গরিবের ট্রেন ঈশা খাঁ মেইল
‘ঝক্কড়ঝক্কড় মৈমনসিং
ঢাকা যাইতে কত দিন।’
—আজকেও ঈশা খাঁ লেট। সেই কখন থেকে মেথিকান্দা স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছি, এখনো আসছে না। যদি বেলা সাড়ে তিনটার মধ্যে না আসে, তবে অন্য ব্যবস্থা। এখান থেকে ভৈরব প্রায় ১৫ কিলোমিটার, মাঝখানে শ্রীনিধি আর দৌলতকান্দি স্টেশন। তিতাস কমিউটারের টিকিট বিক্রেতা জাফর মিয়াকে জিজ্ঞেস করলে দশাসই শরীরে হাসির কাঁপন উঠিয়ে বলল, ‘গরিবের ট্রেইন ঈশা খাঁ মেইলরে পুছে কেডা?’
জাফর মিয়া জানাল, ‘ঈশা খাঁ মেইল এহন আমীরগঞ্জে হাওয়াবাতাস খাইতাছে, আসর তামাতি আইতে পারে। আনপে স্যার তুলাতুলী থাইক্যা বারৈচা যাইয়া বাস ধরুইন।’ আমার টার্গেট বিকেলে ঢাকা থেকে ভৈরবে পৌঁছানো মহানগর গোধূলি এক্সপ্রেস। মেথিকান্দায় মহানগরের স্টপেজ নেই। আব্বা রেলজার্নি পছন্দ করেন, আমারও খুব পছন্দ।
নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলা হাসপাতালে যোগ দেওয়ার পর থেকে একদিন ভোরবেলা তিতাস কম্পিউটারে মেথিকান্দায় নামি, পরদিন ডিউটি শেষে ঈশা খাঁ ধরে ভৈরব হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যাই। বাংলাদেশ রেলওয়ের অবহেলিত ট্রেন ঈশা খাঁ মেইল বেলা সাড়ে ১১টা নাগাদ কমলাপুর থেকে ছাড়ে আর রাত সাড়ে ৯টায় ময়মনসিংহে পৌঁছার কথা। মাঝখানে গাজীপুর, নরসিংদী, কিশোরগঞ্জ হয়ে ময়মনসিংহে পৌঁছায়। পাড়ি দেয় ৪১টি স্টেশন। রাজধানী ঢাকাকে হাওরের উপজেলাগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত করেছে। কত সুন্দর সুন্দর নামের স্টেশন—নলছাটা, আড়িখোলা, হাঁটুভাঙ্গা, কালিয়াপ্রসাদ, ছয়সূতি, নীলগঞ্জ, গৌরীপুর। হুমায়ূন আহমেদ সূত্রে ‘সুখী নীলগঞ্জ প্রজেক্ট’, ‘গৌরীপুর জংশন’ ইত্যাদি নামগুলো ঈশা খাঁ মেইলে উঠলেই মনে নাড়া দেয়। মেইল ট্রেনের সঙ্গে থাকে একটি ডাকবাক্স রঙের লাল বগি।
এই ট্রেনে ‘সময় যেন থমকে দাঁড়ায়’। গ্রামীণ মানুষের কোনো তাড়াহুড়া নেই। ঢাকা শহরের যানজট, টাইম ইজ মানি, প্র্যাকটিস নিয়ে কামড়াকামড়ি, হাহুতাশ—এসব কিছুই নেই। প্রায় প্রত্যেক যাত্রী নিরাবেগ—‘উঠছি যহন একসময় পৌঁছাইবাম’ অ্যাটিটিউড। পুরোপুরি পারিবারিক পরিবেশ—দুই কথা তিন কথার মধ্যেই একজন আরেকজনের আপনজন হয়ে যায়।
‘স্যার এক কাপ চা খাইন’, পেটানো স্বাস্থ্যের বাদল মিয়া। তাঁর বাড়ি স্টেশনের আশপাশে মেথিকান্দা বা টুকিপুরা গ্রামে, পেশায় পাইপমিস্ত্রি। হাসপাতালের পানির পাইপের কোনো সমস্যা থাকলেই বাদল মিয়াকে যন্ত্রপাতিসহ দেখা যায়। লোকমুখে শুনতে পেয়েছি, তিনি খুব দুর্ধর্ষ মানুষ; তবে আমার চোখে কোনো আলামত ধরা পড়েনি। এই এক সমস্যা! মেথিকান্দা স্টেশনে দাঁড়ালে অনেকে চা পান করতে সাধেন, আবার অনেকে আড়চোখে তাকিয়ে পাশের ব্যক্তিকে ফিসফিস করে কিছু হয়তো বলেন। এর মধ্যে জাফর মিয়া এক অন্ধ গাতকের হাত ধরে আমার কাছে নিয়ে আসেন। ‘স্যার, মন্তাজ খুব ভালো গায়। একটা গান অর্ডার করেন।’ অন্ধ মন্তাজ মিয়াকে মাঝেমধ্যে স্টেশনে দোতারা নিয়ে গাইতে দেখি। মন্তাজ মিয়া খুব চিন্তার স্বরে বলে, ‘জাফর বাই (ভাই), ঈশা খাঁ কি আউজকা আইত না?’ ‘আরে মন্তাজ পাগলা তুই, আইজকা লায়পুরায় বেড়াইবি ভৈরব যাওয়া লাগত না’—জাফর মিয়া মন্তাজ মিয়াকে নিয়ে রগড় করে। মন্তাজ মিয়া বড় জামগাছের নিচে জুতমতো বসে আকাশের দিকে মুখ তুলে গলায় সুর তোলে—
‘আমায় উদাসী বানাইলো গো
মরার কোকিলে।
আমায় উদাসী বানাইয়া গেলো
বসন্তেরই কালে গো
মরার কোকিলে।’
বাদল মিয়ার চা আর মন্তাজ মিয়া–জাফর মিয়ার গানের পরিবেশনাও আমার মনের টেনশন কমাতে পারল না। হঠাৎ মনে হলো, আজকে একটা অ্যাডভেঞ্চার করলে কেমন হয়? এই সময় ভৈরব বা নরসিংদী থেকে কোনো ট্রেন নেই। রেললাইনের স্ল্যাবের ওপর দিয়ে হেঁটে শ্রীনিধি স্টেশন পর্যন্ত গেলে কেমন হয়? ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আস্তে আস্তে রেললাইনের ওপর দিয়ে শ্রীনিধি স্টেশনের দিকে এগোতে থাকি। এই চার, সাড়ে চার কিলোমিটার পথ হাঁটতে এক ঘণ্টার কম সময় লাগবে। এখানকার সুন্দর ল্যান্ডস্কেপের মধ্য দিয়ে হাঁটতে থাকি। হাতে বিকল্প আছে—মাঝেমধ্যে গ্রামীণ সড়কের ওপর দিয়ে চলা রিকশা। টায়ার্ড হয়ে গেলে রিকশায় উঠে পড়ব। শ্রীনিধি পৌঁছার পর চা খেতে খেতে ট্রেনের ঘোষণা শুনলাম।
গত রাতটা ভালো যায়নি। মির্জার চর থেকে টেঁটাযুদ্ধের চার-পাঁচজন আহত সৈনিক এসেছেন। একজন তো বাঁশের হাতলসহ টেঁটা নিয়ে এসেছেন। তাঁর অবর্ণনীয় কষ্ট দেখার মতো নয়। মাঝেমধ্যে রোগীদের কষ্ট আর আত্মীয়স্বজনের আকুতিতে হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যেতে মন চায়। কিন্তু আমাদের ট্রেনিং, পেশাদারত্ব ও মানুষের জন্য কিছু করার তাগিদে অনেক যাতনা দেখতে হয়। ইমার্জেন্সি স্টাফ আলী হোসেন মিয়া, স্বাস্থ্য সহকারী কামরুল সাহেব আর সিস্টার মিলে ওটি রুমের করাত দিয়ে বাঁশের হাতল কেটে রোগীকে কিছুটা রিলিভ দেন। বাঁশগাড়ী, মধ্যনগর, শ্রীনগর, চর মধুয়া—মেঘনার বিভিন্ন চরের ইউনিয়ন ও গ্রামগুলো থেকে পানি নেমে গেলেই টেঁটাযুদ্ধ শুরু হয়। ঘোষণা দিয়ে এই ভয়ংকর যুদ্ধ বছরের পর বছর চলছে। ২৪টি বিশাল ইউনিয়ন নিয়ে রায়পুরা উপজেলার মেঘনা-ব্রহ্মপুত্র-আড়িয়াল খাঁ নদীর অনেকগুলো চর পুলিশের কাজের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। পাজি লোকজন কোনো কুকর্ম করে একদিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর, বাঞ্ছারামপুর, আশুগঞ্জ, অন্যদিকে কিশোরগঞ্জের ভৈরব, কুলিয়ারচর, বাজিতপুর, নরসিংদীর সদর, নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ, মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায় নৌপথে পালিয়ে যায়। আলী হোসেন মিয়া নরম মানুষ। অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে রোগীর পরিচর্যার ফাঁকে ফাঁকে রোগীর লোকদের মৃদু ভর্ৎসনা করেন এই বর্বর যুদ্ধের জন্য। রোগীর লোকজন নিজেদের ওপর টেঁটা পড়ায় হুঁশে আসে—‘ফরেন পার্টি আর গেরাইম্যা টেন্ডলগুলির জন্য এই যুইজ্জ বছরের পর বছর চলতাছে, লকত্ ঝড়তাছে।’ মামলা-মোকদ্দমায় চরের প্রায় প্রতিটি ঘরেই অশান্তি।
দাদিবুড়ি নাতি-নাতনি সামলে পানের বাটা খুলে পান চিবাচ্ছেন। তাঁর ছেলে স্টেশনে এলেই ‘সিকরেট’ ফুঁকতে নিচে নামেন। একটু পরপর ধারাবিবরণী দিয়ে যান—‘এহনও লাল বাত্তি জ্বলতাছে, মাইও আল্লাহ আল্লাহ করো। এদিক থাইক্যা একটা কম্পুটার আর হেদিক থাইক্যা এসপ্রেইস টেরেইন গেলেগাই আমরারে ঠেকায় কেডা!’ ‘বাজান, কলা খাইন’—সামনের দাদিবুড়ি আমার দিকে দুটি চম্পাকলা বাড়িয়ে ধরেন। কিছুক্ষণ আগে তাঁর বউমা কুড়ি টাকা দরে চম্পাকলা কিনেছেন।
এর মধ্যে সালামত মিয়া চিরপরিচিত হাসি দিয়ে বলে, ‘আওজকা বিজনেস ডাইল।’ সালামত মিয়া তেজগাঁও থেকে পুরো ঈশা খাঁ মেইল ট্রেনের ওপরের তাকজুড়ে নিয়ে আসেন পাউরুটি। কমপক্ষে ৪০ থেকে ৫০টা পাতিভর্তি পাউরুটি। ট্রেনে দেদার বিক্রি হচ্ছে। একটা করে স্টেশন এলেই সালামত মিয়া অতি তৎপরতার সঙ্গে জানালা দিয়ে পাতির পর পাতি পাউরুটি স্টেশনের চা–দোকানগুলোতে সাপ্লাই দিতে থাকেন। মানিকখালী, বাজিতপুর, সরারচর যেতে যেতে টু–থার্ড পাউরুটি সাবাড়।
টিকিট চেকার ধীরেসুস্থে এদিক-ওদিক তাকান। এই একমাত্র ট্রেন দেখলাম, যেখানে যাত্রীরা টিকিট চেকারকে ভয় পান না আর টিকিট চেকারও টিকিট দেখতে শরমিন্দা হন। আমি লালচে ছোট শক্ত টিকিটটা দিতেই পেনসিল দিয়ে রাইট চিহ্ন দিয়ে স্বস্তির হাসি হাসেন চেকার তাঁর চাকরির মর্যাদা রক্ষা করতে পারায়। এই মেইল ট্রেনকে যাত্রীরা নিজের মনে করেন আর সরকারও ভর্তুকি দিয়ে গরিব যাত্রীদের সেবা দেন। টিকিট চেকারদের জোরাজুরি নেই। দাদিবুড়ি—‘বাজান, আরেক দিন টিকেট নিয়ুন, আওজকা পান খাইন’ বলে টিটির দিকে পান বাড়িয়ে ধরেন।
*লেখক: আসফাক বীন রহমান, সহযোগী অধ্যাপক, শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ, গাজীপুর