গতাকে স্থান দিতে নেই এই সময়ে। আমি মায়ের এই কথা বারবার ডিনাই করেই এসেছি, কিন্তু মায়ের বলে যাওয়া থামেনি। বেহায়া প্রেমিক যেমন তার শত ভুলের প্রেমকেও পরম যত্নে আগলে রাখতে চায়, ঠিক তেমনি মাও তার কথাটা আগলে রেখেছে। একা থাকিস না বাপ! একা থাকিস না।

বুঝ হওয়ার পর থেকে বাবাকে কখনো ‘বাবা’ ডাকিনি! মাকে কখনো ‘মা’ ডাকিনি। আব্বুকে দেখেছি আম্মুর মাকে আম্মা ডাকতে, আমার দাদিকে মা ডাকতে!

মাকে মা অথবা বাবাকে বাবা ডাকতে আমার কেমন যেন জড়তা কাজ করে। প্রথম দেখায় আপন মানুষের চোখের দিকে তাকাতে ঠিক যেমন জড়তা, ঘুরে ঘুরে আমায় যেন তেমন জড়তার তীক্ষ্ণ তিরই পথ রোধ করে দাঁড়ায়।

এই যে, এমন ছোট বিষয়গুলো নিয়ে ভাবি, এমনি এমনিই তো আর ভাবি না। লাভ অবশ্য আছে। এমন ভাবনারা আমাকে ব্যথা ভুলতে সাহায্য করে। ভুলে থাকতে সাহায্য করে সেই মানুষটাকে, যে মানুষটার কাছে নিজের সবটুকু রেখে এসেছি। সেই মানুষটা আমাকে আমার কিছুই আনতে দেয়নি। এমন মায়া বুঝি আমি ছাড়া আর কারও হয়নি।

ভাবনায় ছেদ পড়ে, আম্মুকে দেখি খাবার নিয়ে হাজির ছাদে। সঙ্গে ছোট বোনটাও এসেছে। খুব অবাক হইনি। আমি মাকে চিনি। এখন যদি কবরস্থানেও বসে থাকি মা সেখানেও খাবার আনতে দ্বিধা করবেন না। তবু ইদানীং বিশ্বাস করতে ভয় হয়। আমার বিশ্বাসটুকু, এমনই একটা জাতের কাছে বরণ করছে অতি পরাজয়। কিন্তু মা তো মা-ই, উপেক্ষা করার সাধ্য নেই।

ছোট বোন হাত ধুইয়ে দিল। বলল, দেখ, তোর জন্য সালাদ বানিয়েছি। নিরুৎসাহিত আমি লোকমা গিলে গেলাম কয়েক মিনিট। মাকে দেখি কেমন নির্বিকার। তাকে এভাবে দেখলে মাঝেমধ্যে বলতে ইচ্ছা করে, আহ অবলা নারীটা! প্রতিনিয়ত এভাবেই হেরে যাই তাদের কাছে। তাদের আদরের কাছে।

কর্মযজ্ঞ শেষে ফেরার পথে একটু পরপরই কেমন বিধ্বস্ত কংক্রিটের স্তূপের দেখা মেলে। প্রতিনিয়তই চোখে বিশ্রী আর অশোভন দৃশ্য এনে দেয়।

কিন্তু,
-ছোট ছোট এমন অশোভনীয় পাথর কণাগুলো কুড়িয়ে যখন তার নামটা লিখি, আমি তাজ্জব বনে যাই! পাথরগুলো তার নাম কত সুন্দর করে তোলে। অথচ সে আমায় ফেলনা কংক্রিট ভেবেই চলে গেলে। যদি সে এই সৌন্দর্য দেখত, তাহলে হয়তো বুঝত আমি ওসব বিধ্বস্ত কংক্রিটের মতোই, শুধু নাম নয় মানুষটাকেও সাজাতে পারতাম।আসলে সে কী নিয়ে গেল? আমি ভেবে হয়রান হই!

নাহ, খুঁজে পাই না। তবে এমন খারাপ লাগার কারণ কী?

এমন কান্না, ঘর্মাক্ত দুপুর, খাঁ খাঁ রোদ্দুর। মাটি ফেটে চৌচির হয়ে যাওয়া জমিনের যেন কান্নার পানি ছাড়া তৃষ্ণা মিটবে না। ঠিক তেমন কান্না।

আমি চাইতাম লোকে শুনুক। তারপর বলাবলি করুক। তাদের এই ফিসফিসানিতে বাতাসের গায়ে ভারী সব আবরণ পড়ুক। সেও আমার মতো ক্লান্ত হোক। আমি বাতাসের কথা বলছি! বাতাসও আমার মতো ক্লান্ত হোক। সে বুঝুক এর তিক্ততা। তারপর গিয়ে ছেড়ে যাওয়া মানুষটাকে বলুক, তুমি জীবনেও হাসতে পারবে না!

বাতাসই পারে তার কাছে যেতে। আরও একজন পারে, সে হলো সূর্য। তার সঙ্গেও আমার ভাব হচ্ছে। মাঝেমধ্যে মিথ্যা আফসোস জন্ম নেয় মনে, ইশ, যদি সূর্য কিংবা বাতাস হতাম।

কয়েক লোকমা খেয়েই সামনে থেকে প্লেট সরিয়ে দিলাম। ছোট বোন অনুনয় করল, ভাইয়া আরও কয়েক লোকমা খা। আমি হাসিমুখে বললাম, তোদের অতি আদরেই আমার অর্ধেক পেট ভরে যায়। মা এগিয়ে এলেন। আমি বললাম, তোমার ছেলে ঘুমুবে এখন, কোল পেতে দাও না!

পরম যত্নে আমাকে তিনি কাছে টানলেন। কোলে তুলে নিলেন বটগাছের মতো অগোছালো আমার ঝাঁকড়া চুলের মাথা। শান্তি লাগছে অনেক। এই বুঝি তবে ব্যথার দান! তার দেওয়া ব্যথা আমাকে মায়ের কোল চিনিয়েছে। চিনিয়েছে নিঃস্বার্থ মমতা আর প্রেম। সময় বয়ে চলছে, আমি আর মা তারা গুনছি, একটা, দুইটা, তিনটা।

  • লেখক: হাসান কামরুল, বরুড়া কুমিল্লা

    **নাগরিক সংবাদে লেখা, গল্প, নাগরিক সমস্যার কথা লিখতে পারবেন আপনিও। মেইল ঠিকানা [email protected]