বুক ভরা সুখ

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

ঈদের জামাকাপড় নিয়ে কথা–কাটাকাটি হচ্ছে হাবিব আর লাবীবের মধ্যে। হাবিব লাবীবকে বললো, জানিস লাবীব‚ বাবা গতকাল উত্তরা গিয়েছিলেন। ওখান থেকে দামি পাঞ্জাবি আর পায়জামা কিনে এনেছেন আমার জন্য।

হাবিবের কথা শুনে লাবীব জ্বলে উঠলো তেলেবেগুনে। সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলো, ধুর! রাখ তোর রূপকথার গল্প! তোর বাবা আমাদের গ্রামের বাজার থেকেই জামাকাপড় কিনে এনেছেন তোর জন্য। আর যদি উত্তরা থেকেই এনে থাকেন; তাহলে আমি আনব বিদেশ থেকে। তুই কিন্তু আমার ওগুলোর ধারেকাছেও যেতে পারবি না। চলছে বিরামহীন, নিশ্ছিদ্র আর অক্লান্ত কথা–কাটাকাটি।

ওই দিকে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে হাবিবের সবচেয়ে ভালো বন্ধু আবিদ। হাবিব‚ লাবীবের সহপাঠীদের মধ্যে আবিদই সেরা! এভাবে বললেও বোধ হয় থোড়াই হবে!

তার চেয়ে ভালো হয়, যদি বলি আবিদ হলো সেরাদের সেরা। পড়াশোনার টেবিল, ক্রিকেট মাঠ, ফুটবল মাঠ, হাডুডু খেলা, গল্প আর হাসিতামাশা কোনোটিতেই পিছিয়ে নেই আবিদ! ক্লাসের সেরা পাঁচে প্রিয় একটি নাম আবিদ। ক্রিকেটমাঠে ব্যাট হাতে মাঠ কাঁপানো পারফরম্যান্স। বল হাতে স্টাম্প ভেঙে দেওয়ার মতো হাল। ফুটবল নিয়ে পুরো মাঠ দৌড়ে সবাইকে নাচিয়ে দেয়াতে একাই এক শ। আর হাডুডুখেলা! ওখানে তো কেউ পাত্তাই পায় না! গালগল্পে মজিয়ে রাখা আর হাসিতামাশার ক্ষণে সবাইকে হাসাতে হাসাতে শেয়ালের হুক্কাহুয়া লাগিয়ে দেওয়া, সবগুলোতেই আবিদের রয়েছে যথেষ্ট নামডাক। সেই আবিদ আজ ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। আঙুল মুখে দিয়ে শুনে যাচ্ছে ওদের কথা–কাটাকাটি। খোলা আকাশের পানে তাকিয়ে রয়েছে আনমনা হয়ে। মনে হচ্ছে বাতচিত করতে না পারা এক মানবমূর্তি। ওই দিকে হাবিব ঝগড়াঝাটিতে নিমজ্জিত থাকলেও আড়চোখে দৃষ্টি ফেলে রেখেছে আবিদের ওপর।

ইতোমধ্যেই সন্ধ্যা নেমে এল ধরণীতে। পশ্চিমাকাশে ভেসে ওঠলো সুয্যিমামার লাল আভা। বাড়ি ফেরার তাগিদে ইতি ঘটল ঝগড়াঝাটির।

হাবিব আজ চিন্তক সেজেছে। বাসায় এসে বসে বসে ডুব দিয়েছে গভীর চিন্তায়। নির্লিপ্ত হয়ে ভাবছে আবিদের কথা। হাবিব আবিষ্কার করল, এবার ঈদে আর কেনাকাটা হবে না আবিদের, যেহেতু তার দিনমজুর বাবা টানা দুই সপ্তাহ ধরে অসুস্থ। আর কেনাকাটাহীন ঈদ–আনন্দও জমে উঠবে না‚ ভেবেই হয়তো চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল আবিদ। এসব ভাবার সঙ্গে সঙ্গে হাবিব আবিষ্কার করল, স্কুলে যে পড়েছিল; ঈদ মানে ‘খুশি’, ঈদ মানে ‘আনন্দ’। সেটাই ছিল পৃথিবীর সবচে বড় মিথ্যে! নয়তো এমন হতো কেন আবিদের মতো গরিব–দুঃখীদের।

আবিদের দিনমজুর বাবা। পুরো দিন গায়ের ঘাম ঝরিয়ে দুই পয়সা জুটাতে পারলে ক্ষুধাহীন নয়তো ক্ষুধাতুর হয়েই কাটাতে হয় তাদের। আবিদের মা-ও বসে না থেকে, কারও বাসায় কিংবা নিজ বাসায় বসে বসে অন্যের কাঁথা সেলাই করে কিছু কামানের চেষ্টায় থাকেন। এভাবেই দিন গুজরান হয় তাদের। আবিদের এ সমস্যাগুলোও হাবিবের জানার বাইরে নয়। আর কেনই-বা জানা থাকবে না! আবিদের বাবা তো তাদের বাসায় গিয়েও কাজকাম করেন প্রায়সময়ই।

দুই দিন পরই ঈদ। এখনও কিছু কেনা হয়নি আবিদের! এভাবে দেখতে দেখতে চলো এলো ঈদের দিন। আনন্দে মুখরিত ঈদের প্রভাত। সকাল সকাল নতুন জামা গায়ে পরে ঈদগাহে চলে যায় লাবীব আর তার বন্ধুরা। গিফট অপেক্ষা করছে হাবিব আর আবিদের জন্যে। অকস্মাৎ সবাইকে তাক লাগিয়ে গত হওয়া ঈদের জামাকাপড় পরে এলো হাবিব। বন্ধুরা সবাই অপলক নেত্রে তাকিয়ে আছে অবাক দৃষ্টিতে। অমনি সবাই বলাবলি শুরু করে দিল, কিরে এতদিন তো ভালোই চাপা মারলি! কই তোর উত্তরার দামি দরের জামাকাপড়?

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

নিশ্চুপ বসে বসে সবগুলো প্রশ্ন আর তুচ্ছতাচ্ছিল্য শুনে যাচ্ছে হাবিব। কিছু বলার জো নেই তার। তবুও বন্ধুদের এতো বলাবলি সহ্য করতে না পেরে একবার বলে উঠলো‚ ‘আচ্ছা দেখিস তোরা, এখানেই আসবে আমার জামাকাপড়।’ আবার হেসে ফেটে পড়ে যাওয়ার মতন হালেও সবাই মৃদু ধাক্কা দিল হাবিবকে। সবাই একসঙ্গে বলে উঠলো, ‘কিরে, তোর জামা কাপড়ের কি হাত‚ পা-ও আছে?’ এরই মধ্যে আচমকা হাজির হলো আবিদ। আবিদকে দেখে সবার চোখেমুখে ভেসে ওঠছে প্রশ্ন সমাহার। সইতে না পেরে একপর্যায়ে প্রশ্ন ছুড়লো লাবীব, ‘কিরে আবিদ!  তুই না বললি জামাকাপড় কিনিস নি! তো পরনে এগুলো কী?’ আবিদ খুশিতে আটখানা হয়ে বলে দিলো, ‘আর বলিস না! গতকাল হাবিব তার জামাকাপড়গুলো আমাকে দিয়ে এসেছিল। কিন্তু আমি না রেখে ওইগুলো আবার তাদের বাড়িতে দিয়ে এলাম। বাড়িতে ফিরতে না ফিরতেই দেখি সে জামাকাপড় নিয়ে আবারও আমাদের বাড়িতে উপস্থিত। শেষমেশ দেওয়ার জন্য গেলে, ওর বাবা–মাও বেশ জোরাজুরি শুরু করে দিলেন। কী আর করি! আর না এনে কী পারা যায়?’

আবিদকে আজ রাজপুত্রের মতো দেখাচ্ছে। যেন এক টুকরো পূর্ণিমার চাঁদ। কেউ বিশ্বাসই করতে পারছে না যে তাদের সামনে আবিদ। গরীব বাবার ছেলে হলেও আবিদকে দেখতে-শুনতে কিন্তু তা মনে হয় না! অসাধারণ এক অবয়বের অধিকারী আবিদ। জামায় আর চেহারায় আজ তাকে বেশ মানিয়েছে। আর কেনই-বা মানাবে না; হাবিব তো তার ঈদের জামাগুলো বাবাকে দিয়ে বার তিনেক পাল্টিয়ে এনেছে। আবিদের মুখ থেকে হাবিবের অবাককাণ্ড শ্রবণে সবাই হতভম্ব। সবাই যেন মূক হয়ে গেছে! শেষমেশ হাবিব তার আকাশভর্তি খুশি আটকাতে না পেরে মুখ খুললো, ‘কিরে তোরা দেখেছিস আমার জামা কাপড়?’

সবার মুখে লজ্জা মিশ্রিত ছাপ হলেও আবিদের চোখেমুখে চাঁদকে হার মানানো হাসি। আহ্লাদিত আবিদকে দেখে খুশির অন্ত রইলো না হাবিবেরও। সে যেন এমন আনন্দ কোনোদিনও পায়নি!

হাবিব মুখফুটে সবাইকে কিছু না বললেও আপন কাজেকর্মে বুঝিয়ে দিল‚ পরোপকারের আনন্দের কাছে হেরে যায় ‘ঈদ আনন্দ’। পুরোনো জামাকাপড় গায়ে ঢেলেও হাবিব উপভোগ করলো এক হৃদয়গ্রাহী ঈদ।

লেখা: মুহাম্মাদ আব্দুল কাদির, কোম্পানীগঞ্জ, সিলেট