হারিয়ে যাচ্ছে বাংলার বাবুই

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চার কিলোমিটার দূরের গ্রাম সিন্দুরিয়া। ঢাকা জেলার সাভার উপজেলার বংশী নদীর পূর্ব ধারের এ গ্রামটি গত বছরও কয়েক শ বাবুই পাখির কলরবে মুখরিত ছিল। বিস্তীর্ণ মাঠ এবং বংশীর খুব কাছাকাছি হওয়ায় প্রকৃতি যেন তার পুরোনো রূপ এই অঞ্চলে রেখে গেছে। তবে বিপদ ঘনিয়ে এসেছে এ অঞ্চলের পাখিদের ওপর। কেটে ফেলা হচ্ছে তাদের বাসা বানানোর গাছগুলো। বিভিন্ন স্থানে তারা ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকলেও তাড়াতাড়ি কমে আসছে তাদের আবাসস্থল। স্থানীয় লোকজনের মতে, কয়েক শ বছর ধরে এই অঞ্চলে বাবুই পাখি বাসা বেঁধে আসছে।

এ গ্রামটিতে একটি স্থানে কয়েক বছর ধরে বাবুই পাখির বাসা বানিয়ে আসা স্বচক্ষে দেখে আসছেন এলাকাবাসী। গ্রামটিতে একটি বিশেষ অঞ্চল রয়েছে, যেখানে তিনটি নারকেলগাছে ৭০টির বেশি বাবুই পাখি তাদের বাসা বেঁধেছিল গত বছরের জুলাই মাসে। কী সুন্দর সেই দৃশ্য! বিকেলে সূর্যাস্তের সময় বাবুই পাখিরা ঝাঁকে ঝাঁকে নেমে আসছে নারকেলগাছগুলোর আশপাশে। কেউ মুখে খাবার নিয়ে আসছে বাচ্চাকে খাওয়ানোর জন্য, কেউ বাসা পাহারা দিচ্ছে আবার কেউ ঝড়ের দাপটে ভেঙে যাওয়া স্থানগুলো মেরামতে ব্যস্ত। সারা দিনব্যাপী তাদের আয়োজন প্রকৃতিকে যেন মাতিয়ে রাখার এক উদ্যোগ।

কয়েক মাস তাদের পর্যবেক্ষণ করে কাটিয়েছি। শুধু বাবুই নয়, বিভিন্ন রকম মুনিয়াও তাদের বাসা তৈরির জন্য বাবুই পাখিগুলো চলে যাওয়ার পর এ গাছগুলোতে আশ্রয় নিত। তবে ৯ মাস পর এই বছর, এপ্রিলে হঠাৎ এসে দেখি পুরো জায়গাটি পরিবর্তন হয়ে গেছে। চারদিকে ইটের দেয়ালের মাঝে কোনোমতে দাঁড়িয়ে আছে একটিমাত্র নারকেলগাছ। তিনটি গাছের মধ্যে কেবল একটি গাছ অবশিষ্ট। সেটার মধ্যেই বেঁধেছে বাবুই পাখির কয়েকটি বাসা।

অবাক হয়ে গেলাম দৃশ্যটি দেখে। কয়েক মাস আগেও যেখানে বাবুই পাখিদের স্বর্গ ছিল, আজ সেখানে তাদের কেবল স্মৃতিটুকুই প্রকাশ পাচ্ছে। মাত্র কয়েক মাস আগেও তিনটি গাছ বাবুই পাখির বাসায় ছেয়ে থাকত। বাবুই সাধারণত গাছের ওপরেই বাসা করতে পছন্দ করে। কিন্তু এ অঞ্চলগুলোতে তুলনামূলক নিচু গাছেও বাসাগুলো দেখতে পাওয়া যেত। তবে এখন একটিমাত্র গাছে কোনোমতে কয়েকটি বাসায় টিকে আছে। দেখে মনে হচ্ছে আর কয়েক মাস পর ঝড়ের দাপটে এগুলোও টিকবে না। এ রকম করুণ হাল এত তাড়াতাড়ি পর্যবেক্ষণ করতে হবে, এটা কারও কল্পনায় ছিল না। পশুপাখির প্রতি অনীহা এবং সংশ্লিষ্ট বন বিভাগের উদাসীনতা যেন কাল হয়ে এসেছে বাংলার এই পাখিদের জন্য।

বাবুই পাখি সাধারণত বর্ষা ঋতুতে বাসা বাঁধে। মে থেকে নভেম্বরের শুরু পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে এদের বাসার মধ্যে থাকতে দেখা যায়। তবে কিছু অঞ্চলে পর্যাপ্ত খাদ্য ও বিভিন্ন রকম সামগ্রীর জোগান সহজ হওয়ায় এরা মার্চ মাসেও বাসা বানায়। সিন্দুরিয়া গ্রামটি ছিল এ রকম একটা অঞ্চল। এ বছরও মার্চের শুরু থেকে তাদের বাসা বানাতে দেখা গেছে। তবে বাবুই পাখির জন্য প্রয়োজনীয় গাছপালা কেটে ফেলা তাদের জন্য একটি বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

ক্রমাগত গাছ কাটার পরেও বাবুই পাখি প্রবৃত্তিগতভাবে ফিরে আসছে এই অঞ্চলে। কিন্তু এভাবে আর কত দিন? বোঝাই যাচ্ছে অদূর ভবিষ্যতে এই অঞ্চলে বাবুই পাখির মতো দেশি পাখি আর টিকবে না। কিন্তু এই ভবিষ্যৎ কি আমরা চাই? সারা পৃথিবীতে যেখানে এখন পরিবেশ রক্ষায় মানুষ এক হচ্ছে সেখানে বাংলাদেশ কেন পিছিয়ে থাকবে?

প্রবৃত্তিগতভাবে যেহেতু পাখিগুলো এই অঞ্চলে আসছে সে ক্ষেত্রে এ অঞ্চলটির প্রকৃতিকে টিকিয়ে রাখা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। পাখিরা বাসা বানায়, এ ধরনের গাছ কেটে ফেলা থেকে সবাইকে বিরত রাখা এবং তাদের খাবার গ্রহণ অঞ্চলের সংরক্ষণ ভবিষ্যতে তাদের টিকিয়ে রাখতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

লেখক: অরিত্র সাত্তার, পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়