প্রান্তিক বাংলাদেশের মানুষ
আমার জীবনের প্রথম গবেষণার কাজে নওগাঁর সাপাহারে যাই। ১০ দিনে সাপাহার উপজেলার সবগুলো গ্রামে শখানেক বাড়িতে হাউসহোল্ড সার্ভে করি। এত প্রান্তিক মানুষের সঙ্গে একটানা কাজ করা আমার জীবনে এই প্রথম। নতুন করে মানুষের গল্প শুনতে শিখি। মানুষের জীবনকে এত কাছ থেকে দেখা আর উপলব্ধি করাও তখনই প্রথম।
নওগাঁর সাপাহারের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কথা বলতে গেলে শব্দ যেন কম পড়ে যায়। আমার দেখা বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর গ্রামগুলোর অনেকটাই সেখানে। মাটির ঘর, বিস্তীর্ণ আমবাগান আর মানুষের নিখাদ আন্তরিকতায় ভরা এক শান্ত জনপদ। নিয়ামতপুরের ঘুঘুডাঙায় রাস্তার দুই পাশে সারি সারি তালগাছ আর সাপাহার আজ যাকে আমের রাজধানী বলা হয়, সেখানে কেটেছিল সুন্দর ও দারুণ অভিজ্ঞতাময় সময়টা।
পুনর্ভবা নদী আর সীমান্তঘেঁষা শেষ গ্রামের নদীগুলো অপার সৌন্দর্য নিয়ে বয়ে চলে। এক সকালে দেখি, এক বৃদ্ধ নদীতে মাছ ধরছেন। সকালভর চেষ্টা করেও ছোট ছোট কয়েকটি মাছই জুটেছে। তবু তাঁর চোখে ক্লান্তির চেয়ে মমতাই বেশি। বাড়িতে অপেক্ষায় থাকা তাঁর স্ত্রী নাকি এই মাছ দিয়েই রান্না করবেন। আমাকে খেয়ে যাওয়ার জন্য আন্তরিকভাবে অনুরোধ করলেন। অচেনা একজন মানুষকে এমন আপন করে ডাকা!
ইন্টারভিউ নিতে প্রতিটি বাড়িতে গেলে একই অভিজ্ঞতা—অঢেল আতিথেয়তা। তাঁরা খুব গরিব, খাবারও সাদামাটা; কিন্তু ভালোবাসার কোনো অভাব নেই। কেউ নিজের গাছের লেবু, কেউ কলা—জোর করেই হাতে তুলে দেন। মনে হয়, এখানে অভাব আছে, কিন্তু হৃদয়ের দারিদ্র্য নেই।
গরিব মানুষের কষ্ট, অসহায় জীবনযাপন আর বেঁচে থাকার গল্পগুলো ভেতর থেকে আমাকে নাড়িয়ে দেয়। নিজের ভেতর এক অন্য রকম আমিকে আবিষ্কার করি। তখনই প্রথম শোষিত আর শোষকের মধ্যকার সম্পর্কের বাস্তব রূপ চোখের সামনে দেখি। শোষিত আর শোষকের মাঝখানের দূরত্ব তখন আর তত্ত্ব রইল না—রক্তমাংসের বাস্তব হয়ে দাঁড়াল।
কিছু পরিবার ছিল, যারা দিনে একবার ভাত খায়, তা–ও শুধু লবণ দিয়ে। সকালে কলাই–রুটি খায়, আর রাতে না খেয়েই থাকে। ভাবা যায়, বাংলাদেশে এখনো অহরহ এমন পরিবার রয়েছে। আদিবাসী পাড়ার অবস্থা আরও করুণ। ওদের ঘরে একেবারেই কিছু নেই, একদম কিছুই না। মাটিতে ঘুমায়, চাটাইয়ে জীবন কাটে। সরকারি কোনো সহায়তা বা বৃদ্ধ ভাতা তাঁদের কাছে পৌঁছায় না। যাঁরা সরকারি দলের কোনো নেতাকর্মীর আত্মীয়, টাকা দেন, রাজনীতি করেন বা সরকারি অফিসের কর্মচারীদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখেন—তাঁরাই মূলত বৃদ্ধ ভাতা বা ত্রাণসহায়তা পান। বাকি সবই চলে যায় স্থানীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত লোকদের কাছে। প্রকৃত অসহায় মানুষদের কাছে শেষ পর্যন্ত কিছুই পৌঁছায় না।
যে কাহিনিটা আমাকে সবচেয়ে বেশি কাঁদিয়েছিল, সেটা এক বৃদ্ধার সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে। তিনি একা থাকেন রাস্তার ধারের স্কুলের একটি মাটির দোকানে। দিনের বেলা স্কুল টাইমে সেখানে মজা বিক্রি করেন, আর সেই দোকানেই দিন-রাত বসবাস করেন। তাঁর কেউ নেই। পানি খান স্কুল থেকে।
নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
আমাদের প্রশ্নপত্রের সব প্রশ্ন করা শেষ। প্রশ্নপত্রের মাঝেই একটি প্রশ্ন ছিল, গত তিন বছরে বাড়ির কেউ মারা গেছে কি না। তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ’। আমি উত্তরে টিক দিলাম। কিছুক্ষণ পরে চলে আসতে নিচ্ছিলাম, তখন আমাকে যিনি ওই বৃদ্ধার কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন, তিনি বললেন—‘আপা, মারা গেছে যে, সেটা শুনলেন না?’
আমি আবার বসলাম। শুনতে চাইলাম। ভাবছিলাম, কোনো স্বাভাবিক মৃত্যু হবে। ভাবিনি এমন একটা হৃদয়বিদারক সত্য ঘটনা শুনতে হবে।
বৃদ্ধার একটি মেয়ে ছিল। মেয়েটি মারা যাওয়ার পর তাঁর স্বামী আরেক বিয়ে করে কয়েক মাস বয়সী নাতনিকে বৃদ্ধার কাছে রেখে যান। বৃদ্ধা সেই নাতনিকে কোলে তুলে বড় করেন। মানুষের বাড়িতে কাজ করে নাতনিকে খাওয়াতেন। মেয়েটির বয়স যখন ৯ বছর, তখন গ্রামের এক লোক তাকে ঢাকায় একটি বাসায় কাজ দিতে নিয়ে যায়।
ছোট মেয়েটি কী একটা ভুল করেছিল—মালিক তাকে পুড়িয়ে মেরে ফেলে। হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। বৃদ্ধা ঢাকায় গিয়ে মেয়েটিকে দেখতে চাইলে তাঁকে দেখতে দেওয়া হয়নি। কয়েক দিন পর মেয়েটার লাশ পচে যাওয়ার পর গ্রামে পাঠানো হয়।
এই কথাগুলো বলতে বলতে বৃদ্ধা এত কান্না করছিলেন যে আমার বুকও কষ্টে ফেটে যাচ্ছিল। আমি কিছুতেই নিজের কান্না আটকাতে পারছিলাম না। আমার চোখেও পানি চলে আসছিল।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি কোনো আইনি ব্যবস্থা নেননি কেন?’ তিনি বললেন, ‘মা, আমাদের মতো গরিবেরা ওদের মতো প্রভাবশালীদের সঙ্গে পারে?’
হ্যাঁ, আসলেই তো তা–ই। গরিব হলে মেরে ফেলা যায়। গরিব হলে মানুষ হওয়া যায় না। জীবনের কোনো মূল্য থাকে না। এমনকি লাশ পাওয়ার অধিকারও থাকে না। নিউজ হয় না। কেউ এই গল্পগুলো লেখে না, কথাও বলে না।
তারা পৃথিবীতে আসে গরিব হয়ে, কষ্ট করে বাঁচে, আবার নীরবে চলে যায়।
আমরা থাকতাম সাপাহার শহরের ডাকবাংলোতে। সেখান থেকে প্রতিদিন ভ্যান বা অটোতে চড়ে প্রায় তিন ঘণ্টার দীর্ঘ যাত্রা করে যেতে হতো দূর–দূরান্তের গ্রামগুলোতে। কোনো কোনো গ্রামে এখনো পাকা রাস্তা পৌঁছায়নি। খেতের আইল ধরে, মাটির সরু পথে এক ঘণ্টা হেঁটে গ্রামে পৌঁছানোর অভিজ্ঞতাও আছে। তবু প্রকৃতির সৌন্দর্য এমন ছিল যে এই কষ্ট একটুও গায়ে লাগেনি।
অনেক সময় একাই ফিরেছি সেই সব দূরের গ্রাম থেকে। পথে কোনো দুর্ঘটনার মুখে পড়তে হয়নি; পেয়েছি মানুষের অকৃত্রিম সহায়তা। অচেনা মানুষজন নিঃসংকোচে পথ দেখিয়েছে, পাশে দাঁড়িয়েছে। সেখানে গিয়েই প্রথম বুঝেছি মানুষ সম্পর্কে আমার ভেতরে জমে থাকা বিদ্বেষ আর অবিশ্বাস একটু একটু করে কমতে শুরু করেছিল।
*লেখক: নুসরাত রুষা, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়